• বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ইসির সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ মন্ত্রী-এমপিরা

প্রকাশ:  ১৭ মার্চ ২০১৮, ১৬:০৮ | আপডেট : ১৭ মার্চ ২০১৮, ২১:২০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পরিবর্তনে ক্ষুব্ধ সংশ্নিষ্ট আসনের মন্ত্রী-এমপিরা। অনেকেই বলেছেন, এই পরিবর্তন আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ কেউ ইসির এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছেন। ১৬ জেলার ৩৮ আসনের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইসির ঘোষিত নীতিমালায় অস্পষ্টতারও অভিযোগ উঠেছে।

সংবিধানে বলা হয়েছে, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ বা সীমানা বণ্টন সম্পর্কিত কোনো আইনের বৈধতা নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সীমানা নির্ধারণ আইনের আলোকে ইসিকে স্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করতে হবে। একই সঙ্গে সেই নীতিমালা যথাযথভাবে মানতেই হবে। অন্যথায় সংক্ষুব্ধরা আদালতে যাবেনই।

সম্পর্কিত খবর

    গত বুধবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া অনুমোদনের পর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।

    বিশ্নেষণে দেখা গেছে, সীমানা নির্ধারণ আইনে প্রশাসনিক অখণ্ডতা, ভৌগোলিক যোগাযোগ ও জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। তবে বুধবার ইসি প্রকাশিত খসড়ায় দেখা গেছে, কোনোটিতে জনসংখ্যা, কোনোটিতে প্রশাসনিক অখণ্ডতা, আবার কোনোটিতে ভৌগোলিক যোগাযোগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে ভোটার সংখ্যার তারতম্য যেমন বেড়েছে, তেমনি ভৌগোলিক যোগাযোগও ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

    চট্টগ্রাম-৭ আসনে শুধু রাঙ্গুনিয়া উপজেলাকে রাখা হয়েছে। বর্তমান সীমানায় চট্টগ্রাম-৮ আসনের অন্তর্ভুক্ত বোয়ালখালীর শ্রীপুর ও খরণদ্বীপ ইউনিয়ন চট্টগ্রাম-৭ আসনে যুক্ত রয়েছে। নতুন সীমানায় বোয়ালখালীকে একত্র করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩, ৪, ৫, ৬, ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এতে চট্টগ্রাম-৮ আসনের ভোটার বেড়ে প্রায় পাঁচ লাখ হলেও চট্টগ্রাম-৭ আসনের ভোটার সংখ্যা আড়াই লাখের নিচে চলে আসছে। অর্থাৎ ইসির নতুন সিদ্ধান্তে ভোটার সংখ্যার ব্যবধান আরও বেড়েছে।

    একই ধরনের অভিযোগ করেছেন শরীয়তপুর-৩ আসনের এমপি নাহিম রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, ইসির নীতিমালা অস্পষ্ট।

    কারণ, তারা প্রশাসনিক অখণ্ডতা রক্ষার কথা বলে শরীয়তপুরে পরিবর্তন আনলেও পাশের জেলা মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলাকে খণ্ডিত করে দুটি আসনে রাখা হয়েছে। শরীয়তপুর-২ ও ৩ আসনে নতুন সীমানায় ভোটার সংখ্যার ব্যবধান আরও বাড়বে। একটিতে তিন লাখের বেশি ভোটার হবে, আরেকটিতে দুই লাখের নিচে। এ ছাড়া নদী দ্বারা বিভাজিত একটি এলাকা কীভাবে তারা অন্য একটি আসনের সঙ্গে যুক্ত করেছে, তা স্পষ্ট নয়। নাহিম রাজ্জাকের দাবি, বিদ্যমান সীমানায় দুটি আসনের ভোটার সংখ্যার মধ্যে সামঞ্জস্য রয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালেও এ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিল ইসি। তখন এলাকাবাসী আপত্তি দিয়ে শুনানির মাধ্যমে কাজী রকিব কমিশনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। এখন আবার নতুন কমিশনের এ সিদ্ধান্তে ভেদরগঞ্জবাসী ক্ষুব্ধ ও হতাশ বলে তিনি দাবি করেন।

    ইসি প্রকাশিত গেজেটে বলা হয়েছে, সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ছয়টি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতি জেলার বিদ্যমান মোট আসন অপরিবর্তিত রাখা, প্রশাসনিক ইউনিট, বিশেষ করে উপজেলা এবং সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড যথাসম্ভব অখণ্ড রাখা, ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌর এলাকার ওয়ার্ড একাধিক আসনে বিভাজন না করা, নতুন প্রশাসনিক এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা, বিদ্যমান সীমানায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের কারণে নতুন সীমানা নির্ধারণ করা এবং ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা যথাযথভাবে বিবেচনা করা।

    তবে ইসি প্রকাশিত খসড়া সীমানার তালিকায় এখনও ৩৪টি উপজেলা খণ্ডিত অবস্থায় একাধিক আসনে রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, যে নীতিমালার আওতায় সীমানা বিন্যাসের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, তা যথাযথভাবে মানা হয়েছে কি-না সেটা পরিস্কারভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছু হলে তা নিয়ে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে অবশ্যই পড়তে হবে।

