• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পুলিশ ভুল করলে বিভাগ তাকে ছাড় দেয় না, কিন্ত সাংবাদিকদের!

প্রকাশ:  ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১০:৫৭ | আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৪৯
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান

ট্রাফিক পুলিশ ভাই, আপনি যখন রাস্তায়, তখন প্রতিদিন একবার মা-বাবার দোয়া আর বউয়ের কাছে মাফ চেয়ে আসুন। ... আর মনকে বলুন, রেগে যাসনে . আমি তখন রমনা ট্রাফিক জোনে। হাইকোর্টের সামনে দাঁড়ানো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যাবেন সচিবালয়। সপ্তাহে তিনি দুইবার সচিবালয় আসেন। সেদিন দুইটার সময় সচিবালয় আসার কথা ছিল। আমরা সবাই ডিউটিতে। হঠাত সংবাদ এলো, তিনি ৪ টায় আসবেন।

এবার দেখুন আমাদের কি অবস্থা তখন? যাদের দুইটায় ডিউটি শেষ হবার কথা ছিল, এদেরকে অতিরিক্ত ডিউটি হিসেবে রাখা হল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলে গেলে এ পার্টি চলে যাবে। কিন্তু হলো না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। দুপুরে খাওয়ার সময় পিছিয়ে গেল ৪ টার পর!

সম্পর্কিত খবর

    যাক আসল কথায় আসি, চারটার কাছাকাছি। লাইন ক্লিয়ার দেয়া হল। সবাই আমরা এলার্ট। এমন সময় রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। একজন সাংবাদিক আসলেন উল্টো রাস্তায় মটর সাইকেল দিয়ে। দোয়েল চত্বর দিয়ে এসে হাইকোর্টের সামনে তিনি। সিনিয়র সাংবাদিক তিনি। সাংবাদিক সমিতি রিপোর্টারস ইউনিটের ভাল পদে আছেন। আমার সার্জেন্ট তাকে ওখানে আটকালেন। বললেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুভমেন্ট আছে, যেতে পারবেন না। তিনি শুনতে রাজি নন। তাকে যেতে দিতে হবে।

    আমাকে ওয়ার্লেসে কল করলেন। আমি সেখানে গেলাম। আমিও বললাম, ভাই একটু পর। তিনি বললেন, সার্জেন্ট তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন, তার বিচার চাই! আমি তাকে বললাম, ওকে, বক্সের সামনে আসুন। (বক্স হচ্ছে, চৌরাস্তার মাঝে ছোট আইল্যান্ডে।) আমি দেখছি ব্যাপারটি। এই বলে আমি রাস্তায় প্রধানমন্ত্রীকে পাস দিতে চলে আসলাম।

    মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সচিবালয় ঢুকলেন। আমি বক্সে আসলাম। আসার পর সাংবাদিক সাহেব অনেকগুলো অভিযোগ করলেন, তার সময় নষ্ট করেছি, তার মিটিং ছিল, মিটিং নষ্ট করেছি। তাকে অপমান করেছি, তাকে এখানে আটক করে রাখা হয়েছে। এইসব শুনে আমি পুরো অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। বললাম, আমি কীভাবে করলাম এইসব? তিনি বললেন, হে করেছেন? বললাম, সার্জেন্ট অপমান করেছে, আপনি তো তার বিচার চাইলেন। বললেন, আপনি আমাকে আটক করে চলে গেলেন। আমি বললাম, সরি, কি করব এখন বলেন, বিচার চান না? পাশে দাঁড়ানো সার্জেন্ট বললেন, স্যার আমার কি অন্যায়! সেতো উল্টো এসেছে।

    সাংবাদিক সাহেব রেগে গেলেন। বললেন, এ জন্য আপনি মামলা দিতে পারেন, আমাকেতো আটকিয়ে রাখতে পারেন না! আমি ওনার অভিযোগের আগামাথা না দেখে সার্জেন্টকে বললাম, তুমি ওল্টো রাস্তায় আসার মামলা দিয়ে দাও। সার্জেন্ট মামলা দিলেন। তাতে তিনি আরো রেগে গেলেন, মোবাইল ফোনে সম্ভবত রিপোর্টারস ইউনিটের কাউকে বললেন, তাকে পুলিশ আটক করে রেখেছে! মুহূর্তে ৩০/৪০ জন সাংবাদিক চলে আসলেন। সম্ভবত আইজিপি স্যারকে ফোন দিয়ে বললেন, তাকে আটক করে রাখা হয়েছে। স্যার এআইজি মিডিয়া স্যারকে পাঠালেন। এদিকে ডিসি ট্রাফিক স্যারসহ সিনিয়র স্যাররাও জানতে চাচ্ছেন, কি হয়েছে সাংবাদিকের সাথে ?

