• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মাদরাসা উন্নয়নে সংসদ সদস্যরা পাবেন ৭০০০ কোটি টাকা!

প্রকাশ:  ১৬ মার্চ ২০১৮, ১৮:১৬
নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারের শেষ সময়ে ভোটারদের মন জয় করতে ৩০০ জন এমপিকে নিজ নিজ আসনের মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটি গৃহীত হলে প্রত্যেক এমপি তাঁর আসনের ছয়টি করে মাদরাসা উন্নয়নে সাড়ে ২২ কোটি টাকা পাবেন। সেই হিসাবে প্রতিটি মাদরাসা উন্নয়নে খরচ হবে পৌনে চার কোটি টাকা। সমতল কিংবা পাহাড়ি এলাকা যেখানেই হোক না কেন, মাদরাসা ভবনগুলো ছয়তলা করতে হবে। মোট এক হাজার ৮০০টি মাদরাসার উন্নয়নে চার বছরে এই অর্থ ছাড় দেওয়া হবে।

এমপিদের পছন্দের এই এক হাজার ৮০০ মাদরাসার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পছন্দের আরো ২০০টিসহ মোট দুই হাজার মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সাত হাজার ৮৮৫ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবটি গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ‘নির্বাচিত মাদরাসাগুলোর উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে এমপিদের জন্য এটি হবে বর্তমান সরকারের আমলে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত। তবে সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যদের এ উন্নয়নকাজের বাইরে রাখা হয়েছে।

সম্পর্কিত খবর

    শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে তৈরি হওয়া প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে বিস্মিত ও হতবাক পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। প্রস্তাবিত প্রকল্পে নানা ধরনের অসংগতি খুঁজে পেয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব পদমর্যাদা) ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবটি পেয়ে সব মাদরাসার তালিকা জানতে চান। কিন্তু কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ সব মাদরাসার তালিকা দেখাতে পারেনি। মাদরাসার নাম ফাঁকা থাকলে সেখানে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ থাকে বলে মত দেন তিনি। সরকারের নিয়মানুযায়ী, ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে তার সমীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এত বড় প্রকল্পটি নেওয়ার আগে কোনো ধরনের সমীক্ষা করা হয়নি। কমিশন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, প্রতিটি আসনে কিসের ভিত্তিতে ছয়টি মাদরাসা বাছাই করা হয়েছে। কারণ, কোনো সংসদ সদস্যের আসনে মাদরাসা আছে ৫০টি। আবার কোনো আসনে আছে ১০টি। আবার পার্বত্য জেলায় দেখা গেল, ছয়টি মাদরাসা নাও থাকতে পারে। আসন ভিত্তিতে জনসংখ্যারও তারতম্য আছে। প্রতিটি আসনে ছয়টি করে মাদরাসা ছয়তলা ভবন করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য থাকে না বলেও মত কমিশনের কর্মকর্তাদের। তাদের মতে, সমতলে ছয়তলা, আবার পাহাড়েও ছয়তলা ভবন নির্মাণ যৌক্তিক হতে পারে না।

    কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংসদ সদস্যরা যেসব মাদরাসা পছন্দ করে দিয়েছেন, সেসব মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কেমন এর কোনো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি। দেখা গেল, একটি মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক হাজার, সেখানে হবে ছয়তলা; আবার কোনো মাদরাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০০, সেখানেও হবে ছয়তলা।

    এ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ কোটি টাকা রাখা হয়েছে বিদেশ সফরের জন্য। মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে বিদেশ সফরের সম্পর্ক কী, তা নিয়েও প্রশ্ন কমিশনের। এর পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় চারটি জিপ ও ৭০টি মোটরসাইকেল কেনার প্রস্তাব করেছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। এ প্রস্তাবেও আপত্তি জানিয়েছে কমিশন। প্রকল্পে যতটা অবকাঠামোর দিকে জোর দেওয়া হয়েছে, মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম যুগোপযোগী করার বিষয়ে ততটা জোর দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ কমিশনের। সব মিলিয়ে প্রকল্পটিকে ‘ভৌতিক’ হিসেবে দেখছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।

    প্রকল্পটি দ্রুততার সঙ্গে একনেক সভায় পাশ করে দিতে ওপর মহলের চাপও রয়েছে বলে জানা গেছে। কমিশন সূত্র বলছে, এমপিদের চাপ থাকার কারণে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটেই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হবে। একই সঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে যে থোক বরাদ্দ আছে, সেখান থেকে বরাদ্দ দেওয়া শুরু হবে।

    বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় নেওয়া বেশ কয়েকটি ছয়তলা ভবন নির্মাণের খরচ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ প্রকল্পে মাদরাসার ভবনগুলো নির্মাণের খরচ অনেক বেশি ধরা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবনকে অত্যাধুনিক করে ছয়তলা করার জন্য খরচ প্রস্তাব করা হয়েছে তিন কোটি টাকার কিছু বেশি। সেখানে প্রস্তাবিত মাদরাসার প্রতিটি ছয়তলা করার খরচ হবে পৌনে চার কোটি টাকা করে।

    সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) অজিত কুমার ঘোষ বলেন, ‘বেশ কয়েকজন এমপির কাছ থেকে আমরা এখনো তালিকা পাইনি। সে জন্য আমরা পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পুরো এক হাজার ৮০০ মাদরাসার তালিকা দিতে পারিনি। সংসদ সদস্যদের বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে, দ্রুত তাঁদের আসনের মাদরাসার তালিকা দেওয়ার জন্য। আশা করছি, ২৬ মার্চের আগেই তালিকা হাতে পাব। আর মাদরাসা শিক্ষার কারিকুলাম আধুনিকায়ন এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে আমরা আলাদা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সেই কারণে এ প্রকল্পে কারিকুলাম ও প্রযুক্তির বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি’।

    অজিত কুমার বলেন, মাদরাসা নির্মাণ প্রকল্পটি বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে।’ সমতল ও পাহাড়ে সমানভাবে ছয়তলা ভবন নির্মাণের গুণগত মান কিভাবে নিশ্চিত হবে, এমন প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

    প্রকল্পটি নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ বলছে, সরকারি মাদরাসাগুলোতে সরকার অর্থায়ন করলেও বেসরকারি মাদরাসা চলে এমপিওভুক্ত ও স্থানীয় মাদরাসা পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে। মাদরাসাগুলোর বেশির ভাগই কাঁচা ও আধাপাকা। অনেক মাদরাসা আছে, যেগুলোর অবকাঠামো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এমন বাস্তবতায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে।

    কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের তথ্য মতে, সারা দেশে এখন ৯ হাজার ৩৪১টি দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদরাসা রয়েছে; যার মধ্যে বেসরকারি মাদরাসাই বেশি। সেখান থেকে প্রথম ধাপে ৩০০ এমপির পছন্দে ছয়টি করে মোট এক হাজার ৮০০ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পছন্দে আরো ২০০ মাদরাসার অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। সব মিলিয়ে প্রথম ধাপে দুই হাজার মাদরাসার উন্নয়ন হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ ধরা হয়েছে সাত হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে এমপিদের পছন্দে দেওয়া এক হাজার ৮০০টি মাদরাসা উন্নয়নে খরচ হবে ছয় হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা খরচ হবে অন্য ২০০ মাদরাসার উন্নয়নে। পরের ধাপে ধাপে অন্য মাদরাসাগুলোরও অবকাঠামো উন্নয়ন হবে।

    ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ওয়ার্কার্স পার্টির কয়েকজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, এলাকার মানুষের প্রত্যাশা থাকে সংসদ সদস্যরা স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন করবেন। এত বছর স্কুল-কলেজের উন্নয়ন হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত ও অবহেলিত রয়ে গেছে। তাই মাদরাসার উন্নয়ন জরুরি। সেই কারণে মাদরাসার তালিকা দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এখনো মাদরাসার তালিকা দিইনি, তবে দেব। আমি মনে করি, মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করার দিকে নজর দেওয়া উচিত।’ লক্ষ্মীপুর-২-এর সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নোমান বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি ছয়টি মাদরাসার তালিকা দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পটি অনুমোদন পায়নি।’ পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নূরুল ইসলাম সুজন জানালেন, তিনিও তালিকা দিয়েছেন। প্রকল্পটি এখনো একনেক সভায় অনুমোদন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

    এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে সংসদ সদস্যদের নিজ নিজ আসনের রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট নির্মাণে ছয় হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। ওই প্রকল্পের আওতায় একজন সংসদ সদস্য প্রতিবছর পাঁচ কোটি টাকা করে চার বছরে মোট ২০ কোটি টাকা পাবেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে সংসদ সদস্যদের পছন্দের মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ নির্মাণে ৬৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আলাদা একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছিল সরকার। সেই প্রকল্পের আওতায় একজন সংসদ সদস্য দুই কোটি টাকা করে পাওয়ার কথা। আর সব শেষ গত বছরের শেষ দিকে সংসদ সদস্যদের পছন্দের গ্রামীণ হাট-বাজার উন্নয়নে এক হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল একনেক সভায়। ওই প্রকল্পের আওতায় একজন সংসদ সদস্য সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার বেশি পাওয়ার কথা। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাদরাসা নির্মাণে যে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে, বরাদ্দের দিক থেকে এটি নজিরবিহীন। সূত্র: কালের কণ্ঠ

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close