দলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকাটাই কি তাদের অযোগ্যতা?
শরীরে অসংখ্য অসুস্থতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে আছি। দূরে সরে থাকলেও অনেক সময় অনেক কিছু থেকে দূরে থাকা যায় না। রাজনীতির গতি প্রকৃতি আমাকে এখনও ভাবায়। কলেজ জীবন থেকে রাজনীতিতে জড়িত। এক সময় ছাত্রলীগ সুনামগঞ্জ জেলা সভাপতিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে শুরু থেকে শুরু। আজ অবদি সেই আদর্শে অবিচল। ছাত্রলীগ করার অপরাধে বাসায় ঢুকে দিনে দুপুরে সন্ত্রাসীররা আমার নিরপরাধ ধার্মিক বাবা মাকে কুপিয়ে জখম করলো। জখমের ক্ষত নিয়ে সারা জীবন তারা বেঁচেছিলেন। আমিও সারা জীবন সেই জখমের ক্ষত দেখে দেখে অনুশোচনায় ভুগেছি। দল কি দিয়েছে নয়, দলকে কি দিয়েছি তাই নিয়েই ভাবতাম। ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও ছাত্রলীগকে সংঘটিত করার চেষ্টা করার অপরাধে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমানের কারাগারে মাসের পর মাস কাটালাম। নিজ ও পরিবারে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ৭৯ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হল্যান্ড হয়ে জার্মান পালিয়ে এলাম। জার্মান থেকে একসময় আমেরিকা। সেই থেকে আজ অবধি আমেরিকা প্রবাসী।
প্রাণের সংগঠন আওয়ামী লীগ ১৮ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে থাকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার আর দেশে ফেরা হয়নি। দেশে পা না রাখলেও রাজনীতি থেকে মুখ ফেরাতে পারিনি। জার্মান হোক আর আমেরিকা রাজনীতি সবখানে তাড়া করে ফিরে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালন করি বলে দলের পতাকা আর কালো মুজিব কোট কখনো ছিড়ে ফেলতে পারিনি। জার্মান, আমেরিকা যেখানেই হোক শক্ত হাতে হাল ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। সচল ছিলাম যতদিন দলের প্রয়োজন ছিল ততোদিন। রাজনীতি যারা করে, তাদের জন্য রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া মানেই জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া। আমার কাছে ইদানিং তাই মনে হয়। মনে হয় আমিও জীবন থেকে হারিয়ে গেছি। দৈহিকভাবে অনেক কিছু থেকে সরে থাকা সহজ হলেও মন থেকে অনেক চেষ্টা করেও সরে থাকা যায় না।
সম্পর্কিত খবর
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক একটা বাংলাদেশ চেয়েছিলাম আমরা। ৭১ সালের নয়মাস ভারতে থেকে দিনকে রাত আর রাতকে দিন দেখেছি । স্বপ্ন শুধু একটাই ছিল। আমরা মুক্তি পাবো। মুক্তি আসেনি। ৭৫ সালের পর দেশে কালো অধ্যায়ের শুরু হয়েছিল । বঙ্গবন্ধুর কন্যা শক্ত হাতে হাল ধরায় আমরা সেই বিভীষিকা থেকে আজ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।
৭১ সালে যুদ্ধ শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল না। ছিল মুক্তির জন্য যুদ্ধ। মানুষ যুদ্ধ করেছিলো। আর তা ছিলো ‘মুক্তির’ যুদ্ধ। আর সেই মুক্তি ছিল অর্থনৈতিক মুক্তি। আজ আমরা সেই মুক্তির পথেই হাটছি। ভালো লাগে দেশ যখন ভালো থাকে। তবে খারাপ লাগে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের খারাপ অবস্থা দেখে। রাজনীতি এখন এমন এক জায়গায় এসে গেছে যে, এক সময় রাজনীতি করতাম বলতেও সংকোচ বোধ করি। ৭০ দশকে যখন ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত ছিলাম, তখন রাজনীতিবিদদের নিয়ে মানুষ ইতিবাচক চিন্তা করতো। এখন নীতিবাচক মনোভাব পোষন করে। রাজনীতি আর রাজনীতিবিদের সংজ্ঞাই যেনো বদলে গেছে।
আমি এক সময় লিখতাম। এখন আর লিখি না। লিখার অভ্যাস হারিয়ে গেছে। ৪০ বছর থেকে দেশের বাইরে থেকে থেকে ভাষা জ্ঞানও প্রায় তলানিতে। আজকে হঠাৎ করে আমার এই লিখা। লিখারও একটা কারণ আছে। কোন কিছুই কারণ ছাড়া ঘটে না। আমার এই লেখারও একটা কারণ আছে। যাদেরকে ম্যাসেজ দেবার জন্য আমার এ লেখা যদি তা তাদের নজর কাড়ে তাহলে মনে করবো লেখাটা সার্থক হয়েছে।
