হেরে যাওয়া কয়েকটি জীবনের গল্প...
প্রতিটি মৃত্যুই যন্ত্রণার, কষ্টের। আর তা যদি হয় আত্মহত্যা তবে যেন তা মেনে নেয়া সবচেয়ে কষ্টকর। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েই চলছে। সমান তালে বাংলাদেশেও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আত্মহত্যার ঘটনা।
প্রযুক্তির প্রসার, সামাজিকতার পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্ভরশীলতা, সহনশীলতা ও ধৈর্যের চর্চা কমে যাওয়া, পারিবারিক কলহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, প্রেমে বর্থ্যতা, মানসিক বিষণ্নতার কোন চিকিৎসা না পাওয়া, আর্থিক অনটনসহ নানা কারণে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার ঘটনা যেন বেড়েই চলছে। এমনই ০৪টি অপমৃত্যুর ঘটনা এখানের তুলে ধরে হলো-
সম্পর্কিত খবর
ঘটনা-০১: বিবাহ বিচ্ছেদ থেকে আত্মহত্যা
১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। গতবছর এই দিবসটির ঠিক একদিন আগে, ৯ সেপ্টেম্বর উদ্ধার করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহানের মরদেহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে তার শয়ন কক্ষের দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করা হয়। পারিবারিক কলহের জেরে ২০১২ সালে গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমেদ এবং একই বিভাগের শিক্ষিকা আকতার জাহান জলির মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। ২০১৬ সালে তানভীর আহমেদ ওই বিভাগের আরেকজন শিক্ষককে বিয়ে করেন।
ধারণা করা হয়, আকতার জাহান জলি বিবাহ বিচ্ছেদ হলেও তার স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহটি মানসিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। আকতার জাহান নিজেকে শেষ করার কিছুদিন আগে পড়াশোনার জন্য তার একমাত্র ছেলে আয়মান সোয়াদকে ঢাকায় নানা-নানীর বাসায় পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি শিক্ষক কোয়ার্টার ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে ওঠেন।
০৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে আইমান মুঠোফোনে তার মাকে না পেয়ে অন্য শিক্ষকদের কাছে খোঁজ নিতে শুরু করেন। সহকর্মী শিক্ষকরা আখতার জাহানের খবর নিতে জুবেরী ভবনে গিয়ে ভেতর থেকে তার কক্ষের দরজা বন্ধ দেখতে পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও বিভাগের শিক্ষকদের খবর দেয়ার পর পুলিশের উপস্থিতিতে বিকেলে দরজা ভেঙে আকতার জাহানকে উদ্ধার করা হয়।
এ সময় ঘরের ভেতরে মশারির মধ্যে তিনি শুয়ে ছিলেন। মুখের দুইপাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছিল তার। দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি আর নেই। নিজেকে শেষ করে দেয়া আক্তার জানানের কক্ষ থেকে উদ্ধার হয় একটি সুইসাইড নোট এবং একটি কীটনাশকের বোতল।
মৃত্যুর আগে তিনি সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি এই পথ বেছে নিলাম। সোয়াদকে যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা নিজের সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে সে যে কোনো সময় সন্তানকে মেরেও ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।’
ঘটনা-০২: প্রযুক্তি আসক্তি থেকে নিজেকে খুন
অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। বয়স মাত্র তেরো। ছিল তুখোড় মেধাবী। স্কুলের ফার্স্ট গার্ল হিসেবেই সে পরিচিত ছিল। রাজধানীর ওয়াইডব্লিউসিএ হাইয়ার সেকেন্ডারি গালর্স স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সম্মিলিত মেধা তালিকায় ছিল প্রথম। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে।
চলতি বছর সে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছিল। হলিক্রস স্কুলে ভর্তির পর থেকে বদলে যেতে শুরু করে সে। কয়েক বছর আগে থেকে এনড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহার শুরু করে স্বর্ণা। এর মাধ্যমে সে পড়াশোনার জন্য ইন্টারনেটের সাহায্য নিত। কিন্তু একই সাথে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার ও বিভিন্ন গেমস খেলতে শুরু করে সে।
