• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জার্নি সাত

প্রকাশ:  ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ০৩:২৬ | আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:১৬
লুতফুন নাহার লতা

হঠাত করেই ব্যাংকের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। নানা রকম দুশ্চিন্তায় আমার মাথার যেমন ঠিক নেই আবার সময়ের সাথেও আর পারছিলাম না। খুব সকালে উঠে নিজে রেডি হয়ে ছেলেকে রেডি করি। ওর স্কুলের ব্যাগে বইখাতা চেক করে ঢুকিয়ে রাখি আগের রাতেই। ছোট একটা আপেল জুসের প্যাকেট, হালকা কিছু স্ন্যাকস সকালে দিয়ে দেই। দ্রুত হাতে ওকে নাস্তা খাইয়ে দৌড়ে নীচে নামি। রাস্তার মোড়ে ওকে পৌঁছে দিয়ে আমি ছুটি গাড়ী নিয়ে আমার কাজের পথে। ও হেঁটে হেঁটে দুই ব্লক দূরে ওর স্কুলে ঢুকে যায়। এমনি করে প্রতি সকালেই ঐ রাস্তার মোড়ে এসে ওর আর আমার পথ যায় বেঁকে।

প্রতিদিন কাজের শেষে বাজার করে নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়, বিশেষ করে শীতের দিনে যখন বিকেল চারটায় চারিদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ক্লান্তিতে পা ভেঙে আসে, মন থুবড়ে পড়ে শীতার্ত অন্ধকারে। কোনো কিছু দিয়েই সেই মনকে আর ভাল করে তুলতে পারি না।

সম্পর্কিত খবর

    দিনের শেষে ঘরে ফিরে রান্না, খাওয়া , গোসল, ধোয়ামাজা , ছেলের হোমওয়ার্ক চেক সব শেষ হলে ঘরের বাতী নিবিয়ে শুয়ে পড়ি। বুকের ভেতর নরম কোমল ছোট্ট শরীরটা ঘুমে গলে পড়তে থাকে। ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে চোখ বুজে থাকি তবু ঘুম আসে না। রাত যখন থম ধরে থাকে, যখন নিশুতি হয় তখন মন জেগে ওঠে। তোলপাড় করে সে রিওয়াইন্ড করতে থাকে ঘটে যাওয়া ঘটনাচক্র একের পর এক। ভয়ানক সেই সব দুঃস্বপ্নের বুলেট পুনরায় অবশ করে দেয় সকল তন্ত্রী। অন্যায়, অবিবেচনা, সরল বিশ্বাস ভেঙ্গে যাবার কষ্ট, অসম্মান, রোদন , মর্মে মর্মে পীড়া দেয়। আলতো করে বিছানা ছেড়ে বাকী রাত ঘরময় পায়চারি করি আর একা একা গুন গুন করি। সেই গুনগুনানি কখন বাঙময় হয়ে গান হয়ে যায়। সেই গান আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদে।

    এমনি দিনের পরে দিন চলতে চলতে হঠাত একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে হাসপাতাল এমার্জেন্সিতে যেতে হল। তারপর কতগুলো দিন শুধু ডাক্তার , এক্সরে , এম আর আই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে উঠি। পেটের ব্যাথায় পাগল হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করছি। এ ডাক্তার সে ডাক্তার করে অবশেষে দেখা হল নর্থশোর ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ডাক্তার ইয়েহুদা বার্জভি'র সাথে। ভাল করে চেকাপ করে, সব রকম রিপোর্ট টিপোর্ট দেখে ডাক্তারের মুখ থমথমে হল। অতি সত্বর অপারেশান করতে বললেন। এর আগের ডাক্তারও একথাই বলেছিলেন।

    দিন যায় উদাস মলিন ঝরাপাতার মত চেয়ে থাকি আকাশের দিকে। আকাশে কী অথৈ নীল! সেই নীলের দিকে চেয়ে ভাবি, কি সিদ্ধান্ত নেব! অপারেশান করতে গিয়ে যদি আর না ফিরি, যদি এনেস্থেসিয়া না কাটে আর তবে! তবে! কি হবে আমার সিদ্ধার্থের! কার কাছে রেখে যাব ওকে! মলিন মুখে ঘুরে বেড়াই কাউকে কিছু বলিনা। আকাশের নীল চাঁদোয়া আমাকে আড়াল করে রাখে।

