টাকা পরিশোধে ঘুম ভাঙ্গেনা কেনো?
আর্থিক বিপর্যয়ে থাকা বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) লিমিটেডকে ঋণ দিয়ে বিপদে পড়েছে প্রায় দুই ডজন ব্যাংক। ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি আমানত এবং কলমানি ঋণ পরিশোধ করছে না কোম্পানিটি। কয়েক দফা চিঠি দিয়েও পাওনা বুঝে না পাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো। টাকা আদায়ের কৌশল নির্ধারণে নিজেদের মধ্যেও বৈঠক করেছে ব্যাংকগুলো।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি ১৯টি ব্যাংক ও তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল বিআইএফসি। পরিশোধ না করায় এসব ঋণের প্রায় পুরোটাই খেলাপি হয়ে গেছে।
সম্পর্কিত খবর
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বিআইএফসির কাছে সবচেয়ে বেশি ৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে রূপালী ব্যাংকের। প্রতিষ্ঠানটিকে দেয়া ব্যাংকটির ৩০ কোটি টাকার স্বল্পমেয়াদি আমানত পরিশোধের সময় এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে। তারপরও পাওনা পরিশোধ করেনি বিআইএফসি। পাওনা চেয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি কয়েক দফা চিঠিও দিয়েছে।
বিআইএফসি অর্থ ফেরত তো দিচ্ছেই না, সুদ পরিশোধও বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানান রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আতাউর রহমান প্রধান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এরই মধ্যে বিআইএফসিকে কয়েক দফা চিঠি দেয়া হয়েছে। টাকা পরিশোধে প্রতিষ্ঠানটি কিছুদিন সময় চেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়কেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের এমডি বলেন, এত দিন ব্যক্তিপর্যায়ে দেয়া ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছিল। এখন যদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণও খেলাপি হয়ে যায়, তাহলে ব্যাংক যাবে কোথায়? ব্যাংকিং খাতের জন্য এটি অশনিসংকেত।
বিআইএফসির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের পাওনা ২৯ কোটি, বেসিক ব্যাংক ৩০ কোটি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) ২১ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দিয়ে আদায় করতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকও। যদিও সবগুলো ঋণই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অভিযোগ দেয়ার পাশাপাশি পাওনা আদায়ের কৌশল নির্ধারণে সম্প্রতি নিজেদের মধ্যেও বৈঠক করেছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সোনালী ব্যাংকের জ্যেষ্ঠ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তরিকুল ইসলাম চৌধুরী।
জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিআইএফসিকে কলমানি হিসেবে ১০ কোটি ও আমানত হিসেবে ২০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছিল। কয়েক দফায় চিঠি দেয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটি অর্থ পরিশোধ করছে না। একই পরিস্থিতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে ধার দেয়া অন্য ব্যাংকগুলোরও। বিআইএফসির কাছ থেকে টাকা আদায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়েছে। গভর্নর মহোদয়কেও অর্থ পরিশোধ না করার বিষয়টি অবহিত করেছি।
বিআইএফসির কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে পারছে না বেসরকারি বেশকিছু ব্যাংকও। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির কাছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৪৭ কোটি টাকা। এছাড়া উত্তরা ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৩২ কোটি, ডাচ্-বাংলার প্রায় ৩৫ কোটি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ২৩ কোটি, পূবালীর ১০ কোটি, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ১০ কোটি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৮ কোটি টাকা। এর বাইরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিআইএফসির কাছে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ঋণ ছিল প্রায় ৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রায় ১০ কোটি ও ঢাকা ব্যাংকের ৫ কোটি টাকার বেশি।
পাওনা আদায়ের বিষয়ে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের ৫ কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ বিআইএফসির কাছে রয়েছে। অনেক আগেই এ অর্থ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু উদ্যোগ নিয়েও তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা সম্ভব হয়নি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণও খেলাপি হয়ে গেলে ব্যাংক ব্যবসা করবে কীভাবে? নতুন করে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তাই এখন আর ঋণ দিচ্ছি না আমরা।
বেসরকারি খাতের কয়েকটি নতুন ব্যাংকও বিভিন্ন অংকের অর্থ ধার দিয়েছে বিআইএফসিকে। এছাড়া তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিআইএফসিকে ঋণ দেয়া হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা। চলতি বছর বিআইএফসি কয়েকটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অন্য কয়েকটি ব্যাংকের ছোট অংকের কিছু ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিআইএফসির চেয়ারম্যান রুহুল আমিনের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিআইএফসির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সানম্যান গ্রুপের কর্ণধার মেজর (অব.) আবদুল মান্নান। চেয়ারম্যানসহ পর্ষদ সদস্যদের ঋণ অনিয়মের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম। ২০১৫ সালে সাড়ে ৬২ কোটি টাকা লোকসান দেয়ার পর ২০১৬ সালে লোকসান দেয় আরো বড় অংক ৬৮ কোটি টাকা। আর্থিক বিপর্যয়ের এ ধারাবাহিকতা চলতি বছরও অব্যাহত আছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ কোটি টাকা নিট লোকসানে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআইএফসির বিতরণকৃত ঋণের ৯৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ৮৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৯১ কোটিই খেলাপি। বিআইএফসির নিরীক্ষকের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন সানম্যান গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ঋণের পরিমাণ ৬২৩ কোটি টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি। এছাড়া বিশ্বাস গ্রুপের কাছে ২০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে বিআইএফসির।