• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনে কয়লা উত্তোলন স্থবির

প্রকাশ:  ২৩ মে ২০১৮, ১৭:১৩ | আপডেট : ২৩ মে ২০১৮, ১৭:২০
সুলতান মাহমুদ (দিনাজপুর)

শ্রমিকদের ১৩ দফা ও গ্রামবাসীদের ৬ দফা দাবিতে গত ১১ দিন ধরে আন্দোলন করছেন দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির শ্রমিক-কর্মচারীরা। দাবি আদায়ে কর্মবিরতির পাশাপাশি শুরু করেছেন অবরোধ কর্মসূচি। এদিকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ বলছেন, ‘শ্রমিকদের যে পরিমাণ বেতন-ভাতা দেওয়া হয় তাতে চলমান আন্দোলন অযৌক্তিক। এরপরও দাবি-দাওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।’ তবে শ্রমিকদের দাবি, কর্তৃপক্ষের দেওয়া বেতন-ভাতার বিবরণ শুধু কাগজে কলমে। চুক্তি এবং ঘোষণা দিলেও সেই পরিমাণ বেতন-ভাতা শ্রমিক কর্মচারীরা পান না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।

এদিকে চলমান আন্দোলনে সরকারি ক্ষতির পাশাপাশি বেতন-ভাতা না পাওয়ার আশঙ্কা শ্রমিকদের। তবে কর্তৃপক্ষ বলছেন, কয়লা উত্তোলনের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। এ কারণে কয়লা উত্তোলন না হলেও সরকারের কোনও ক্ষতি নেই।

আউটসোর্সিং শ্রমিকদের স্থায়ী নিয়োগ প্রদান, বকেয়া বেতন-ভাতা দেওয়া ও প্রফিট বোনাসসহ ১৩ দফা দাবিতে গত ১৩ মে সকাল ৬টা থেকে লাগাতার কর্মবিরতি পালন করছেন খনির এক হাজার ৪১ জন শ্রমিক-কর্মচারী। সাথে যোগ হয়েছে গ্রামবাসীদের ৬ দফা দাবি ।

তাদের মূল দাবিগুলো হলো, অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী আউটসোর্সিং শ্রমিকদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া, বকেয়া ৯ মাসের বেতন-ভাতা ও প্রফিট বোনাস দেওয়াসহ ফেস বোনা ও বিভিন্ন ভাতা এবং চুক্তি অনুযায়ী সব শ্রমিককে নিয়োগ দেওয়া। এছাড়াও প্রতি বছর শতকরা ৪০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক নিয়োগ, সব শ্রমিকদের ক্ষেত্রে গ্রাচুইটি, আন্ডারগ্রাউন্ড শ্রমিকদের ৬ ঘণ্টা ডিউটি করানো, ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি গ্রামের বাড়িঘরের দ্রুত ও স্থায়ী সমাধান, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার প্রত্যেক পরিবার থেকে খনিতে চাকরি দেওয়া প্রভৃতি।

এরই মধ্যে গত ১৫ মে সকালে শ্রমিকদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তখন এক পুলিশ সদস্যসহ কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় শ্রমিক ও এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় ৩৪ জনের নাম দিয়ে অজ্ঞাত আরও ৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে এই ঘটনায় ১৪ কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা দিয়েছেন শ্রমিকরা।

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কর্তৃপক্ষ জানান, গত বছরের আগস্ট মাসে শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি/সিএমসি। যেখানে গত চুক্তির যে বেতন কাঠামো ছিল তার প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি করা হয়েছে। একই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাদি।

তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাপ্তাহিক ছুটিসহ খনির প্রোডাকশন ও ডেভেলপমেন্ট সেকশনের ফোরম্যানের মাসিক বেতন ছিল ১৪ হাজার ৬৪০ টাকা। বর্তমানে তা করা হয়েছে ৩২ হাজার ৭০ টাকা। একই সেকশনের দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১২ হাজার ৮৭০ টাকা, বর্তমানে তা ২৭ হাজার ২০ টাকা। অদক্ষ শ্রমিকরা বেতন ১১ হাজার ৭০ টাকার স্থলে এখন পাবেন ২৫ হাজার ৯৫ টাকা। আন্ডারগ্রাউন্ড সার্ভিসেস সেকশনের ফোরম্যানের বেতন ১৩ হাজার ৪১০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৭০ টাকা, দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১১হাজার ৬শত ৭০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ২৪ হাজার ৩২০ টাকা, অদক্ষ শ্রমিকের বেতন ১০ হাজার ৭৪০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ২২ হাজার ৮২০ টাকা। সারফেস সেকশনের ফোরম্যানের বেতন ১০ হাজার ৭৪০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ২১ হাজার ৭০ টাকা, দক্ষ শ্রমিকের বেতন ৯ হাজার ৮১০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ১৮ হাজার ২০ টাকা, অদক্ষ শ্রমিকের বেতন ৮ হাজার ৯১০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫ টাকা। প্রশাসন সেকশনের ফোরম্যানের বেতন ৯ হাজার ৬৯০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ২১ হাজার ৭০ টাকা, দক্ষ শ্রমিকের বেতন ৯ হাজার ২৭০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ১৮ হাজার ২০ টাকা এবং অদক্ষ শ্রমিকের বেতন ৮ হাজার ৮৮০ টাকার স্থলে করা হয়েছে ১৭ হাজার ৪৫ টাকা। একই সঙ্গে প্রতি টন কয়লার উৎপাদন বোনাস ২৫ টাকা, ৩ মাসের গড় মজুরি ৫০% ইন্সটলেশন ও স্যালভেজ বোনাস, বছরে দুটি উৎসব বোনাস, ২৫ টাকা হারে শিফট অ্যালাউন্স ও ২০ টাকা হারে পরিবেশ অ্যালাউন্স, প্রতিবছর ১০% হারে দক্ষ শ্রমিকে পদোন্নতি দেওয়াসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা ও অসুস্থতা জনিত ছুটি। এছাড়াও প্রতি বছর ৫% হারে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, কর্মস্থলে মৃত্যুর ইন্স্যুরেন্স ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা থেকে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা, স্বাভাবিক মৃত্যুর ইন্স্যুরেন্স ৩ লাখ ৯৬ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা, কর্মস্থলে অঙ্গহানি হলে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা থেকে ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা দেওয়া হবে। শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য রয়েছে একজন বাংলাদেশি চিকিৎসকসহ ৩ জন চিকিৎসক।

তবে শ্রমিকদের অভিযোগ,খনির ভেতরে তাপমাত্রা ৬০-৬৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই পরিমাণ তাপমাত্রায় কাজ করতে গিয়ে তারা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা অসুস্থ্যতা জনিত ছুটি কাটালে তাদের বেতন কাটা হয়। যে কারণে মাসিক বেতন-ভাতার অর্ধেকও তারা পান না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে তারা বড় সমস্যার মধ্যে আছেন।

কয়লা খনির শ্রমিক রফিকুল ইসলাম জানান, তার বেতন ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু যে পরিমাণ তাপমাত্রায় তাদের কাজ করতে হয় তাতে ২ দিন কাজ করলেই তারা অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। এ কারণে তারা পুরো মাস কাজ করতে পারেন না। আবার সাপ্তাহিক ছুটি হিসেবে মাসে ২৬ দিন কাজ করার কথা থাকলেও ৩০ দিন কাজ না করলে বেতন কেটে নেওয়া হয়।

শ্রমিক সিরাজুল ইসলাম জানান, সাত জন সদস্য নিয়ে তাদের পরিবার। মাসের ২০ দিনের বেশি কাজ করা সম্ভব হয় না। সেই হিসেবে মাসে ২০ দিনের বেতনই তাকে দেওয়া হয়। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার কথা থাকলেও তাদেরকে সেটা দেওয়া হয় না।

শ্রমিক হযরত আলী জানান, যদি চুক্তি অনুযায়ী ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হতো তাহলে শ্রমিকরা আন্দোলনে যেতো না। কর্মকর্তারা লাখ লাখ টাকার প্রফিট বোনাস পায়। আর যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কয়লা উত্তোলন করে তাদের ন্যায্য দাবি টুকুও পূরণ করা হয় না। বাড়ির সদস্যদের ঠিকভাবে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিব সেটাও পারি না। এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে?’

বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি রবিউল ইসলাম জানান, ৩০ দিনের মধ্যে ২৬ দিন কাজ করার চুক্তি থাকলেও পুরো মাসই কাজ করতে হয়। আর তা না করা হলে দিন হাজিরা হিসেবে ২৬ দিনের টাকা দেওয়া হয়। আর কেউ যদি ২০ দিনের নিচে কাজ করেন তাহলে ২০ দিনের দৈনিক বেতনের ২০ শতাংশ কম দেওয়া হয়। ১০ দিনের নিচে কাজ করলে ১০ দিনের বেতনের ৫০ শতাংশ কম দেওয়া হয়। যার কারণে শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।

তিনি জানান, যৌক্তিক দাবি দাওয়া নিয়েই শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। কিন্তু আন্দোলনে থাকা দিনেগুলোর বেতন-ভাতা দিবে কি এ নিয়ে শ্রমিকরা শঙ্কার আছে। এই আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের লোকসানের পাশাপাশি সরকারি কোটি কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে বলে তিনি জানান।

ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান জানান, বেতনের যে বিবরণী দেওয়া হয়েছে তা যদি দেওয়া হতো তাহলে শ্রমিকরা আন্দোলনে যেতো না। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে বার বার বলা সত্বেও কোনও কাজ হয়নি। বরং শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কর্মকর্তারা হামলা চালিয়ে শ্রমিকদের জখম করেছে। এই ঘটনায় উল্টো শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মসূচি পালন করছে আশেপাশের ক্ষতিগ্রস্ত ২০টি গ্রামের মানুষ। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ২০ গ্রামের সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক মশিউর রহমান বুলবুল জানান, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি এলাকার নিকটবর্তী গ্রামগুলির বাড়িঘর ও জায়গাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় কয়লা খনির কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আংশিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফাটল অবস্থায় এলাকায় বসবাস করা দুরুহ হয়ে পড়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে সমাধান চাওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাছাড়া কয়লা খনিতে যারা শ্রমিক তারা এই এলাকারই মানুষ। শ্রমিকদের বেতন ভাতা না দেওয়ায় তারা অনেক কষ্টে আছে। তাই চলমান আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখা হবে বলে তিনি জানান।

এদিকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির কর্মকর্তারা বলেন,‘শ্রমিক-কর্মচারীদের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে। এরপরও তাদের শ্রমের মর্যাদা কর্তৃপক্ষ দিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও দিবে। ’

খনির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আবুল কাশেম প্রধানিয়া জানান, শ্রমিকরা চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি/সিএমসি’র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। তাদের কিভাবে বেতন দেওয়া হবে সেটা চুক্তির মধ্যেই বলা হয়েছে। এরপরও তাদের যে দাবি সেটি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়েছে। চেয়ারম্যান দেশের বাইরে রয়েছেন, তিনি ফিরে আসলেই বিষয়টি সমাধান করা হবে। তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু পদক্ষেপ নিবেন।

আন্দোলনের ফলে সরকারিভাবে লোকসানের বিষয়ে কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দীন আহাম্মদ জানান, শ্রমিকরা যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করবে সেই পরিমাণ অর্থ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হবে। সেখান থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিবে। কয়লা যেহেতু মাটির নিচেই রয়েছে সেহেতু কোনও লোকসান নেই। আন্দোলন কর্মসূচি চলাকালে যে পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা হতো কাজ শুরু হলে বেশি শ্রম দিয়ে সেই পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করে এ ঘাটতি পূরণ করা হবে।’

তিনি জানান, ইতিমধ্যেই চীনা শ্রমিক দিয়ে কয়লা উত্তোলন শুরু করা হয়েছে। আর খনির ইয়ার্ডে এখনও ২ লাখ মেট্রিক টনের বেশি কয়লা মজুদ রয়েছে যা দিয়ে দিয়ে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২ মাস চালু রাখা সম্ভব। এর ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনও ধরনের সমস্যা হবে না। তবে শ্রমিদের আন্দোলনের ফলে খনির কর্মকর্তা-কর্মচারি ও বিদেশিসহ প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।

ওএফ

শ্রমিক,কর্মচারী,আন্দোলন,কয়লা,উত্তোলন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close