• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

স্পেনের মাদ্রিদে এক টুকরো বাংলাদেশ

প্রকাশ:  ২৪ জুন ২০১৮, ১০:১০
কবির আল মাহমুদ (মাদ্রিদ)

ইউরোপের অন্যতম পর্যটন দেশ হিসেবে পরিচিত স্পেন। রাজধানী মাদ্রিদের এক বিখ্যাত অঞ্চল লাভাপিয়েস। ইউরোপের অন্যতম দুই ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ ও অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ এবং স্পেনের রাজার প্রাসাদ, অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র ও স্পেনের সাবেক রানি সুফিয়ার নামে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জাদুঘর রেইনা সুফিয়াকে নিয়ে লাভাপিয়েস গড়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক শহর হিসেবে।

প্রায় পাঁচ হাজার বাংলাদেশি পরিবারের বাস এই শহরে। তাদের মধ্যে প্রায় অনেকেই এ দেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। বাকিরাও নাগরিকত্ব পাওয়ার চেষ্টা করছেন। লাভসপিয়েসের ৯০ ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য বাংলাদেশিদের দখলে। স্পেনে বাঙালিয়ানা সংস্কৃতি লালনের কেন্দ্রবিন্দুও এই লাভাপিয়েস। বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামও দেওয়া হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির আলোকে। যেমন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নাম বাংলা সেন্টার, বাংলা টাউন, বাংলা বাজার ও মাতৃভূমি প্রভৃতি। এ ছাড়া আছে অসংখ্য বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট।

লাভাপিয়েস নামকরণ

আক্ষরিক অর্থে ‘লাভা’ মানে ধোয়া বা পরিষ্কার করা আর ‘পিয়েস’ মানে পা। অর্থাৎ লাভাপিয়েস বলতে পা ধোয়াকে বোঝায়। এ নামকরণ নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। ধারণা করা হয়, ১৪৯২ সালের আগে এই অঞ্চলে ইহুদিদের আবাস ছিল। প্লাজা লাভাপিয়েসে ছিল একটি ঝরনা। চার্চ লরেনজো ছিল পাশেই। ওই ঝরনার পানিতে পা ধোয়ার পর সবাই চার্চে ঢুকতেন। এভাবেই জায়গাটির নাম হয়ে যায় লাভাপিয়েস বা পা ধোয়া। ১৪৯২ সালে ইহুদিরা বিতাড়িত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে এখানে আরব বংশোদ্ভূতদের বসবাস শুরু হয়। নব্বই দশকে বাংলাদেশিরা মাদ্রিদের এই লাভাপিয়েস এলাকায় আসেন।

লাভাপিয়েস যেভাবে বাঙালিপাড়া

মাদ্রিদের জিরো পয়েন্ট খ্যাত ‘সল’ থেকে লাভাপিয়েস খুব কাছে। আর তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের ভালো একটা ক্ষেত্র হয়ে ওঠে অঞ্চলটি। স্পেনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। প্রবাসী বাংলাদেশিদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যকের পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য। এ ক্ষেত্রকে কাজে লাগাতেই তারা আসতে থাকেন এখানে। লাভাপিয়েস ও এর আশপাশে যতগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার শতকরা ৮০ ভাগই বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার পাশাপাশি রয়েছে গার্মেন্টস ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর খুচরা ও পাইকারি দোকান। অনেক রেস্টুরেন্টে আছে বাঙালি খাবার। আছে দেশি মাছ, শুঁটকি, শাক-সবজি, পান-সুপারির দোকান। নতুন কেউ লাভাপিয়েস এলাকায় এলে মনে করতে পারেন বাংলাদেশের কোনো একটা শহরে আছেন। মাদ্রিদে বাংলাদেশিরা যারা লাভাপিয়েসের বাইরে থাকেন, তাদের অনেকে কোনো না কোনো কাজে চলে আসেন লাভাপিয়েসে।

