• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পদ্মজল

প্রকাশ:  ২৩ আগস্ট ২০১৭, ২০:২০ | আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০১৭, ২০:২৬
সুরাইয়া হেনা

(১) এতো বড় বাড়ি! বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গিয়েছিল রুপুর। সে রাতে টেরই পায়নি কখন এ বাড়িতে পৌঁছেছিল। মুর্ছা যাওয়ার আগ পর্যন্ত নিজের বাড়ির উঠোনেই ছিল ও। প্রিয় মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আঁধার নেমেছিলো ওর। পরে চোখ মেলতেই নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো বিশাল এক কক্ষে।

সম্পর্কিত খবর

    চকচকে গাঢ় বাদামী রংয়া কাঠের সুবিশাল খাট। একই কাঠের দামি সুন্দর আসবাবপত্রে ঠাসা কক্ষটা ওদের বাড়ির চেয়ে ঢের বড়। আশপাশে ওতো অপরিচিত মুখ দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল রুপু। কেমন অদ্ভুত লাগছিলো সব! যেনো অদ্ভুত সুন্দর কোনো স্বপ্ন দেখছে ও। যেনো সবসময়ের স্বপ্নগুলোর সেই রাজপুত্তুর হুট করেই ওকে তার রাজপ্রাসাদে তুলে এনেছে। ভাবতে ভাবতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছিলো যখন,তখন এক বুড়ি গায়ে হাত বুলিয়ে কেমন ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চেয়েছিল "এখন কেমন লাগে নতুন বউ? খাবা কিছু?"

    শুনে খিদেটা কেমন নড়েচড়ে উঠেছিলো পেটে! লজ্জায় একটা শব্দও বের হয়নি তখন ওর মুখ থেকে। মাথা নিচু করে গুটিসুটি দিয়ে বসে ছিলো শুধু। আর অপরিচিত সেই মানুষটার সাথে একলা! কীভাবে কেটে গেলো সেই রাতটা! তারপর নতুন বাড়ি,নতুন মানুষ আর নতুন পরিবেশ। অনুভুতিটা ঠিকঠাক বুঝেই উঠতে পারতো না যেনো রুপু। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই লজ্জা পেয়ে যেতো। মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে জবাব দিতো।

    (২) বাড়ির ছাদে বিকেলগুলো হেটে বেড়ায় রুপু। এতো বড় বাড়ি। হাতে গোনা চারটে মানুষ তারা। শ্বশুর,শ্বাশুরী, স্বামী আর ও। আর চারজন কাজের লোক আছে যদিও। এছাড়াও আরো কিছু মানুষ আসে এ বাড়িতে। মেয়ে মানুষ।

    রাতের মানুষ তারা। জোনাকের মতন।রাতে জ্বলজ্বলে,দিনে বিলীন। স্বামী,শ্বশুর ব্যস্ত থাকেন ব্যবসা,সম্পদ আর নারী সঙ্গ নিয়ে। শ্বাশুরী পড়ে থাকেন নিজের ঘরে। একা থাকতে ভালোবাসেন হয়তো। নাহয় এই একাকিত্বেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। প্রথম দিনগুলো কত সুন্দর ছিলো এ বাড়িতে! স্বামীর আদর,সোহাগে মুড়ে ছিলো ও। আর এখন! গুমোট লাগে রুপুর।

    একটা বড় বাড়ি, রুপালি জরি পাড়ের পদ্মরংয়া জমিনের একগাদা শাড়ি, রুপার চুড়ি, একজোড়া নুপুর আর ভারি একখানা চাবির গোছা। কত কী স্বপ্ন ছিলো! গায়ে সেই শাড়ি,হাত ভর্তি চুড়ি, আলতায় ডোবানো পায়ে নূপুর। মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা দুলিয়ে ঝনঝনিয়ে সারা বাড়ি দৌঁড়ে বেড়াবে।