এরই মধ্যে সবার অজান্তে সে ঢুকে পড়ে ইন্টারনেটের এক নিষিদ্ধ গেমসে। মজা বা আনন্দের জন্য সমান তাতে গেমস খেলতে খেলেতে হঠাৎ করে গত বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার নিউ মার্কেট থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের ৪৪ নম্বর বাসার ৫বি ফ্ল্যাটের একটি কক্ষ থেকে ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখা যায় তাকে।
পুলিশ ওই কিশোরীর লাশ উদ্ধার করে। আত্মাহুতি দেওয়া ঐ কিশোরীর সাথে পাওয়া যায় একটি চিরকূটও। যা এখন পুলিশের হাতে। চিঠিতে বড় করে লেখা, ‘আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়।’ মাত্র ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়ে আত্ম্যহত্যা করলো কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি না! তাও আবার সে নিজ হাতে লিখে গেছে।
তাহলে ওই ছোট্ট মনে কি এমন দুঃখ ছিল যা তাকে জীবন শেষ করতে প্রোরোচিত করেছে? এমন মেধাবী আর আদরের সন্তান হারিয়ে শোকে মূর্তিমান পরিবার এখন বাকরুদ্ধ। পুলিশ জানিয়েছে, ব্লু হোয়েল নামে একটি গেম খেলে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। কারণ ‘আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়’ লেখা চিরকূটের নিচে একটি হাসির চিহ্ন আঁকা ছিল। প্রাণঘাতি গেম ব্লু হোয়েল কিউরেটর মৃত্যুর আগে এই নির্দেশ দিয়ে থাকে।
ঘটান-০৩: ব্যর্থ প্রেমের অভিমানী মৃত্যু
বুধবার, ৪ অকেক্টাবর, ২০১৭। বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার নরসিংহলপট্টি গ্রাম। নাফিসা ইসলাম (ছদ্মনাম), বয়স মাত্র ১৪ বছর। পড়তেন পালরদী মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণিতে। স্কুলে থাকা অবস্থাতেই এক ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়েন।
জীবন ভালবেসে প্রেমে পড়লেও প্রেমেই যেন জীবনের জন্য যন্ত্রণা হয়ে উঠেছিল নাফিসার জন্য। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে তিনি যেন এই বিশাল পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য সামান্য অক্সিজেনও পাচ্ছিলেন না। প্রেমিকের সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস নেন তিনি।
ভোর আলো ফুটতেই প্রাণহীন নাফিসার দেহ দাফন করা হয়। আবেগের তাড়নায় একটি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে নাফিসা তার পরিবারের সব বাধন ছিন্ন করেছেন। রশিতে ঝুলতে যেয়েও তিনি একবারের জন্য ভাবেননি তার লাশ দেখে কিভাবে তার পরিবার বেঁচে থাকবে।
ঘটনা-০৪: পারিবারিক কলহ থেকে আত্মহনন
৮ অক্টোবর, ২০১৭। ঠাকুরগাঁও এর রানীশংকৈল উপজেলা। সন্তান নিয়ে ভালই চলছিল মা কহিনুরের (কনিকা) জীবন। কিন্তু গত রবিবার হঠাৎ করে একটি অঘটন ঘটে যায়। মা কহিনুর হত্যা করে বসেন তার মাত্র তিন বছর বয়সের নিষ্পাপ সন্তান মাহিরকে। সন্তানকে বিষ খাইয়ে চিরনিদ্রার পথে পাঠানোর ব্যবস্থা করে নিজেও নিখোঁজ হয়েছেন বিশ্ব সংসার থেকে।
নিজে গলায় দঁড়ি দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন তিনি। এলাকাবাসি কোহিনুরকে ঘরে ঝুলতে দেখে থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে কহিনুরের লাশ উদ্ধার করে। কিন্তু শিশুটিকে জীবিত অনুভব করে উন্নত চিকিৎসার জন্য রংপুর পাঠিয়ে দেয়া হয়। উপজেলার বাচোর ইউনিয়নের সহদোর গ্রামের মানিকের সাথে বিয়ে হয়েছিল কহিনুরের (২২)। কিন্তু দাম্পত্য জীবনে কলহ পিছু ছাড়ছিল না তাদের। আর এর জের ধরেই কহিনুর নিজেকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
কহিনুরের বাবা কবির জানান, রবিবার সকালে কহিনুর তার মায়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছে। মারা যাওয়ার আগে কহিনুর তার মাকে বলেছে- রাতে তার স্বামী তাকে ব্যাপক মারধর করেছে। কানে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করছে। কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে। এ কথা বলেই সে ফোন কেটে দেয়। কষ্টের জীবন আর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অস্ফুট চাপা বেদনা চাপা দিতে যেয়ে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।