লাভাপিয়েসকে ‘বাঙালিপাড়া’ বা একখণ্ড বাংলাদেশে পরিণত করতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অবদানই বেশি। এমনটিই বলছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি খোরশেদ আলম মজুমদার বলেন, লাভাপিয়েসে বাংলাদেশিদের উত্থান ১৯৯৫ সালের পর থেকে। ১৯৯৪ সালে আমরা যখন এখানে আসি, তখন থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করি। ওই সময়ে হাতে গোনা কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। আবুল কালাম আজাদ, আবদুস সোবহান, জামাল উদ্দিনের পাশাপাশি আমিও দোকান করি। এরপর অনেকেই এখানে এসেছেন। আমাদের দেখাদেখি ব্যবসা শুরু করেছেন।

আমরা তাদের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা দিই। আস্তে আস্তে বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। এক সময় লাভাপিয়েসে ফাস্ট ফুড, রেস্টুরেন্ট, গার্মেন্টস ব্যবসাসহ সবক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এখানে ব্যবসা করে অনেকেই বছরে লাখ লাখ ইউরো উপার্জন করছেন। বাংলাদেশেও তুলনামূলক বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আজকের এই অবস্থানে আসতে আমাদের বহু চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে।

কমিউনিটি নেতা আশফাকুল হক ১৯৯২ সালে মাদ্রিদে আসেন। তিনি বলেন, লাভাপিয়েসে অনেকগুলো পাইকারি মূল্যের দোকানপাট ছিল। আরব বংশোদ্ভূতরা মূলত এই ব্যবসা করতেন। পাশাপাশি তখন বাংলাদেশি মালিকানাধীন দুই-একটি দোকানও ছিল। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখান থেকে পাইকারি মূল্যে জিনিসপত্র কিনতেন এবং বাইরে গিয়ে বিক্রি করতেন। যেহেতু পাইকারি মূল্যে জিনিসপত্র কেনার জন্য এখানে আসতেই হতো, তাই ক্রমান্বয়ে এই লাভাপিয়েসও এর আশপাশেই ঘর ভাড়া করে বাংলাদেশিরা থাকতে লাগলেন। আর এভাবেই একসময় বাংলাদেশিদের আবাসস্থল হয়ে যায় লাভাপিয়েস।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল আলম জানান, লাভাপিয়েসে অনেক আগে থেকেই অভিবাসীরা বসবাস করতেন। সেই সুবাদে অভিবাসীদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে প্রবাসী বাংলাদেশিদের। নব্বই দশকে বাংলাদেশিরা লাভাপিয়েসে আসেন। তবে সে সংখ্যা তখন খুব কম ছিল। অধিকাংশ বাংলাদেশি ইউরোপের অন্যান্য দেশে যাওয়ার করিডর হিসেবে স্পেনকে ব্যবহার করতেন। মূলত ২০০০ সালের পরেই এখানে বাংলাদেশিরা বসবাস করতে থাকেন। সময়ের পরিক্রমায় এই লাভাপিয়েসই হয়ে ওঠে বাংলাদেশিদের ব্যবসা-বাণিজ্য বা বসবাসের কেন্দ্রস্থল। লাভাপিয়েসে বর্তমানে দুই হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করছেন।

লাভাপিয়েসে বাঙালিয়ানা সংস্কৃতিচর্চা

বাংলাদেশের জাতীয় দিবসগুলো পালনের পাশাপাশি লাভাপিয়েসে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রম চোখে পড়ার মতো। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে লাভাপিয়েসে অস্থায়ী শহীদ মিনার স্থাপন করে ভাষা শহীদদের স্মরণ করেন এখানকার প্রবাসীরা। অনুষ্ঠানে যোগ দেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারাও। এখানে রয়েছে বাংলাদেশিদের পরিচালনাধীন দুটি মসজিদ ও ইসলামি সেন্টার।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নতুন প্রজন্ম মাদ্রিদে যারা বেড়ে উঠছে তাদের বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার জন্য কয়েকজন বাংলাদেশি মিলে গড়ে তুলেছেন মান্নান বাংলা স্কুল। স্পেনের মতো একটি ব্যয়বহুল দেশে এ ধরনের স্কুল পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। আর্থিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা থাকলেও শুরুতে বাংলা বইয়ের ব্যবস্থা অপ্রতুলতা ছিল। কয়েকজনের সার্বিক প্রচেষ্টায় সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়।