    সকাল, দুপুর, রাত তিনবেলাই মুক্তো ডানার মত ঝকঝকে সাদা চালের চিকন ভাত, মাছ,মাংস,পাটের ডাল সহ কত রকম তরকারি পাতে উঠবে। দুদিন পর পরই বাবা,মা আর ভাই দুটোকে দাওয়াত করবে এটাওটা বাহানায়। পেট ভরে খাবে ওরাও। তারপর যাবার সময় পোঁটলাপুটলি বেঁধে একগাদা খাবার দিয়ে পাঠাবে। কত সুখে থাকবে তখন ওরা।

    সুখ! এসব সুখ মেলে? কত বোকাই না ছিলো আগে!

    ছোট্ট ভাঙ্গা ঘরটা,বৃষ্টিতে পাতিল হাতে রাতজাগা,ঝড়ে ভয়ে কুঁকড়ে একে অন্যকে জাপটে প্রার্থনা করা,দুবেলা খেয়ে আরেক বেলা পেট চেপে ঘুমিয়ে পড়াতেও কত সুখ ছিলো তখন! মায়ের আদরে মাথায় হাত বুলানো,বাবার থুতনি ছুঁয়ে তার হাতে চুমু খাওয়া, ভাইদের দুটো চিংড়ি ধরে দিদির হাতে দেয়ার আনন্দ। তারপর সেই চিংড়ি একগাদা পুঁই আর হেচি শাঁকের ভেতর হারিয়ে গেলেও স্বাদ ছিলো। এখন বড় বড় রুইয়ের টুকরোগুলোও কেমন অখাদ্য লাগে। গলা বেয়ে নিচে নামতে চায় না,বরং বেরিয়ে আসতে চায় গরগর করে।

    (৩) ছাদের দক্ষিণ দিকটা বেশিই ভালোলাগে রুপুর। শুধু যে দক্ষিণা বাতাসের জন্য,তা না। দক্ষিণ দিকটায় তাকালেই চোখে পড়ে বিশাল এক দীঘি। এ গাঁয়ে তার নাম পদ্মদীঘি। এই বিশাল বাড়ির বিশালতা ছোট্ট হয়ে আসে এই দীঘির সামনে। দিঘীর চারপাশ ঘেরা গাঢ় পদ্ম সবুজ পাতার কোল ঘেঁষে চেয়ে থাকে। টলটলে জলে পদ্মগুলো কেমন নিষ্পাপ লাগে। দৌড়ে গিয়ে ওই জলে ডুব লাগাতে ইচ্ছে করে রুপুর। টুপ করে তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে গভীরে।

    চকমকে শাড়িটা গায়ে কেমন অস্বস্তি নিয়ে সেঁটে থাকে। ওটা খুলে পুরনো ছেড়া কামিজগুলো পড়তে ইচ্ছে করে ওর। উল্কি লতা মিলিয়ে রূপোর উপর ঝকমকে পাথর বসানো গহনাগুলো খুলে মায়ের মন্দির থেকে এনে দেয়া সুতোটা বাঁধতে ইচ্ছে করে। বুকটা ভারি লাগে রুপুর। ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুড়ে দৌঁড়ে এ বাড়ির গন্ডি পেরুক। দক্ষিণের পথ ধরে দৌঁড়ে চলে যাক পদ্মদীঘির পাড়টায়। তারপর নাহয় হড়বড়িয়ে নেমে যাবে জলে। ডুবের পর ডুব দিয়ে যখন খুব ক্লান্ত হয়ে যাবে তখন পড়ে রইবে দীঘির সিঁড়িবাধানো ঘাটলায়।

    সূর্যটা তাড়া দেয় লুকাতে। পাখির ঝাঁক উড়ে যায়। রুপু আঁচল সিঁড়িতে মেলে দিয়ে চুল হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে রুনঝুনিয়ে নেমে যায় নিচের তলার দিকে।