    একটা কেমন পরিবেশ যেন হয়ে গেল মুহূর্তে! সাংবাদিকদের অনেকে আমাকে চিনেন। তারা বললেন, ভাই আপনি থাকতে এরকম একটা ঘটনা ঘটল!আমি মুহূর্তটি অনুভব করলাম। ওই সাংবাদিকের কাছে গিয়ে বললাম, আপনি কি চান?তিনি বললেন, দুই সার্জন্টকে এখান থেকে সরাতে হবে। এরা খুবই অন্যায় করেছেন। আর মামলা তুলে নিতে হবে। আমি বললাম, ওরা কোন অন্যায় করেনি। আমি পুরো সময়টা তাদের কাজকর্ম দেখেছি।

    তিনি বললেন, তাহলে সামলান ব্যাপারটা! পাশে থাকা অন্য সাংবাদিকরাও চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমি দেখলাম, বিষয়টা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওনার হাত থেকে আমি মামলার কাগজটি নিলাম। আমার ডিসি স্যারের সাথে কথা বললাম, স্যার বললেন, সার্জেন্টদের সরিয়ে দাও।সকল সাংবাদিকরা রেগে আছেন। যে যার মতো কথা বলছেন। ফটো সাংবাদিকরা ছবি তুলেই যাচ্ছেন। আমি খুব করে সকল সাংবাদিকেদের কাছে সরি বললাম। বললাম, ভুল হয়ে গেছে!

    দুইজন সার্জেন্ট ক্লোজড হলেন সেদিন। ক্লোজড হলেও সিনিয়র স্যারদের বুঝিয়ে ওদের কোন ক্ষতি হতে দেইনি। (সে যে উল্টো পথে এসেছে, তার ছবি দূর থেকে তুলে রাখা হয়েছে, আমি একটা ক্যামেরা রেখে দিতাম। এরকম অবস্থায় যেন গোপনে ছবি তুলে রাখা যায়। এ ছবি প্রমাণ হিসেবে রাখা হতো।) আর মামলার কপি আমি নিয়ে এসে আমার পকেট থেকে ৫০০ টাকা জরিমানা দিয়েছি।

    এটা কেউ জানতো না। জানাইনি কখনও কাউকে। টাকা জমার কপিটা আজও আছে আমার কাছে। সেদিন বিষয়টা সমাধা হয়েছে। এটাই আমার প্রাপ্তি।এখন মিন্টু রোডে উল্টো আসার জন্য মামলা দেয়া হয়। কি সচিব আর কি পুলিশ অফিসার! আমার সময় এটা খুব পারতাম না, যাকে মামলা দিতে পারতাম না, তার ছবি উঠিয়ে মন্ত্রণালয়ে বা সংশ্লিষ্ঠ উইনিটে পাঠিয়ে দিতাম।

    আইনের প্রতি মানুষের রেসপেক্ট থাকা উচিত। আইন মানলে দেশপ্রেম মানা হয়। এটা আমার সব সময় মনে হয়। দুইজন সার্জেন্টকে ক্লোজড করা আর আমার ৫০০ টাকা গচ্ছা দেয়া ছিল একটা সমাধান। কিন্তু একজন সাংবাদিকের আইনকে রেসপেক্ট না করার ফল। যা আমাকে মেনে নিতে হল।

    (গত দুইদিন ধরে মিডিয়ায় একজন সার্জেন্ট ক্যামেরা কেড়ে নিয়েছে বলে যে প্রচার হয়েছে, তার আগে সার্জেন্ট তাকে মামলা দিয়েছে, হ্যালম্যাট না থাকার জন্য। আর তাতে সে রেগে ওয়ারলেসের তার ছিড়ে ফেলতে চেয়েছে এবং ছবি তুলেছে। তখন সার্জেন্টও ক্যামেরা টেনে নিতে চেয়েছেন।)

    যা না বললে নয়, এটা সাংবাদিককে ছোট করার জন্য নয়। ভুল পুলিশের যেমন হয়, সাংবাদিকদেরও হয়। তবে পুলিশের ভুল হলে, বিভাগ তাকে ছাড় দেয় না। এর জবাব দিতে বহু জুতা ক্ষয় করতে হয়। সাংবাদিকদের হয় কিনা জানি না!

    লেখক: অতিরিক্ত পুলিশ সুপার

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close