    ডাক্তারের অফিস থেকে কিছুদিন পরে পুনরায় ডাক পড়ে। অপারেশানের জন্য দিন ঠিক হল মধ্য জুলাইতে। সিদ্ধার্থের সামার ভ্যেকেশানে স্কুল বন্ধ হবে আর দু'এক দিনের মধ্যেই , ফলে সেটাই সঠিক সময়। ডাক্তার পূর্বপ্রস্তুতি নিতে বলেন। আমি রোজ খুলনায় মার সাথে কথা বলি তবুও মাকে সে কথা জানাই না । কি লাভ! এতো দূর থেকে কেবল কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবেন, তার চেয়ে কিছু না বলাই ভাল।

    নানা রকম পরীক্ষার জন্যে রক্ত টক্ত দিয়ে সেদিন বাসায় ফিরলাম। ক'দিন ধরে উঠে দাড়ালেই মাথা ঝিম ঝিম করে। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছি তবু নিত্যনৈমিত্তিক জীবন তো থেমে থাকছে না। হঠাত আবার ডাক্তারের অফিস থেকে ডাক । ক্লান্ত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাকে বসতে বলে ডাক্তার নিজে উঠে গিয়ে আমার রিপোর্ট গুলো হাতে নিয়ে ফিরে এলেন। অপারেশানের আগে নানা রকম রক্ত পরীক্ষা করা নিয়ম। রক্ত দিয়ে গেছি ক'দিন আগেই তার ভেতর থেকে একটি পরীক্ষায় আমি ফেল করেছি। আমার রক্তে CA-125 এলিভেটেড। আমি এর মানে জানিনা। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে সে স্থীর চেয়ে রইল। আমার ক্যানসার!

    সি এ মানে হল সংক্ষেপে ক্যান্সার । ১২৫ কিছু একটা বিষেশ ক্যাটাগরি হবে বোধ হয়। হঠাত মনে হল সেই কবেকার কথা! ১৯৭৭ সালে বাবার যখন খুব অসুখ তখন তাঁর অফিস থেকে ছুটি বাড়াবার জন্যে যখন খুলনার ডাক্তার আব্দুল্লাহ হারুনের কাছ থেকে অসুখের বিবরন সম্বলিত চিঠি আনতে যাই, সেই চিঠিটিতে লেখাছিল সি এ ব্রংকাইটিস। যাতে মেডিকেল টার্মটি অফিসের কর্মকর্তাদের বুঝতে সুবিধে হয় সেজন্যে ব্রাকেটে লেখা ছিল 'ক্যান্সার ব্রংকাইটিস ' বাবাকে চিঠি এনে দিলে সেই প্রথম তিনি জেনেছিলেন, আঁতকে উঠে অস্ফুট উচ্চারনে বলেছিলেন ' আমার ক্যান্সার!'

    একবার উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়লাম। ডাক্তার বলছে অপারেশানের পর বায়াপসি করে তবে কনফার্ম করবে, ভয় পাবার কিছু নেই। এটা সেটা কত কি। আমার কান দিয়ে কিছু শুনছি, কিছু শুনছি না। ঠিক কিভাবে কেমন করে ঘরে ফিরেছিলাম আজ সে সব কথা ধুসর হয়ে গেছে, মনে পড়ে কি পড়ে না। কেবল মনে পড়ে ঘরে ফিরে সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম। যেনো এইই আমার চির কালের শেষ জড়িয়ে ধরা। এই বুঝি শেষবার শেষ বিকেলের আলোয় সন্তানের প্রিয়তম মুখ দেখে নেয়া।

    দু'দিন স্তব্ধ অন্ধকারে কেটে গেল। এপার্ট্মেন্টের দরজা খুলিনি। ছেলেকে সাথে নিয়ে হাতে হাত ধরে নিজে প্রস্তুতি নিয়েছি আর এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে মোকাবেলা করার জন্যে ছেলেকে স্থির চোখে নির্দেশ দিয়েছি। সিদ্ধার্থ জন্ম থেকেই মায়ের একান্ত বাধ্যগত ছেলে। অসুখ বা অ-সুখ দুটোই বোঝার মত বয়সটা তার যদিও কম, তবু আমার সব কথা শুনে স্থির চোখে চেয়ে থেকে সাহসী বীরের মত সে বলেছে 'মা তুমি যাও আমি পারব। ভয় পেও না মা।'