বাংলা স্কুলের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন দীন মোহাম্মদ মজুমদার ওরফে মান্নান। তিনি ২০১০ সালের ২২ এপ্রিল মারা যান। তখন তাঁর নামে স্কুলটি নামকরণ করা হয়। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মনোয়ার হোসেন। তখন বাঙালি অধ্যুষিত লাভাপিয়েসে একটি ঘর ভাড়া করে স্কুলের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। শিক্ষার্থী ছিল ৮৬ জন। আর্থিক সংকটে এই স্কুল ২০১৪ সালে বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের বাংলা ভাষা চর্চা। এরপর কেটে যায় প্রায় দুই বছর। ২০১৬ সালে শুরুতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন স্পেন এগিয়ে আসে সহযোগিতায়।

অ্যাসোসিয়েশন তাদের হলরুমটি বাংলা স্কুলকে সপ্তাহের শনিবার ও রোববার বিকেল ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ব্যবহার করার জন্য বরাদ্দ দেয়। বর্তমানে স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০ জন। এখানে প্রতি শনিবার ও রোববার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছেলেমেয়েদের বাংলায় পাঠদান করানো হয়। তাদের পরিচয় করে দেওয়া হয় বাংলা বর্ণমালা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে। স্কুলে চারজন শিক্ষক রয়েছেন। তাঁরা হলেন শামিমা হোসেন, লুৎফুন্নাহার, জ্যোৎস্না বেগম ও হালিমা তাহমিনা। তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে মাতৃস্নেহে স্কুলে আগত শিশু-কিশোরদের বাংলা শেখান।

সুখের বিষয়, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছেলেমেয়েরা স্প্যানিশ ভাষার পাশাপাশি এখন বাংলা লিখতে-পড়তেও জানে। এ ছাড়া তারা সুর করে গাইতে জানে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। তারা জানে পয়লা বৈশাখ আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস, আমাদের গর্ব ও অহংকার।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন স্পেনের সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজমান সুন্দর বলেন, আপাতদৃষ্টিতে এই প্রচেষ্টা ক্ষুদ্র প্রয়াস মনে হলেও আমি মনে করি এটা বিরাট কিছু। স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এবং ভিনদেশের ভাষা আর সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা এই ছেলেমেয়েগুলোর আর হয়তো কখনো বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া হবে না। কিন্তু তারাই ভিনদেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। ভিনদেশের মানুষকে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন স্পেনের হলরুমটি বাংলাদেশিদের সমাবেশ কেন্দ্রও। এই হলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব বিশেষ করে ঈদ ও পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপিত হয়। অনেক অনুষ্ঠানও উদ্‌যাপন করা হয় এই হলে। একদিকে যেমন চলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাংলা শিক্ষা আর শেখানোর প্রচেষ্টা, অন্যদিকে চলে অভিভাবকদের কফি হাতে আড্ডা ও সভা-সমাবেশ।

সেই সব সভা-সমাবেশ এবং আড্ডার মূল বিষয়বস্তু থাকে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের রাজনীতি ও বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চাওয়ার প্রবল আকুতি। এ যেন ক্ষুদ্র আরেক বাংলাদেশ! এখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো প্রবাসী বাংলাদেশিরা মিলে মিশে সফল করেন। দল মত নির্বিশেষে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করতে ও মিলে মিশে থাকার আকাঙ্ক্ষা আছে সবার মাঝেই। যা বাংলাদেশি কমিউনিটির জন্য আশা জাগানিয়া বিষয়।

ওএফ

ইউরোপ,স্পেন,রিয়াল মাদ্রিদ,জাদুঘর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close