• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আমরাই শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলতে পারি

প্রকাশ:  ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৪৬
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
ফাইল ছবি

শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভরশীল। কিন্তু দেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও শিক্ষাকে পরিকল্পিত গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে মানুষের উপযোগী করে তোলা যায় সে বিষয়টি তেমনভাবে ভাবা হয়নি।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছে যে শিক্ষায় আনন্দ নেই সেটি কোনো শিক্ষায় হতে পারেনা | শিক্ষকের প্রধান কাজ হচ্ছে শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা | আমেরিকার ৩৫তম রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির ওপর তার স্কুলের হেড মাস্টারের প্রভাব এতটাই বিস্তার লাভ করেছিল যে তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানের দিন। কারণ সে দিনই আমেরিকার জনসাধারণের উদ্দেশে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি বক্তৃতা তিনি করেছিলেন, ‘দেশ তোমাকে কি দিলো সেটি বড় কথা নয় বরং দেশকে তুমি কি দিলে সেটিই বড় কথা।’ আনন্দের বিষয় হচ্ছে যে হচ্ছে কেনেডি, কানেক্টিকাট চোয়াট গ্রামার স্কুলে লেখাপড়া করার সময় সেই প্রধান শিক্ষক কেনেডিকে উদ্দেশ করে প্রায়ই বলতেন উপরোক্ত বক্তৃতার কথাগুলো।এখানেই শিক্ষকের সার্থকতা| একজন ভালো শিক্ষক তার শিক্ষার্থীর কল্পনাকে প্রভাবিত করে চিন্তাশক্তি বের করে আনতে পারে| এজন্য আনন্দদায়ক মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করে শিক্ষক যেমন সফল হন শিখাও তেমনি সমাদৃত হয়| যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেটের স্কুল শিক্ষক জেন এলিয়ট তার শিক্ষার্থীদের উপর এই এক্সপেরিমেন্টটি চালান। মার্টিন লুথার কিংয়ের চিন্তাধারা তাকে সবসময় প্রভাবিত করত। ১৯৬৮ সালে যখন মার্টিন লুথার কিংকে খুন করা হয় তারপর থেকেই তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের বর্ণবাদ, বৈষম্য এই ব্যাপারগুলো বোঝাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হচ্ছিলো না। তারা আগের মতোই মফস্বল থেকে আসা শিক্ষার্থীদের অবজ্ঞার চোখেই দেখে যাচ্ছিল।এলিয়ট তার শিক্ষার্থীদের উপর দুইদিনব্যাপী একটি এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। প্রথমে তিনি তার ক্লাসটিকে দুটি গ্রুপে ভাগ করলেন। প্রথম গ্রুপে রাখলেন যাদের চোখের রং নীল এবং দ্বিতীয় গ্রুপে রাখলেন যাদের চোখের রং বাদামী। প্রথম দিন তিনি প্রথম গ্রুপ অর্থাৎ যাদের চোখের রঙ নীল তাদেরকে বাদামী চোখের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সুপিরিয়র তথা উঁচু মর্যাদার বলে ধরে নিলেন এবং বেশি সুযোগ সুবিধা দিতে শুরু করলেন। এমনকি তিনি এক গ্রুপের শিক্ষার্থীদেরকে অন্য গ্রুপের শিক্ষার্থীদের সাথে মেলামেশা করতে নিষেধ করে দিলেন। দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের আরও কোণঠাসা করার জন্য তিনি তাদের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি সবার সামনে বর্ণনা করতে শুরু করলেন।