কিছু দিন আগে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হলো। ১৮ বছর পর দলের কাউন্সিল। আর আরো কতো বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ভালো কথা আমার এতে কোন আপত্তি নেই। আর আমি আপত্তি করারই বা কে? তবে একসময় সংগঠনের করতাম। দেশে বিদেশে অনেক সময় দলের দায়িত্বশীল পদেও ছিলাম বলে পুরাতন দাবী নিয়ে লিখছি। নেতৃস্থানীয় যারা তাদের উদ্দেশ্যে দু’একটা কথা বলার জন্যই লিখা। প্রায় ৪০ বছরের উপরে আমি দেশ ছেড়ে প্রবাসে। বিরাট এক শূন্যতা। দেশের অনেককে চিনি । অনেককে চিনি না। আমার আগে অনেকে আওয়ামী লীগ করেছেন। অনেকে আমার পরে আওয়ামী লীগে এসেছেন। কেউ কেউ আমার সহযোদ্ধা ছিলেন। আমি যাদেরকে চিনি, তাদেরকে নিয়ে আমি বলতে পারি। অন্যদের নিয়ে আমার কথা বলার অধিকার নেই।
জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অনেকের স্থান হয়েছে আবার অনেকের স্থান হয়নি। নেতাদের কাছে যোগ্যতার মাপকাটিতে যারা যোগ্য বলে বিবেচিত হননি তারা বাদ গেছেন আর যারা যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ করেছেন তারাই স্থান পেয়েছেন। তবে আমি এই মাপকাঠি নিয়ে একটু কথা না বলে পারছি না। বিশেষ করে আমার সময়ের ছাত্র রাজনীতির দু’জন ভ্যানগার্ডকে নিয়ে কথা বলতে চাই। এই দু’জন সেই সত্তর দশক থেকে আওয়ামী ঘরনার লোক। দলের জন্য নিবেদিত অন্তঃপ্রাণ। ঝড় তুফানে তারা ভেঙে যাননি। আদর্শ থেকে এক চুল নড়েননি। দলের প্রভাব খাটিয়ে, দলের সাইনবোর্ড বিক্রি করে চলেননি। বিগত কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও কি অপরাধে বর্তমান কমিটি থেকে তাদেরকে বাদ দেয়া হলো, তা বোধগম্য নয়। কি অযোগ্যতায় তারা অযোগ্য হলেন, তাও জানি না।
সুরমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান, থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মহকুমা যুবলীগের সভাপতি। জেলা কমিটিতে বার বার স্থান পাওয়া আমির হোসেন রেজা এবং মহকুমা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য মতিউর রহমান পীরের কথা আমি বলছি। আমীর হোসেন রেজা আর মতিউর রহমান পীরকে নিয়ে আমি রাজনৈতিক মাঠে হাল চাষ করেছি।
আমীর হোসেন রেজা নিজের জীবন বাজি রেখে দলের জন্য যুদ্ধ করেছেন। আজও সে সেই যুদ্ধের মাঠে আছে। যাদের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ছিলো তারা আজ কমিটিতে। আমীর কমিটির বাইরে। দলের জন্য যার রক্ত ঝরে সে সামান্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রতীক পাবার অধিকার রাখেন না। রাখে কে?
মতিউর রহমান পীর না থাকলে ৭৫ সালের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিলো ছাত্রলীগের সেই শূন্যতা কে পূরণ করতো? একজন সাহসী মানূষ খোঁজে পাইনি যাকে আমি দায়িত্ব দিয়ে আসবো। ৭৫ সাল থেকে কয়েক বছর সামরিক জান্তার ভয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম কেউ মুখে নিতে সাহস পেতো না। মতির মতো সাহসীরা ছিলো বলে আমি সাহস পেয়েছিলাম। ঘরোয়া রাজনীতির অনুমোদন দেওয়ার পর মতিউর রহমান পীরের হাতে মুজিবের আদর্শের ঝাণ্ডা তুলে দিয়ে আসতে পেরেছিলাম। তিনি এক চুল পরিমান তার নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুৎ হননি। ক্ষমতা হাতছানি দিয়ে ডাকলেও মতিউর রহমান পীর নিজ দলের সাথে বেঈমানি করেননি। দলের প্রতি ‘লয়েল থাকাটাই কি তার অযোগ্যতা? সেই অযোগ্যতেই কি তার কমিটিতে পদ না পাওয়ার কারণ?
আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। হয়তো কারও ভুল হতে পারে, হয়তো অজ্ঞতা হতে পারে। শুধরে নিলে অপমানের কিছু থাকে না। উদারতা মানুষকে ছোট নয়, মহান করে। আমরা কি মহান হতে পারি না?
(লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া)