• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

জিন্নাহ রতির কবরে কেঁদে উঠেছিলেন, তাদের বিয়ে ছিলো ভারত কাঁপিয়ে দেয়া

প্রকাশ:  ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:১৯
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

মুম্বাইয়ের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন স্যার দিনশা পেটিট সকালের জলখাবার খেতে বসেছিলেন। খাবার টেবিলে বসেই হাতে তুলে নিয়েছিলেন নিজের প্রিয় খবরের কাগজ ‘বম্বে ক্রনিক্যাল’। খবরের কাগজে আটের পাতায় পৌঁছে একটা খবরে চোখ যেতেই কাগজটা তার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল। তারিখটা ছিল ২০ এপ্রিল ১৯১৮। সংবাদটা ছিল স্যার দিনশার কন্যা লেডি রতিকে আগের দিন সন্ধ্যায় বিয়ে করেছেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। লেডি রতির পুরো নাম ছিল রতনবাই পেটিট। ঘটনার শুরুটা হয়েছিল আরো বছর দুই আগে।

স্যার দিনশা নিজের বন্ধু আর ব্যারিস্টার মুহম্মদ আলী জিন্নাহকে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে আসার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে দিনশার ১৬ বছরের কন্যা লেডি রতিও ছিলেন। সেই সময়ের মুম্বাইয়ে মিস রতির সৌন্দর্য রীতিমতো চর্চার বিষয় ছিল। আর মি. জিন্নাহ তখন ভারতীয় রাজনীতির শিখরের খুব কাছাকাছি পৌঁছেও গিয়েছিলেন। মি. জিন্নাহর বয়স তখন প্রায় ৪০; কিন্তু দার্জিলিংয়ের বরফে ঢাকা পাহাড় চূড়া আর নীরব রোমান্টিক পরিবেশ দুইজনের মনকে কাছাকাছি নিয়ে এল। লেডি রতি ও মি. জিন্নাহ একে অন্যের প্রেমে পড়ে গেলেন। বয়সের ব্যবধান তাদের প্রেমে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ালো না।দার্জিলিং ভ্রমণের সময়েই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্যার দিনশা পেটিটের কাছে তার মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। ‘মিস্টার এন্ড মিসেস জিন্নাহ - দা ম্যারেজ দ্যাট শুক ইন্ডিয়া’ (মি. ও মিসেস জিন্নাহ - যে বিয়ে ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল) বইটির লেখিকা শীলা রেড্ডির কথায়, ‘দার্জিলিংয়েই একদিন নৈশাহারের সময়ে মি. জিন্নাহ প্রশ্ন করেছিলেন দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে নিয়ে স্যার দিনশার কী মতামত।’

সম্পর্কিত খবর

    সঙ্গে সঙ্গেই রতির বাবা উত্তর দিয়েছিলেন যে, দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহসূত্রে মেলবন্ধন হলে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করতে সুবিধাই হবে। মুহূর্তের মধ্যে মি. জিন্নাহ ফের মুখ খুললেন, স্যার দিনশাকে জানালেন যে, তিনি তার মেয়েকে বিয়ে করতে চান। তবে এই প্রস্তাবে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে জিন্নাহকে সেই মুহূর্তে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন স্যার দিনশা। মি. জিন্নাহ অনেক চেষ্টা করেও স্যার দিনশার মত বদলাতে পারেননি।

    দুই ধর্মের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হলে যে বন্ধুত্ব আর ঐক্য দৃঢ় হবে, স্যার দিনশার ওই তত্ত্ব প্রথম পরীক্ষাতেই ফেল করলো।

    পার্শি সম্প্রদায়ের ধনাঢ্য ব্যক্তি স্যার দিনশা মেয়ে রতির ওপর নির্দেশ জারি করলেন- যতদিন রতি তার বাড়িতে আছেন, ততদিন জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। সেখানেই শেষ নয়। কোর্ট থেকেও আদেশ বের করালেন স্যার দিনশা যেন লেডি রতি প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মি. জিন্নাহ যাতে তার মেয়ের সঙ্গে দেখা না করতে পারেন।

    এত কিছু করেও রতি আর জিন্নাহর লুকিয়ে দেখা করা বা একে অন্যকে চিঠি লেখা থামাতে পারেননি স্যার দিনশা পেটিট।

    মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আরেক জীবনীকার অধ্যাপক শারিফ আল মুজাহিদ বলছেন, ‘১৯১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি লেডি রতি ১৮ বছরে পা দিলেন। আর সেদিনই একটা ছাতা আর এক জোড়া পোশাক নিয়ে পিতৃগৃহ ত্যাগ করলেন তিনি।’ রতিকে জামিয়া মসজিদে নিয়ে গেলেন জিন্নাহ। ইসলাম ধর্মান্তরিত করে পরের দিন ১৮ এপ্রিল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর লেডি রতির বিয়ে সম্পন্ন হলো। নিকাহনামায় ১০০১ টাকা দেন মোহরের উল্লেখ ছিল; কিন্তু জিন্নাহ রতিকে উপহার দিলেন এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকা। সেসময়ে সেটা বিশাল অঙ্কের টাকা। ২৪ বছরের ছোট একটি মেয়ের সঙ্গে জিন্নাহর বিবাহ সেই সময়ে ভারতীয় সমাজের এক নম্বর গসিপে পরিণত হয়েছিল।