    দম বন্ধ করা স্তব্ধতা নিয়ে আছি, আমার মনের ভেতর চলেছে মহাপ্রলয়। কাল অপারেশান। খুলনায় মাকে ফোন করে তাঁর কন্ঠস্বর চুমুক দিয়ে পান করছি! সে তো কিছুই জানবে না যদি আমি আর কোনোদিন ফিরে না আসি তাঁর কাছে। হয়ত এই আমার শেষ বারের মত কথা বলা। মাকে এটা সেটা বলে বলে হাসছি , আমি দেশ ছেড়ে আসার পর মা কোনদিন না কেঁদে কথা বলতে পারেননি , আজ কিন্তু মা বেশ হাসি খুশী, অনেক কথা বললেন। নিজের মনকে বলছি আমি তো অভিনয় করি! আজ আমার অভিনয় জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। আমার তৃষ্ণার্ত প্রাণে গুমরে মরা ক্রন্দন চেপে চেপে মা কে বলছি ' মা ভালো থেকো । আমি না আসা পর্যন্ত বেঁচে থেকো আর এমন দোয়া করবে যেনো আকাশ ভেঙে আল্লাহ নিজে নেমে এসে আমার সিদ্ধার্থকে দেখে রাখে।' মা কত গান , কত কবিতা পড়ে আমার মন ভালো করে দিলেন।

    ক'দিন ধরে কেবল একটি নাম সবার আগে সামনে এসে দাড়াচ্ছে , সেই একটি নাম্বারে আমার গভীর গোপন বেদনার ক্ষত একপাশে সরিয়ে রেখে শতবার কল দিয়েও পাচ্ছি না। আমার কিছু হলে সিদ্ধার্থকে যেন ফস্টার হোমে যেতে না হয় শুধু সেই একটি আবেদন অন্তরের কোনায় কোনায় ঘুরে মরছে! আমাদের বন্ধু বড় ভাই সাংবাদিক আমানুদ্দৌলার সাথে তাঁর সর্বশেষ যোগাযোগ থাকার কথা জেনে আমান ভাইকে কল করে জানালাম। আমি, সিদ্ধার্থ ছাড়া কেবল আমান ভাই জানলো সব। কিন্তু কিছুই করার রইল না, যাকে জীবন মরনের সকল আকুলতা নিয়ে খুঁজছি, সিদ্ধার্থকে তাঁর কাছে দিয়ে যাব বলে, সে এখন তার নতুন আবিষ্কার সাথে নিয়ে হাওয়াইতে।

    খুব ভোরে ঘুম ভেঙে বুক ধড়ফড় করে উঠে বসি। আজ আমার অপারেশান। আধো অন্ধকারে পাশে ঘুমিয়ে থাকা সিদ্ধার্থের মুখের দিকে চেয়ে থাকি। নিজেকে জগতের সবচেয়ে বড় কাঙাল এক মা বলে মনে হয়। দু'গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে টুপ টুপ করে ঝরে সিদ্ধার্থের গায়ের পরে। ওর গানের স্কুলের বন্ধু রূপাই, পাপাইয়ের মা জলি ওকে রাখতে রাজি হয়েছে। যে কটা দিন হাসপাতালে আমার সুস্থ হতে লাগবে সেই কটা দিন সিদ্ধার্থ থাকবে ব্রুকলিনে, জলির বাসায়।

    সিদ্ধার্থ পাশ ফিরে শোয়। বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াই সাততলার এই এপার্ট্মেন্টের বসার ঘরের জানালায়! আজো আকাশ ঘন নীল। কোথাও কোন মেঘ নেই। পূবের আকাশ ঝিলমিলিয়ে উঠছে আলোয় আলোয়। সে আলোর দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে ফেলি। আজ খুব ইচ্ছে করছে এই আলোর মত হেসে উঠতে।

    ভয়কে আমার জয় করাটা খুব জরুরী! আমি আশাবাদী মানুষ, জীবনের কোথাও কেউ আমাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি মানুষের সব চেয়ে বড় সম্পদ হল তাঁর স্বাধীনতা। মন প্রান আত্মার স্বাধীনতা। চলার , বলার স্বাধীনতা, সবচেয়ে বড় হল নিজের মত করে বাঁচবার স্বাধীনতা।