    সীমানা নির্ধারণ আইনে জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও ইসি এবার তা আমলে নেয়নি। গাজীপুরে একই জেলার মধ্যে সাত লাখ ভোটার নিয়ে যেমন একটি আসন রয়েছে, তেমনি আড়াই লাখ ভোটারেরও একটি আসন রয়েছে। আবার ঝালকাঠিতে একটি আসনে ভোটার সংখ্যা রয়েছে মাত্র পৌনে দুই লাখ।

    সীমানা নির্ধারণে ইসির নিয়োগ করা পরামর্শক ও ইসির সাবেক যুগ্ম সচিব লুৎফর বিশ্বাস অবশ্য জানিয়েছেন, আইনে জনসংখ্যাকে গুরুত্ব দিতে বলা হলেও সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছে ২০১১ সালে। এরপর ২০১৩ সালেও সীমানা বিন্যাস হয়েছে। এর পর আর কোনো আদমশুমারি না হওয়ায় জনসংখ্যা বা ভোটার সংখ্যাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

    ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত বছরের ১৬ জুলাই ইসি ঘোষিত রোডম্যাপে গত ডিসেম্বরের মধ্যে সীমানা চূড়ান্তের কথা থাকলেও তা নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায়নি। রোডম্যাপ ঘোষণায় সীমানা নির্ধারণ নিয়ে তাদের নতুন আইন করার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন। অদৃশ্য কারণে ইসি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। সময় পেরিয়ে যাওয়ায় তড়িঘড়ি করে খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে।

    অস্পষ্ট নীতিমালার অভিযোগ সম্পর্কে ইসির সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা কমিশন অনুমোদন করেছে। এ অবস্থায় তিনি কোনো বক্তব্য দিতে পারবেন না।

    ঢাকার আসন পরিবর্তন সম্পর্কে ইসির বৈঠকের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমানে সাভার উপজেলা তিন খণ্ডে বিভক্ত ও ভোটার সংখ্যা নয় লাখের বেশি। তাই পুরো উপজেলাকে নিয়ে একটি আসন না করে সাভার থানা নিয়ে একটি ও আশুলিয়া থানা নিয়ে একটি আসনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসির এ পরিবর্তনে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের আসন ঢাকা-২ পুরোপুরি নতুন চেহারা লাভ করেছে।

    নির্বাচনের কয়েক মাস আগে কেন এ পরিবর্তন- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা-২ আসনের সাংসদ ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল। তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ১০ বছর ধরে এ আসনে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন তিনি। হঠাৎ করে নির্বাচনের ?ছয় মাস আগে এ সিদ্ধান্ত মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসির এ সিদ্ধান্তে তার নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, মানুষ সন্দেহের দোলাচলে দুলছে। ইসি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার এলাকার ভোটাররা এ বিষয়ে আপত্তি জানাবেন। এ নিয়ে আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতির কথাও জানান তিনি।

    ইসির বৈঠকের কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, নতুন পরিবর্তনে ১৩টি উপজেলা ও দুটি সিটি করপোরেশনের সাতটি ওয়ার্ডকে অখণ্ডিত রাখতে ২৮টি আসনে পরিবর্তন করা হয়েছে। এ ছাড়া উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্নতার জন্য খুলনার দুটি, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কুমিল্লার দুটি, ভোটার সংখ্যা ও জনসংখ্যার সামঞ্জস্য করা ও ভুল সংশোধনের জন্য দুটি, রংপুরে জনসংখ্যার সামঞ্জস্যতার জন্য একটি আসনে পরিবর্তন আনা হয়।

    এ বিষয়ে কুমিল্লা-৬ আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দীন বলেন, এ বিন্যাস কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, আদমশুমারি না হলে সীমানা বিন্যাসের সুযোগ নেই। এ যুক্তিতে তিনি আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, তার আসনটি ৩০ বছর ধরে এ অবস্থায় আছে। কারও তদবিরে কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। বাহার বলেন, নয়টি নতুন ওয়ার্ড যুক্ত হওয়ার ফলে তার আসনটিতে ৬৫ হাজারের মতো ভোটার বেড়ে যাবে। নির্বাচনের ছয় মাস আগে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

    সাতক্ষীরা-৩ ও ৪ আসনের পরিবর্তনের ফলে সাতক্ষীরা-৩ আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকের বাড়ি কালীগঞ্জের নলতা সাতক্ষীরা-৪ আসনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তিনি বলেন, এ দুটি আসনের মধ্যে আগে ভোটারের ব্যবধান ছিল মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার। নতুন পরিবর্তনে দুই আসনে ভোটারের ব্যবধান হবে এক থেকে দেড় লাখ। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এরই মধ্যে তিনি দলের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন বলে জানান। কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আবেদন করবেন এবং বিদ্যমান আসনই থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

    সাতক্ষীরা-৪ আসনের এম এম জগলুল হায়দার বলেন, এ বিষয়ে তিনি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দাবি আপত্তি পেশ করবেন।

    এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় ১৯৯৫ সালের সীমানার গেজেট বহাল রাখা হয়েছিল। তবে ১৯৮৪, ১৯৯১ ও ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছিল। দশম সংসদে ছয়টি নীতিমালা অনুসরণ করে ৫০টি আসনে ছোটখাটো পরিবর্তন করে আসন পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল। এবার ৩৮টি আসনের খসড়া প্রকাশ করলেও চূড়ান্ত তালিকায় এ সংখ্যা আরও কমতে পারে।

    সূত্রঃ সমকাল

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close