    ১৯১৮ সালের সেই বসন্তে জিন্নাহ আর রতির আনন্দে উচ্ছল চেহারা দেখে মনে হতো যে এরা একে অন্যের জন্যই যেন তৈরি হয়েছেন। রতির চলাফেরা, আদবকায়দা চোখে পড়ার মতো ছিল, তবে চারপাশের মানুষকে সবচেয়ে আকর্ষণ করতো তার হাসি।

    রতি বেশ স্পষ্টবাদী ছিলেন। এই প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন রাজি হায়দার।

    কোনো এক ভোজসভায় ভাইসরয় লর্ড রিডিংয়ের পাশে বসেছিলেন লেডি রতি। জার্মানির কথা উঠেছিল। লর্ড রিডিং বলছিলেন যে তিনি জার্মানি যেতে চান, কিন্তু যুদ্ধের পরে জার্মানরা ব্রিটেনের লোকদের পছন্দ করবে না, তাই সেখানে যাওয়া যাবে না। রতি তার মুখের ওপরেই বলে দিলেন, ‘তো আপনি ভারতে কী করতে এসেছেন?’ ইঙ্গিতটা স্পষ্ট- ভারতীয়রাওতো আপনাদের পছন্দ করে না, তাহলে এদেশে কেন এসেছেন?

    মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যস্ততা আর স্ত্রীর সঙ্গে তার বয়সের ফারাক জিন্নাহ আর রতির মধ্যে ধীরে ধীরে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করে দিল। তখন অল্পবয়সী স্ত্রী আর কোলের শিশুকন্যার জন্য দেওয়ার মতো সময় তার হাতে বিশেষ ছিল না। রাজি হায়দার অবশ্য মনে করেন যে দু’জনের মধ্যে একটা হাল্কা দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণটা ছিল রাজনৈতিক।

    রতি মাঝেমধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। একবার অসুস্থতার পর ফ্রান্স থেকে জাহাজে করে দেশে ফেরার সময়ে স্বামীকে একটা চিঠি লিখেছিলেন রতি। লেখেন, ‘আমার জন্য তুমি যা করেছ, সেজন্য অনেক ধন্যবাদ। আমি তোমাকে যতটা চেয়েছিলাম, আর কোনো পুরুষ মানুষকেই কোনো নারী বোধহয় অতটা চায়নি কখনও। তুমি আমাকে ওই ফুলটার মতো করেই মনে রেখ যেটা ছিঁড়ে এনেছিলে। যে ফুলটাকে তুমি পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছ, সেটাকে মনে রাখার দরকার নেই’।

    ১৯২৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি, মাত্র ২৯ বছর বয়সে রতি জিন্নাহ মারা যান। শেষ সময়টায় তার সঙ্গী ছিলেন কাঞ্জি দ্বারকা দাস। শীলা রেড্ডি লিখছেন, ‘কাঞ্চিই জানিয়েছিলেন যে শেষ দিনগুলোয় রতি খুব মনমরা হয়ে থাকতেন। পরে কাঞ্জিই এক পাকিস্তানি সাংবাদিককে বলেছিলেন অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন রতি।’

    মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেদিন দিল্লিতে ওয়েস্টার্ন কোর্ট ভবনে ছিলেন। তখনই একটা ট্রাঙ্ক কল আসে তার কাছে। ফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন শ্বশুর দিনশা পেটিট। দশ বছরের মধ্যে সেই প্রথমবার দু’জনের কথা হয়। মেয়ে যে খুব অসুস্থ, সেই খবরটা জিন্নাহকে জানিয়েছিলেন মি: দিনশা। সঙ্গে সঙ্গেই জিন্নাহ ট্রেনে করে মুম্বাইয়ের দিকে রওনা হন। পথেই ভাইসরয় আর অন্যান্য মান্যগণ্যদের টেলিগ্রাম আসতে থাকে, শোকজ্ঞাপন করা টেলিগ্রাম। জিন্নাহ বুঝতে পারেন যে রতি আর এই পৃথিবীতে নেই। স্টেশন থেকে সোজা কবরস্থানে গিয়েছিলেন জিন্নাহ। সেখানে তার জন্যই সকলে অপেক্ষা করছিল। সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসেবে যখন জিন্নাহকে অনুরোধ করা হয়েছিল রতির কবরে মাটি দিতে, তখন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন জিন্নাহ। সেই প্রথম, আর সেই শেষবার মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জনসমক্ষে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে দেখা গিয়েছিল।

    সূত্র: বিবিসি।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close