• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

শাহনাজ মুন্নীর গল্প: আত্মাশিকার

প্রকাশ:  ১৬ জুন ২০১৮, ০৩:৪৮
ঈদ সাহিত্য
লোকটা যে আমার সঙ্গে নির্জলা মিথ্যা কথা বলছে, আমি সেটা প্রথম বাক্য বলার পরই বুঝতে পারলাম। এখন আমি অপেক্ষা করছি লোকটা কী পরিমাণ মিথ্যা কথা বলতে পারে, সেটা দেখার জন্য এবং আরেকটা বিষয়ও আছে দেখার, লোকটা কতখানি বিশ্বাসযোগ্যভাবে মিথ্যা বলতে পারে। মিথ্যাচর্চা খুবই কঠিন শিল্পকলা, খুব সাধারণ কারও পক্ষে এই কলায় সাফল্য অর্জন সম্ভব হয় না। ‘জানেন, আমি তিনবার মরেছি।’

সম্পর্কিত খবর

    থেমে থেমে, সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে, পরিষ্কার উচ্চারণে বললেন তিনি। এই সময় আমার কাজের চাপ কম। সকালের প্ল্যানিং মিটিং সেরে যখন আগামীকালের কাজের ছক সাজাচ্ছিলাম, তখনই লোকটার আগমন। ‘প্রথমবার মরেছিলাম এক নারীর জন্য। সে রূপসী ছিল। তবে সে ছিল ক্রন্দসী। খালি কানতো। বিশ্বাস করবেন না, তার চোখের প্রতিটি অশ্রুকণার সঙ্গে বেরিয়ে আসত মূল্যবান সব রত্ন, হীরা, মোতি, পান্না। হাসপাতালে প্রথম সাক্ষাতে শুধু তার আকুল কান্নাই দেখেছিলাম আমি। কিন্তু দ্বিতীয় সাক্ষাতে সে আমার দিকে ছুড়ে দিয়েছিল তার দেহখানি। বলেছিল, “আসগর আলী, এটা নাও তুমি। আমার দেহ তোমাকে দিলাম। এর ভেতর তুমি আত্মা উৎপাদন করো।”’ সালেহা খাতুন ফিলোসফিতে মাস্টার্স ছিল। ফলে আত্মাটাত্মা নিয়ে তার হয়তো কোনো অধিবিদ্যা জানা ছিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। কারণ, দেহের ভেতর কেমন করে আত্মা উৎপাদন করতে হয়, আমার জানা ছিল না। ‘সালেহা, কাজটা কীভাবে করে কও তো?’ আমি বোকার মতো প্রশ্ন করি। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সালেহা হেসে ওঠে। আর হাসলে সালেহার মুখ থেকে ঝরে পড়ে রাশি রাশি রক্তগোলাপ। সেই গোলাপস্তূপের ভেতর থেকে কথা কয় সালেহা। ‘তুমি কেমন পুরুষ আসগর? তোমাকে আমারই শিখিয়ে দিতে হবে কেমন করে দেহে আত্মা উৎপাদন করতে হয়? তুমি তো দেখি একটা বেকুব!’ আমি ম্লান হই। নিজেকে আমার মনে হয় মোগল প্রাসাদের বোকা ভাঁড়। অসহায়ের মতো বলি, ‘আত্মা কেমন সালেহা খাতুন! কেমনে তাকে উৎপাদন করে? আমি তো কখনো শুনছি আত্মা বায়বীয়, কখনো শুনছি তরল জলের মতো তার রূপ, এহেন বহুরূপী নিরাকার বস্তু উৎপাদনের সাধ্য কী মানুষের আছে? বলো, তুমি। পাথরের সঙ্গে পাথর ঘষে আগুন তৈরি করা যায়, মেঘের সঙ্গে মেঘের ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকায়, কিন্তু দেহের সঙ্গে দেহের ঘর্ষণে কি আত্মা জন্মায়?’ সালেহা কোনো উত্তর না দিয়েই তার নীল বর্ণের শক্ত ও শীতল মৃতদেহ কাঠের টেবিলে ফেলে রেখে কে জানে কোথায় যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সেই থেকে আত্মা খোঁজার চেষ্টায় রত আছি আমি। জানেন, শুধু আত্মাকে চেনার জন্য একদিন উন্মাদ হয়ে নিজেই নিজেকে খুন করি, সেই আমার প্রথম মৃত্যু। লোকটার মিথ্যা বলার কুশলতায় এবার মুগ্ধ হওয়ার পালা আমার। কী সুন্দর সহজ মিথ্যা! মনে হচ্ছে মিথ্যার আর্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছে সে। ঈশ্বর, আমাকে এই মিথ্যা সহ্য করার মতো ধৈর্য দিন। আমি দেখতে চাই, এই মিথ্যাকে টেনে টেনে শেষ পর্যন্ত কতটা লম্বা করতে পারে সে। ‘আত্মাকে তাহলে চিনতে পারলেন?’ একটু বিদ্রুপের সুরেই প্রশ্ন করি তাকে। হয় প্রশ্নটি সে শুনতেই পায় না অথবা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনই মনে করে না। যেন নিজের সঙ্গেই নিজে আত্মভোলার মতো কথা বলে যায় সে। আমি এই ফাঁকে লোকটির বয়স আন্দাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, তার চেহারার বিশিষ্টতা খুঁজি। ঠান্ডা মায়াভরা সাধারণ চেহারা, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, এই লোক যে এতটা বাটপার, কেউ তার কথা না শুনলে হয়তো বিশ্বাসই করবে না। ‘সেই মৃত্যুতে আমার আত্মা দেহমুক্ত হলো, ছড়িয়ে পড়ল জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে, আমি ক্রমেই ক্ষুদ্র হয়ে একটি পাখির ডিমে আশ্রয় নিলাম আর তারপরক্ষ কী নরম পালকের তাপে পেলাম পাখিজীবন। উদ্দাম উড়াল শিখলাম, ডালে ডালে, পাতায় পাতায়, মেঘে মেঘে, রোদে-ছায়ায় নিশ্চিন্ত ওড়াউড়ি। তারপরও মন আমার অস্থির, বেপরোয়া পাখিদের জীবন মানুষের তুলনায় স্বল্পস্থায়ী, জানেন তো। আমার দ্বিতীয় মৃত্যু হলো এক শিকারির বিষমাখা তিরে, গাছের ডাল থেকে তিরের নির্মম খোঁচায় টুপ করে ঝরে পড়লাম মাটিতে, ঝরা পাতার বিছানায়। আমার কৌতূহলী আত্মা এবার লুকিয়ে পড়ল সবুজ বর্ণের মসৃণ ঘাসে। বহু মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হতে হতে, বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে বর্ষার ছোঁয়ায় আবার ধুম বেঁচে ওঠা, সে-ও ছিল এক দুর্দান্ত জীবন।’ লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার জানালার দিকে তাকায়, তার দৃষ্টি বাইরের এক চিলতে লনে, যেখানে অযত্নে বেড়ে উঠছে কিছু দুর্বল ঘাসের গুচ্ছ। ‘বহুদিন আমি ওই রকম নতমুখী নরম ঘাস হয়ে ছিলাম, মাটির অস্থি মজ্জায়, মাটির গন্ধে মিশে ছিলাম, একদিন ঘাস থেকে ঘাসে গড়াতে গড়াতে আমার আত্মা চলে এল এক নদীতে, সেখানে জমে থাকা কচুরিপানায় এবার আমার ভাসন্ত জীবন, নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে, জলের সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে, ছোট ছোট মাছ, সাপ, ব্যাঙ আর বিচিত্র জল-পোকাদের কিলবিলে অস্তিত্বের সঙ্গে গা ভাসিয়ে সে ছিল এক অন্য রকম পথচলা। একদিন দেখি, কচুরিপানার ঝাড়ে আটকে আছে লঞ্চডুবিতে ভেসে আসা এক যুবকের তরতাজা লাশ, কচুরিপানার লাস্যময়ী হালকা বেগুণি রঙের ফুলেরা যাদের আমি আদর করে সালেহা বলে ডাকতাম, তারাই তখন আমার আত্মাকে উসকানি দেয় ওই যুবকের দেহে প্রবেশ করতে, এখন এই যে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন, আমি লঞ্চডুবিতে নিখোঁজ হওয়া আতাউর, যাকে মৃত ভেবে আত্মীয়স্বজন মিলাদ ও দোয়া-দরুদ পড়িয়ে ফেলছিল।’ লোকটা তার দীর্ঘ যাত্রার বিবরণ দিয়ে সম্ভবত নিশ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থামে। তার এই ডাহা মিথ্যা গল্প এই একবিংশ শতাব্দীতে সে আমাকে কেন খাওয়াইতে চাইতেছে, বুঝলাম না। চোখটা সরু করে বললাম, ‘তাইলে আপনে আতাউর না, আপনে আসলে আসগর।’ ‘আসগর তো নাই, সে আত্মহত্যা করেছে।’ ‘ও, তাইলে আপনে আতাউর।’ ‘আতাউরের আত্মা এখন গাছের নিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে।’ ‘তাইলে আপনি একটা পাখি ছিলেন অথবা ঘাস বা নেহাতই জলে ভাসা কচুরিপানা।’ লোকটা কিছু বলে না। শুধু তার বড় বড় করুণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখ শুধু আমাকে না, যেন আরও দূরের কিছু দেখতে পাচ্ছে। ‘ধন্যবাদ। আপনি এবার যেতে পারেন। আমার জরুরি মিটিং আছে।’ যথাসম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে তাকে বিদায় করার জন্য বলি আমি। আসলে লোকটাকে তাড়ানোর সময় হইছে, অনেক চাপা মারছে, আর তাকে সুযোগ দেওয়া যায় না। কিন্তু লোকটার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে , তার ওঠার ইচ্ছা নেই, সে যেন অনন্তকাল বসে থাকার সংকল্প নিয়েই এখানে এসেছে। আসলে তার ধান্দাটা কী? এসব বানানো গল্প বলার উদ্দেশ্যইবা কী? ‘আ”ছা, আমার কাছে কেন আসছেন আপনি? হ্যাঁ? ভেবেছেন এসব আজগুবি মিথ্যা কথা বিশ্বাস করব? প্লিজ অন্য কোথাও যান। আমি এই ধরনের বুজরুকি একদম পছন্দ করি না।’ এবার একটু চড়া কণ্ঠেই বলি আমি। ‘এ রকম একটা মেঘলা দিনে প্রথম মৃত্যু হয়েছিল আমার, এ রকম একটা দিনেই শেষবারের মতো মরব আমি, কারণ আত্মার রহস্য আমার জানা হয়ে গেছে।’ লোকটা উঠে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটের কোনায় একটা অদ্ভুত হাসি ঝুলে থাকে। ‘জিজ্ঞেস করছিলা না, কেন আসছি তোমার কাছে, আসছি কারণ তুমি সালেহার পুত্র। তার আত্মার অংশ তোমাতেও আছে। তাই তোমাকে জানাইয়া গেলাম। আত্মার অলৌকিক ভ্রমণ-কাহিনি।’ লোকটা আর অপেক্ষা করে না। যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন হঠাৎই যেন মিলিয়ে যায়। তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবি, সত্য বটে, আমার মায়ের নাম সালেহা খাতুন। তিনি ১৯৮৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এমএ পাস করেছিলেন। শুনেছি, কোনো একটা অজানা অসুখ হয়েছিল তাঁর চোখে, যে কারণে সারাক্ষণই চোখ থেকে পানি ঝরত তাঁর। আমাদের ঘরে কয়েকটা বড় কাচের জারভর্তি নানা রঙের রঙিন পাথর রাখা আছে, সেগুলো আমার মায়ের চোখ থেকে ঝরে পড়া দামি রত্ন কি না, তা অবশ্য আমার জানা নেই। মাকে কখনো দেখিনি আমি। আমার জন্মের পরপরই বিষ পান করে মা আত্মহত্যা করেছিলেন। লেখক পরিচিতি : শাহনাজ মুন্নীর জন্ম ১৯৬৯-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায়। সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক। এটিএন বাংলার নিউজ এডিটর। সাংবাদিক হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পেলেও তিনি মূলত লেখক। এ পর্যন্ত গল্প উপন্যাস গবেষণা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা আঠারোটি। তার স্বভাবে আছে এক ধরণের নির্মোহতা। শিল্পেও তার প্রভাব দেখা যায়। তার গল্পে সবসময়ই একটা গল্প থাকে। চরিত্রগুলো বিকশিত হয় সহজিয়া প্রেরণায়। জবরদস্তি নয়, সহজাত নির্দেশনা ধরেই যেন তার কথাশিল্পের চরিত্রগুলো নিজস্ব পথে পদচারণা করেন। তার কথাশিল্পের ভাষা রসবোধসম্পন্ন, কাব্যসংলগ্ন ও স্বতস্ফূর্ত।
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close