    আমিতো তাই ই চেয়েছি! সারা জীবন নিজের মত করে মাথা তুলে বাঁচতে চেয়েছি! সবাইকে ভালোবেসে, সবাইকে নিয়ে, সবার প্রানে মমতার স্পর্শ ছড়িয়ে দিয়ে বাঁচতে চেয়েছি। আত্মশক্তিকে সম্মান করেছি। আজ আমার ভয় পাওয়ার মত দীনতা বড্ড বেমানান লাগছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে সরে আসি জানালা থেকে, শাওয়ার ছেড়ে জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদি। ঝর্নার জলে আর চোখের জলে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে তৈরি হয়ে নিলাম। সিদ্ধার্থকে ডেকে উঠিয়ে নিয়ে গোসল করিয়ে সকালের নাস্তা সামনে দিয়ে চুপচাপ বসে আছি। কথা বলছে না সিদ্ধার্থও। হয়তো আজ সে একটু ভয় পাচ্ছে। স্তব্ধতা নিয়ে আছে।

    কালরাতে সিদ্ধার্থের জন্যে ওর স্কুল ব্যাকপ্যাকে কিছু কাপড়চোপড়, ছোট্ট একটা লোশন,ছেলেটা ক'দিন ধরে খুক খুক করে কাশছে বলে এক প্যাক কফড্রপ লজেন্স, আর ওর খেলার প্লেস্টেশানটা গুছিয়ে দরজার কাছে এনে রেখেছি তার পাশে আমার হাসপাতালের ব্যাগটাও এনে রাখি। পুরোন চাদর গুলো দিয়ে বসার ঘরের সোফা,এন্টিক চেয়ার, ছোট্ট ডিভান বিছানা পত্র সব ঢেকে দেই । জানালা গুলো সব একে একে বন্ধ করে কিচেনের চুলার গ্যাস লাইনের নবে হাত দিয়ে টাইট করে বন্ধ করে দেই। ক'দিন আগে এক ছোটভাই মিঠুকে অনুরোধ করেছিলাম সিদ্ধার্থকে ব্রুকলিনে জলি'র বাসায় একটু নামিয়ে দিতে। সময় মত সেও এসে গেছে বাসার সামনে। নীচে থেকে কল করে বলল ' আপা আপনাদেরকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে যেতে হবে তাড়াতাড়ি, ইউ এস ওপেন চলছে শেয়া স্টেডিয়ামে, সেখানে। মিঠু খেলাধুলার সাথে সম্পৃক্ত ছেলে, ভলান্টিয়ার হিসেবে ইউ এস ওপেন এ তার ডাক পড়েছে। মিঠুর ফোন নামিয়ে রেখে নিজের অজান্তেই শেষ মুহুর্তেও হাত চলে যায় চির পরিচিত সেই ফোনের নাম্বারে, না! সে ফোন কেউ পিকাপ করেনা। সে ফোনের মালিক মৃত আমাদের কাছে। আজ জীবন মরনের সীমানায় দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে জানলাম। সিদ্ধার্থ একদিন বলেছিল ' মা, বাবা ইজ ডেড টু মি। ফিজিক্যালি হি মে বি এলাইভ, বাট হিজ স্পিরিট ইজ ডেড!'

    সিদ্ধার্থের কাঁধে ওর স্কুল ব্যাকপ্যাক। আমার হাতে হাসপাতালের ব্যাগ । ঘরের দরজা বন্ধ করার আগে একটু দাঁড়ালাম, চোখ বন্ধ করে দোয়া ইউনুস পড়ে তিনবার ফু' দিলাম ছেলের মাথায়। ঘরের দিকে তাকিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দিলাম আরো তিনটি ফু! হাত থেকে ব্যাগ ট্যাগ ছেড়ে দিয়ে সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে ধরলাম আমার ব্যাগ্র দু' বাহু দিয়ে। বুকের সাথে যতটা শক্ত করে ধরে রাখা যায় ওকে। যতক্ষন পারি ওর ছোট্ট ধুকধুকুনি টুকু অনুভব করতে করতে কানে কানে বললাম' ভয় পেও না বাবা! আমি ভালো হয়ে যাব। তোমাকে ছেড়ে মা কোথাও যাবে না বাবা! আবার আমরা এক সাথে অনেক আনন্দে থাকব। দুই গালে , দুই চোখে, কপালে আর ওর হাতের আঙুলে চুমু খেয়ে ঘর থেকে পা বাড়ালাম।

    আমাকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে মিঠু ওকে নিয়ে চলে গেল ব্রুকলিনে। যাবার সময় সিদ্ধার্থ ছল ছল চোখে গাড়ী থেকে চেয়ে রইল। সময় যেন ফাঁসির দড়ির মত গলার কাছে দলা পাকিয়ে ঝুলে রইল। আমি লিফট ধরে উপরে আসা মাত্রই নার্স দুজন ছুটে এলো কাছে, আমার দেরী দেখে হাসপাতাল তোলপাড় করে ফেলেছে ওরা। কয়েক মিনিটেই হাসপাতালের জামাটামা পরিয়ে একেবারে প্রস্তুত করে ফেলল। বারো ঘন্টা আগে থেকেই খাবার টাবার বন্ধ করা হয়েছে, ওটির সামনে এনে হুইল চেয়ারে বসিয়ে রাখল।

    নার্সের কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ চেয়ে নিয়ে দ্রুত হাতে একটি চিরকুট লিখে হাতে মুঠো করে ধরে রইলাম। অপারেশান টেবিলে শুইয়ে দিয়ে এনেস্থেশিয়া ইঞ্জেক্ট করার আগেই ডাক্তার কে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলাম। চিরকুটটি পড়ে ডাঃ ইয়েহুদা বার্জভি আমার কানের কাছে ঝুঁকে এসে বললেন ' আই এম ইওর ডক্টর, ইউ ক্যান ট্রাস্ট মি, আই উইল ডু মাই বেস্ট। হোয়াটেভার আই উড ডু ফর মাই মাদার, অর মাই ডটার আই উইল ডু দ্যাট ফর ইউ!

    দেড় ঘন্টার অপারেশান, প্রায় পাঁচ ঘন্টায় শেষ হল। স্পেশাল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এসেছেন অপারেশানের মাঝখানে, রক্ত মাংশ বায়াপসি করতে পাঠানো হয়েছে, রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করে, রিপোর্ট পেয়ে তারপরে অপারেশান শেষ করা হয়েছে। ওটি থেকে বের করে, রিকভারি রুমে রেখেছে বেশ কয়েক ঘন্টা। সেখান থেকে ইনটেনসিভ কেয়ারে এনেছে, এসবের কিছুই জানিনা আমি , কখন আমার জ্ঞান ফিরেছে মনে নেই , আমার কেউ নেই। আমার জন্যে কেউ আসেনি। অপারেশান থিয়েটারের দরজায় উদ্বিগ্ন হয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকেনি। ডাক্তারের সাথে কথা বলেনি কেউ। কেউ নেই আমার!

    কেমন করে কোথা থেকে দিন দুই কেটে গেছে কেউ জানেনা। ঘুমের অতলে থেকেছি কেবল। বাঁচা মরার মাঝখানে সেই সময় গুলো কেমন ছিল তা আর কোনদিন ভাবতেও পারিনি। কেবল মনে আছে জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার কানের কাছে মুখ এনে বলছে তোমার বায়াপসি রিপোর্ট খুব ভাল। তোমার ক্যান্সার নেই। সি এ ১২৫ এলিভেটেড ছিল ফাইব্রয়েডস বা এন্ডোমেট্রিওসিসের এর জন্যে। আর ভয় নেই। তুমি ভাল হয়ে যাবে।

    চোখ বন্ধ করে আবার তলিয়ে গেছি ঘুমের অতলে। পরদিন কিছুক্ষণ ঘুমে কিছুক্ষণ জেগে এভাবে কাটছে, গলায় হাতে পেটে চারিদিকে নল ফল লাগানো, অন্যেরা খেতে পারলেও আমার খাবারের মেন্যুতে কেবল স্যুপ। আমি তাও খেতে পারছি না। পরদিন আজম আর জাকারিয়া এলো আমাকে দেখতে। ওরা আমাকে ধরে উঠিয়ে বসালো, মাথার চুল আঁচড়ে জট ছাড়িয়ে দিল, আমার জন্যে আনা স্যুপ খাওয়াল, ওদেরকে বললাম পরদিন আমার জন্যে একটু জাউ রান্না করে আনতে। জাকারিয়া আমাকে খাওয়াবে ভেবে মহা কায়দা করে ঘি টি দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে আনল। ওসব তো কিছুতেই খেতে পারছি না আমি ! আবার পরদিন পানির জাউ রান্না করে এনে খাওয়াল ওরা।