এর ফলাফল হলো খুবই চমকপ্রদ। প্রথম গ্রুপের শিক্ষার্থীরা অর্থাৎ যারা নিজেদেরকে এখন সুপিরিয়র ভাবে তাদের আচরণ খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে লাগল। তারা ক্লাসে এখন সবচেয়ে মনোযোগী এবং কোন কিছু না বুঝলে তারা সাথে সাথে প্রশ্ন করে। ক্লাস টেস্টেও তারা দ্বিতীয় গ্রুপের সদস্যদের চেয়ে অনেক ভাল করল। সবথেকে মন খারাপ করা যে ব্যাপারটা ঘটল তা হলো, তারা তাদের দ্বিতীয় গ্রুপের বন্ধুদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল এবং তাদের উপর এক ধরনের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতে লাগল। অন্যদিকে দ্বিতীয় গ্রুপের শিক্ষার্থীরা হীনমন্যতায় ভুগতে লাগল এবং সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়তে লাগল।পরের দিন এলিয়ট একই এক্সপেরিমেন্ট চালালেন। কিন্তু এবার যাদের চোখের রঙ বাদামী তাদেরকে নীল চোখের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সুপিরিয়র হিসেবে ধরে নিলেন। তখন ফলাফলও উল্টে গেল। অর্থাৎ নীল চোখ যাদের তারা সবকিছুতে পিছিয়ে পড়তে লাগল।এই এক্সপেরিমেন্টটি তখনকার সময়ে খুবই আলোচিত হয়। পরীক্ষাটি করার সময়কার ভিডিওগুলো নিয়ে ২৫ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করা হয় যার নাম ‘The Eye of the Storm’। এছাড়া ‘A Class Devided’ নামে আরও একটি ডকুমেন্টারি আছে একই বিষয়ের উপর। এই এক্সপেরিমেন্টটি আমাদেরকে বোঝাতে পারে যে সমাজে যারা অবহেলিত তারা কেন পিছিয়ে পড়ে এবং নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হয়।

সম্পর্কিত খবর

    আমাদের দেশে শিক্ষাজীবনে প্রবেশের শুরু থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়, যা তার মনে শিক্ষার প্রতি একধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে। যেমন, পরীক্ষার মাধ্যমে যখন শিক্ষার্থীর মেধা মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়, তখন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক স্তরেই একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ভারসাম্যহীন মানসিকতা গড়ে ওঠে। ফলে তার সহপাঠী একজন মানুষ না হয়ে তার কাছে একজন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে যায়। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাবের কারণে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর যে প্রকৃত বিকাশ ঘটার কথা ছিল তা বাধাগ্রস্ত হয়। এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতিতে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে তার সঙ্গে অধ্যয়নরত অন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি মানবিক ও সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে না।

    বরং সংকীর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও সমষ্টিগত মনোভাবের সমন্বয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করতে পারে না। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য পায়। কাজেই প্রাথমিক স্তরে কোনো ধরনের পরীক্ষা না রেখে কীভাবে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে মেধার মূল্যায়ন করা যায় সে বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। জাপান, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো ইতিমধ্যেই পরীক্ষা ছাড়া তাদের শিক্ষাপদ্ধতি গড়ে তুলেছে। এর ফলে এসব দেশে শিক্ষার্থীদের মেধা যেমন বেড়েছে, তেমনি মানবিক প্রগতি অর্জনও সম্ভব হয়েছে।

    কাজেই আমাদেরও শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমল থেকে প্রবর্তিত গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষাকে নতুনভাবে বাস্তবমুখী করে সাজাতে হবে। যদি প্রাথমিক স্তরে জীবনাচরণ সম্পৃক্ত শিক্ষা প্রবর্তন করা যায়, তবে যে উদার ও সৃজনশীল চিন্তা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে উঠবে, তা তাকে পরবর্তী শিক্ষা স্তরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত করবে।

    পরবর্তী শিক্ষা স্তর কেমন হবে সেটি নির্ভর করবে রাষ্ট্রের মানবসম্পদকে কীভাবে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তার ওপর। এখানে শুধু কর্মসংস্থানের বিষয়ে ভাবলেই হবে না, বরং একজন শিক্ষার্থী যাতে তার অর্জিত শিক্ষা প্রয়োগ করে উদ্যোক্তা হতে পারে সে বিষয়েও ভাবতে হবে। বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। একসময় জনসংখ্যাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে পরিকল্পিত নীতির কারণে জনসংখ্যা আজ জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। তবে এ সম্পদকে কী করে যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করা যায় সে বিষয়টি পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে।

    এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। যদি কারিগরি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করে শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে সাজানো হয় তবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব হবে। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান সরকার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করেছে।

    এ লক্ষ্যে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির জন্য আগামী বছর অষ্টম শ্রেণী থেকে বাধ্যতামূলক কারিগরি শিক্ষা চালু হতে যাচ্ছে। এ কারিগরি শিক্ষা চালু হলে তা শিক্ষার্থীরা ধারণ করে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে কিনা তা গবেষণা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশে যে শিল্প-কারখানাগুলো রয়েছে সেগুলোর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনা করে কী ধরনের কারিগরি শিক্ষার প্রচলন করা হলে তা শিল্পে প্রয়োগযোগ্য হবে সেটা জানতে হবে।

    এছাড়া বিশ্ববাজারে যে শিল্প-কারখানাগুলো রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করে সেদেশগুলোতে দক্ষ জনশক্তি রফতানি করার পরিকল্পনাও শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের আগে ভাবতে হবে। আবার বিভিন্ন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষকরা রয়েছেন তাদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্স আয়োজন করে কারিগরি শিক্ষার বাস্তব ধারণা শিক্ষাব্যবস্থায় প্রবর্তন করতে হবে।

    আবার কারিগরি শিক্ষা যেহেতু হাতে-কলমে নিতে হয়, তাই এ শিক্ষা প্রয়োগের আগে কারিগরি উপকরণগুলো যথেষ্ট পরিমাণ আছে কিনা সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এ বিষয়ে সরকার ছাড়াও বেসরকারি কারিগরি প্রতিষ্ঠানকে ল্যাব গড়ে তোলার মনোভাব দেখাতে হবে।

    এটি বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও আসতে পারে। মনে রাখতে হবে, এটিকে কোনো দান নয় বরং কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সঙ্গে যারা এ কারিগরি শিক্ষা প্রদান করবেন, তারা হাতে-কলমে এ শিক্ষা প্রদানে সক্ষম কিনা সেই বিষয়টিও ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে যারা এ ধরনের শিক্ষাদান করবেন, তাদের এখন থেকেই বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। যদি অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করা হয় সেক্ষেত্রে আমাদের জিডিপির ১৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর। শিল্পায়নে এ হার ২৮ শতাংশ আর সার্ভিস সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে এটি ৫৬ শতাংশ। কৃষিনির্ভর কারিগরি দক্ষতা বাড়িয়ে এর মাধ্যমে গবেষকদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ধারণার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব।

    এর ফলে কৃষিক্ষেত্র হতে পারে কর্মমুখী শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১০ বছরে শিল্পায়নে জিডিপির হার হবে ৩৫ শতাংশ। তবে যদি কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ও প্রয়োগ যথাযথভাবে ঘটানো যায় তবে তা এ হারকেও ছাড়িয়ে যাবে। একটি কথা বলা হয়- আমরা অর্থনীতিতে ৪৬তম, কিন্তু কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে ১১৪তম।

    বিষয়টি নিয়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান সরকার অনেক বেশি কাজ করছে, যা আশাব্যঞ্জক। কারিগরি শিক্ষায় ইতিবাচক মনোভাব গড়ে না ওঠায় এক্ষেত্রেও শ্রেণীগত নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা কারিগরি শিক্ষাকে সেভাবে গ্রহণ করছে না। আর এর ফলে বেকারত্ব বাড়ছে ও সামাজিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হচ্ছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ৪৭ শতাংশ।

    অন্যদিকে ২৫-৫৪ বছর বয়সের ৮২ শতাংশ মানুষ কর্মে নিয়োজিত থাকলেও এর মধ্যে মাত্র ৬.৩ শতাংশ উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন, ৫৩ শতাংশ মাঝারি দক্ষ এবং ৪০.৭ শতাংশ অদক্ষ। অথচ উন্নত দেশে এ হার ২৫-৭৫ শতাংশ।

    তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে ৫টি টাস্কফোর্র্স গঠন করেছে যা হল- পলিসি ও প্রজেক্ট ফর্মুলেশন টাস্কফোর্স, ইন্ডাস্ট্রি ও ইন্সটিটিউট লিংকেজ টাস্কফোর্স, টিভিইটি এনরোলমেন্ট টাস্কফোর্স, কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট টাস্কফোর্স এবং জব মার্কেট অ্যাসেসমেন্ট ও এমপ্লয়মেন্ট টাস্কফোর্স। যদি এ মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি মানুষকে আগ্রহী করা যায় তবে এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে মানুষের কল্পনাশক্তি তার কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। এখানে প্রশ্ন হতে পারে, কেন কারিগরি শিক্ষায় চিন্তা ও কল্পনাশক্তির কথা বলা হচ্ছে?

    এর কারণ হল কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে অনেক মানুষের একই ধরনের কারিগরি জ্ঞান গড়ে উঠবে, কিন্তু পার্থক্য থাকবে শুধু চিন্তা ও কল্পনাশক্তির ক্ষেত্রে। কাজেই কেবল হাতে-কলমে শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে যন্ত্রচালিত রোবট বানালে চলবে না, বরং কীভাবে সে তার কারিগরি জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে চিন্তার বৈচিত্র্য ঘটাতে পারে সে বিষয়টিও ভাবতে হবে। শিক্ষার সব ক্ষেত্রেই কারিগরি দক্ষতাকে প্রাধান্য দিতে হবে।

    এখানে প্রশ্ন আসতে পারে- মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ এ ধরনের বিষয়গুলো কি থাকবে না? নাকি সময়ের পরিবর্তনে এগুলো যুগের চাহিদা হারিয়েছে? বিষয়টি এমন নয়। তবে আমাদের দেশে যে জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের এসব বিষয়ে জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানও থাকতে হবে। এর কারণ হল এ ধরনের বিষয়ে, বিশেষ করে আমাদের দেশে কাজের ক্ষেত্র কমে আসছে।

    কাজেই যারা এ বিষয়গুলো পড়ে আসছে, তাদের কাজের ক্ষেত্র কম থাকায় তারা যাতে বেকার হয়ে না থাকে সেজন্য এ বিষয়গুলোর সঙ্গে কারিগরি জ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এতে করে যেমন তাদের নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তেমনি তাদের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে। তার বিশেষায়িত জ্ঞান এক্ষেত্রে তাকে এগিয়ে নিতে পারে।

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের একটি মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এটিও কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিষয়টিকে অন্যভাবেও ভাবা যেতে পারে। যেমন, আমরা একটি বাড়ি ও একটি শিল্প-কারখানা- এ ধারণা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে প্রয়োগ করতে পারি। আমাদের দেশে মোট ৭ থেকে ৮ লাখ কুটির শিল্প রয়েছে।

    এ কুটির শিল্পগুলোকে আধুনিক ধারণায় এনে গ্রামের প্রত্যেক মানুষকে কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ করে গড়ে তোলা যেতে পারে। এর ফলে শিল্প ধারণা বাণিজ্যিক গণ্ডি পেরিয়ে সংস্কৃতিতে পরিণত হতে পারে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশের ১ শতাংশ লোক কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল। এখন তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

    আশা করা হচ্ছে, সরকারের কারিগরি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে এ হার ২০২০ সালে ২০ শতাংশ, ২০৩০ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে। উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম ভূমিকা রাখবে। আবার একইসঙ্গে নতুন নতুন শিল্প ধারণা সৃষ্টি করে সেই শিল্পে মানুষের দক্ষতা তৈরির মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে যুগোপযোগী করে এর বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব। আবার এর উৎকর্ষ, পরিবর্তন ও কারিগরি জ্ঞান থেকে অর্জিত ফলাফল যাচাইয়ের সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে। তা না হলে সব পরিকল্পনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।

    লেখক: শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

    /একে

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close