    (৪) ঘুম হয়না রত্নারাণীর। ছেলেটা একদম বাপের মতন হয়েছে। অমানুষ। নিজের কপালটাকে দোষারোপ করেন তিনি সবসময়ই। রুপু মেয়েটার জন্য বেশ মায়া হয় তার। ওমন চাঁদের মতন মেয়েটা! তাকে ফেলে! ভাবতেই অপরাধবোধ জাগে তার। ভেবেছিলেন ছেলেটা ভালো হবে,হলো না। উপর থেকে মেয়েটাকে এমন কষ্টে ফেলে দিলেন তিনি। এ কষ্টটাকে এতো বছর যাবৎ সহ্য করেছেন তিনি। জানেন কতটা ভয়াবহ এ কষ্ট। বোঝেন কেমন অনুভব করে মেয়েটা।

    বারান্দায় দাঁড়িয়ে পদ্মদীঘির জল দেখেন তিনি। কেমন স্বচ্ছ টলমলে জল! ছুটে যেতে ইচ্ছে করে তার দীঘিরপাড়ে। তলিয়ে যেতে ইচ্ছে করে গভীরে।

    (৫) রুপু আয়নায় খুব ভালো করে দেখে নিজেকে। হালকা লাগে নিজেকে ওর। দেহজুড়ে চোখ ধাঁধানো গহনা নেই। শুধু রুপোলী পাড়ের পদ্ম রংয়া শাড়ি। কাজলহীন টানা ফ্যাঁকাসে চোখ,গোলাপের শুকনো পাপড়ির মতন ঠোঁট,সাদা-হলদে গায়ের রং। দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া মুখেও কতটা সুশ্রী লাগছে! এই রূপই তো এমন বড় বাড়িতে ঠাই দিলো। শরীরে টকটকে মারের দাগগুলোও ওই রূপ আরাল করতে পারেনা।

    শেষবার নিজেকে আরো ভালো করে দেখে নেয় রুপু আয়নায়। মাইকে নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যায়। ও মাথায় মসজিদ আছে একটা। মোয়াজ্জেম নিশ্চয়ই তৈরি আযানের সুর তুলতে। মানুষজন জাগতে শুরু করবে। পূজোর থালাটার দিকে তাকায় রুপু। নেভা প্রদীপ আর শুকনো ফুলে ঠাসা। দীর্ঘশ্বাস ভেতর থেকে ওঠে এসে গলার কাছটায় আটকে থাকে ওর। নূপুর জোড়া খুলে রেখে নিঃশব্দে বেড়িয়ে পড়ে ও......

    (৬) রত্নারানী সারাবাড়ি খুঁজে খুঁজে অস্থির হয়ে ওঠেন। রুপু তাকে না বলে ছাদে পর্যন্ত যায় না কখনো। সকাল থেকে দেখেননি মেয়েটাকে সে। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েন উঠনটায়। শিউলী গাছের তলায় একগাদা শিউলী ঝরে পড়ে থাকলেও জায়গাটা ফাঁকা লাগে। আলপনায় ভরা কলস জোড়া খুব প্রিয় ছিলো তার। গতরাতেও পদ্মদীঘির কথা মনে পড়তেই প্রদীপের আলো ফেলে দেখেছিল ওই দুটোকে! আজ, কেমন ফাঁকা জায়গাটা! হুট করেই ফাঁকা হয়ে যায় তার ভেতরটাও, মাথায় হাত চেপে ঠুকরে কেঁদে ওঠেন সে।

    পদ্মাদীঘির পাড় জুড়ে সারা গাঁয়ের মানুষের ভিড়। সাদা-হলদে রংয়ের একটা শরীর দীঘিতে। তাতে ঝকঝকে রুপালী পাড়ের পদ্ম রংয়া জমিনের শাড়ি জড়ানো। কেউ কেউ ছুটে আসছে সামনের পথ ধরে। খবরটা কিছুক্ষণে নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে এ বাড়ির বিশাল উঠোনে।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close