    সকাল বিকেল রাউন্ডে আসেন ডাক্তার বার্জভি। কেবল রুগীর সামনে দেখা দিয়ে যাওয়া নয় চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন । নিজ হাতে গজ ,ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করে নতুন করে ব্যান্ডেজ দিয়ে , ব্লাড প্রেশার চেক করে , ওষুধের পরিমান বাড়ানো কমানো বা আমার কোনো অসুবিধা আছে কিনা জেনে সেই মত ব্যাবস্থা দিয়ে যান। প্রতিবারই হাসি মুখে দীপ জ্বেলে যান। তিনি চলে গেলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। ডাক্তার বার্জভি আমার জন্যে বিধাতার পাঠানো এক দেবদূত। তাঁর মমতাময় আচরন ক্ষণে ক্ষণে চোখে জল আনে। ডাক্তার তো নয় তিনি যেন আমার মুক্তির দূত। এ বিশ্বচরাচরে যখন কেউ ছিল না আমার পাশে, যখন আমি আর্ত , আমি পীড়িত ,আমি কৃষ্টালের মত ভেঙে চিনি গুড়ি হয়ে ঝরে পড়ছি, সেসময় পরম মমতায় আমাকে বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিজের উপরে। চিরকুটে তাঁকে লিখেছিলাম 'আই ডোন্ট হ্যাভ এনিওয়ান হিয়ার ইন দিস কান্ট্রি আদার দ্যান মাই টেন ইয়ার্স ওল্ড সান। ইউ আর মাই ডঃ, অনলি ইউ ক্যান মেক দ্যা রাইট ডিসিশান ফর মি। আই ট্রাস্ট ইউ। গড ফরবিডস ইফ আই ডাই, প্লিজ কল মাই মাদার ইন বাংলাদেশ এট দিস নাম্বার।' --- মনের সকল ভার ডাক্তার বার্জভিকে দিয়ে পরম ক্লান্তি নিয়ে সেদিন চোখ বন্ধ করেছিলাম ।

    জলিরা এলো পাঁচদিন পরে সিদ্ধার্থকে নিয়ে। আরো আগে ওরা আসতে চেয়েছিল, সিদ্ধার্থ আমাকে দেখে ভয় পাবে ভেবে না করেছিলাম। পাঁচদিন পরে মেশিন টেশিন নল টল আগের চেয়ে কিছু কমলেও সে একটু জড়সড় হয়েই কাছে এসে দাঁড়ালো। চোখ বড় বড় করে সব দেখতে দেখতে জোরে কেঁদে উঠল। 'ওরে আম্মুরে তোমার কি হইছেরে!' স্যালাইনের সুই ফোটানো হাতের পিঠে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে চোখ মুছতে থাকল কেবল। আমি চোখে চোখে হেসে বললাম ' কমরেড, বলেছিলাম না আমার কিচ্ছু হবে না! সিদ্ধার্থের বেদনামাখা হাসিটুকু আজো বুকের ভেতর তারার মত জেগে আছে।

    দিন দশেক পরে হাসপাতাল থেকে একটা ট্যাক্সি ডেকে নার্সরা মিলে উঠিয়ে দিল। একা একা ক্লান্ত পায়ে ধীরে এসে তালা খুলে আঁধার ঘেরা দুঃখী ঘরখানিতে ঢুকলাম। আসবার আগেই জলিদেরকে ফোনে জানিয়েছিলাম। ওরা ওদের কাজের পরে সন্ধ্যায় এসে সিদ্ধার্থকে নামিয়ে দিয়ে গেল। বন্ধু হিসেবে সেই সহানুভূতিটুকুর জন্যে আজীবন জলির প্রতি কৃতজ্ঞতা। বাসায় আসার পরে বড় বোনের মত অভিনেত্রী রেখা আহমেদ আর মনজুর আহমেদ দুজনেই এসেছেন মাঝে মাঝে। খাবার নিয়ে, ফল নিয়ে, লিকুইড এনার্জি ড্রিংক এনশিওর কিনে নিয়ে। তাঁদের কাছেও আমার অশুধিত ঋণ!

    এখনো ভালো করে দাঁড়াতে পারিনা , দূর্বলতায় মাথা চক্কর দিয়ে ফেলে দেয়। সিদ্ধার্থ হাত ধরে ধরে বাথরূমে নিয়ে যায়, মেখে ভাত খাইয়ে দেয়, আমার বাবার মত করে মোটা দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দেয়। তাকে বলি ঘর গরম করে জোরে গান বাঁজাতে, সে আমার কানের কাছে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সিডি বাজিয়ে দিয়ে প্লেস্টেশানে গেম খেলতে বসে। সুস্থ হয়ে উঠবার অপেক্ষায় সারাদিন সোফায় শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। দেখি আমার সাততলার বাসার জানালার কাঁচের উপরে মেপল শাখা সবুজ পাতা দুলিয়ে দুলিয়ে গান গায়, আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব, ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব ----

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close