কোলেস্টেরল শুধুই কি অপকারী?
কোলেস্টেরল, বর্তমান সময়ে একটি আতঙ্কের নাম। আজকাল ডাক্তারদের প্রায়ই রোগীদের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা যায় “আপনার রক্তে কোলস্টেরলের পরিমান বেড়ে গিয়েছে, এখন থেকে সাবধানে জীবন যাপন করবেন”।ব্যাস শুরু হয়ে গেলো রোগীর আতঙ্ক; আর সেই আতঙ্ক গ্রাস করে পরিবারের অন্যদেরও। এই কোলেস্টেরল কি? কিভাবে রক্তে এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়? এর প্রভাবে কি ক্ষতি হয়? কোলেস্টেরল এর কি শুধু ক্ষতিকর দিকই আছে, কোনো উপকারী দিকই কি নেই? কোলেস্টেরলের উপকারী দিকঃ আমাদের সমাজের বেশির ভাগ মানুষেরই ধারনা যে, কোলেস্টেরল মানেই একটি ক্ষতিকর বিষয়। সবসময়েই এটি এড়িয়ে চলা উচিত। ধারনাটি মোটেই ঠিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই কোলেস্টেরল শরীরের জন্যে একটি খুবই জরুরী উপাদান। কেবল মাত্র অতিরিক্ত কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহন আমাদের ক্ষতির কারন। কিভাবে কোলেস্টেরল আমাদের শরীরের জন্যে দরকারি উপাদান হলো তা হয়তো অনেককেই ভাবেই তুলছে। আসুন জেনে নেই কেনো এই সর্বজন ধারনা প্রসূত ক্ষতিকর কোলেস্টেরল আমাদের জন্যে এত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো।
সম্পর্কিত খবর
- পিত্তরসের একটি প্রধান উপাদান কোলেস্টেরল। পিত্তরস আমাদের গ্রহনকৃত স্নেহ জাতীয় খাদ্য হজমে ভূমিকা রাখে।
- আমাদের মস্তিষ্কের সর্বমোট ২০ শতাংশ এই কোলেস্টেরল দিয়ে তৈরী। মস্তিষ্কের শ্বেতাংশে ১৪ শতাংশ ও ধূসর অংশে ৬ শতাংশ কোলেস্টেরল আওয়া যায়।
- স্নায়ু পেশি গঠনে কোলেস্টেরল প্রয়োজন। এটি স্নায়ু পেশির সিগনাল পরিবহনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
- কোষ ঝিল্লির গঠনে কোলেস্টেরল একটি আবশ্যকীয় উপাদান।
- চামড়ার নিচে অবস্থানরত কোলেস্টেরল সূর্যের আলোতে শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি উৎপন্ন করে।
- শরীরের স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন সমূহ (যেমন এন্ড্রোনাল, ইস্ট্রজেন, প্রজেস্টেরন ইত্যাদি হরমোন) উৎপাদন করে থাকে।
- শরীরে প্রয়োজনীয় তাপ ও শক্তি উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
চিংড়ি – উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার
কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর দিকঃ উপকারী দিকের পাশাপাশি কোলেস্টেরলের কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে, এবার আসুন কোলেস্টেরলের কিছু ক্ষতিকর দিক জেনে নেয়া যাক।
- রক্তে কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা ১৫০=২০০ মিলি গ্রাম/১০০ মিলি লিটার। এর বেশি হলেই তা নিয়ন্ত্রন করতে বলা হয়। তা না হলে এটি ভয়ানক হৃদরোগের কারন হয়ে দাঁড়ায়।
- দেহে কোলেস্টেরলের প্রধান বাহক কোলেস্টেরল বেড়ে গেলে LDL এর পরিমান ও ঘনত্ব দুটোই বৃদ্ধি পায়।
- ধমনির মধ্য দিয়ে অধিক ঘনত্বে রক্ত প্রবাহিত হবার সময় ধমনি গাত্রে চর্বির আস্তারন তৈরী হয়।
- উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলের কারনে রক্তনালীর প্রাচীরে প্লাক জমা হয় এবং রক্তনালী সরু হয়ে যায়। এতে করে রক্তে অক্সিজেন ও পুষ্টি উপাদান সরবরাহ ব্যাহত হয়। ধমনিতে রক্ত জমাট বাধতে শুরু করে ও রক্ত চাপ বেড়ে যায়, যা স্ট্রোক এর কারন।
- করনারী ধমনিতে এই অবস্থার সৃষ্টি হলে হৃদপিন্ড প্রয়োজনীয় উপাদান ও অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত হয় এবং দুর্বল হয়ে পরে।
- বুকে ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ অনুভূত হওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হৃদপেশি নষ্ট বা অকার্যকর হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
- হার্ট এট্যাক, হার্ট ফেইলর, Arteriosclerosis, Angina, Thrombosis সহ রোগীর মৃত্যু অর্যন্ত ঘটতে পারে।
কোলেস্টেরল হলো ঈষৎ হলুদাভ, স্বাদহীন, গন্ধহীন এবং কিছুটা মোমের মতো চটচটে পদার্থ। কোলেস্টেরল হলো একটি উচ্চ আনবিক জৈব যৌগ। রাসয়নিকভাবে, মুলত স্টোরয়েড জাতীয় যৌগ, যা শুধু মাত্র প্রাণী দেহেই পাওয়া যায়। কোলেস্টেরল সর্ব প্রথম পৃথক করা হয়েছিলো পিত্তরস হতে। গ্রিক শব্দ “chole” যার অর্থ পিত্ত, এই শব্দটি অনুসরন করেই এর নাম রাখা হয় কোলেস্টেরল।
২৭টি কার্বন পরমানু, ৪ টি হাইড্রোজেন পরমানু ও একটি মাত্র অক্সিজেন পরমানু বিশিষ্ট এই জৈব যৌগটি প্রাণীদের লিভার তথা যকৃতে সংশ্লেষিত হয় এবং রক্তনালীতে প্রবাহিত হয়।
কোলেস্টেরলের উৎসঃ এবার আসুন জেনে নেই, এই কোলেস্টেরলের উৎস সম্পর্কে। আগেই বলেছি কোলেস্টেরল শুধুমাত্র প্রানী কোষে পাওয়া যায়। যার অর্থ এর কোনো উদ্ভিজ্জ উৎস নেই। প্রধানত স্নেহ বহুল খাদ্যে কোলেস্টেরল এর পরিমান বেশি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যে কি পরিমান কোলেস্টেরল পাওয়া যেতে পারে তা এক নজরে দেখে নেই চলুন –
মগজ- অতি উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার
খাদ্য | কোলেস্টেরল |
মগজ | ২০০০ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
ডিমের কুসুম | ১৫০০ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
যকৃত | ৩০০ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
ঘি | ৩১০ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
চিংড়ি মাছ | ১২৫ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
গরুর মাংস | ৯০মিলি গ্রাম /১০০গ্রাম |
খাসির মাংস | ৬৫ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
আইস ক্রিম | ৪৫ মিলি গ্রাম/১০০ গ্রাম |
ডিমের কুসুম- অতি উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার
এছাড়াও গরুর মাংস, মাখন, পনির, মাছের তেল, তেল বা চর্বি দিয়ে রান্না করা খাদ্য, বিরিয়াণি, কেক, পেস্ট্রি, রসমালাই, ডালডা ইত্যাদি হতে বেশ ভালো পরিমান কোলেস্টেরল পাওয়া যায়।
গরুর মাংস- উচ্চ কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার
কাজেই রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করা জরূরী। সঠিক খাদ্যাভাস, নিয়মিত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম, ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার, ওজন নিয়ন্ত্রন এর মতো সাধারন কিছু নিয়ম মেনে চললেই আমরা কোলেস্টেরলের ভয়কে জয় করতে পারি।
লেখক-
ফাইজা ফেরদৌস অনু
/এসএম