• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় ব্যাংক খাতে বাড়ছে অনৈতিক বাণিজ্য

প্রকাশ:  ১৮ জুলাই ২০১৮, ১৫:২৬
বিজনেস ডেস্ক

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমানত ও ঋণ সুদহার এক অঙ্কে (সিঙ্গেল ডিজিট) নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে থাকা আমানত চেয়েছিল ছয় শতাংশ সুদে। কিন্তু বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) ঘোষণার আইনগত বৈধতা না থাকায় ব্যাংক খাতে চলছে চরম বিশৃঙ্খলা।

যেসব ব্যাংক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও বিএবির ঘোষণা অনুযায়ী নির্ধারিত হারে আমানত সংগ্রহ করতে চাচ্ছে, তাদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে যেসব ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনে রাজি হচ্ছে, তারা আমানত পাচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানকে ছয় শতাংশ সুদ আর প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আন্ডার দ্য টেব্ল্ দুই-তিন শতাংশ কমিশন দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। এতে ব্যাংক খাতে অনৈতিক বাণিজ্য বাড়ছে। বৈধভাবে ব্যাংকিং এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। পাশাপাশি সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণার বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়।

গত মাসে ব্যাংকের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। তখন বিএবি নেতারা বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট করা হচ্ছে। যেসব ব্যাংক এ নির্দেশনা মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য আমানত সংগ্রহের ওপর ছয় শতাংশ ও ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদহার ঘোষণা করে ব্যাংকগুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিল। গত ১ জুলাই থেকে নির্দেশনা বাস্তবায়নে অনেক ব্যাংকই সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে।

কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ছয় শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল), বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) ও বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) ছয় শতাংশ সুদে আমানত দিতে রাজি নয় ব্যাংকগুলোকে। তাদের কাছ থেকে আট থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো।

এদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকের মধ্যে এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ও মেঘনা ব্যাংক লিমিটেড এখনও ছয় শতাংশে আমানত পাচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে আট থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহ করছে।

অবশ্য বেসরকারি ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকগুলো এখনও ছয় শতাংশ সুদে আমানত দেওয়া শুরু করেনি। আর ছয় শতাংশ সুদে আমানত না পেয়ে বিপাকে পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে নগদ টাকার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে এক্সিম ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আমানত না পেয়ে ঋণ সুদের হার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পারেনি।

সূত্র জানিয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত সংগ্রহ নিয়েও চলছে কমিশন বাণিজ্য। লিখিত সুদহারের বাইরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দিতে হচ্ছে আন্ডার টেবিল অর্থ। অবৈধ এ লেনদেনের খরচ ‘কস্ট অব ফান্ড ম্যানেজমেন্ট’ খাতে দেখাচ্ছেন কর্মকর্তারা। অর্থাৎ, আমানত সংগ্রহে এই অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়েছে ব্যাংকের। ফলে যে ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতও যাচ্ছে ওই ব্যাংকে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, বিএবি একটি সমিতি মাত্র। তারা এমন ঘোষণা দিয়ে বাধ্য করাতে পারে না। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার নামিয়ে আনতে চান, তাই ব্যাংকগুলো সুবিধামতো সময়ে এটি করতে পারে। কিন্তু এভাবে বাস্তবায়ন করতে গেলে মুনাফা ঠিক রাখতে গিয়ে অনেক ব্যাংকে হিডেন চার্জ বাড়বে। গ্রাহকের অজান্তেই টাকা কেটে রাখবে তারা।

অবশ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছয় শতাংশ সুদে আমানত দিতে রাজি হয়েছে ওয়াসা, বাংলাদেশ হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন ও বাংলাদেশ টেলি কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উন্নয়ন কাজে সরকারের সহযোগী হতেই ছয় শতাংশ সুদে আমানত দিতে সম্মত হয়েছেন তারা।

সাধারণত শতকোটির ওপরে বা কোটি টাকার বড় অঙ্কের আমানতগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানেরই থাকে। আগের সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানের মোট আমানতের ২৫ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যেত। সেই হার ৫০ শতাংশ করা হয়েছে সম্প্রতি। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ থাকা এসব অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকে ফেলে রাখে কাজ শুরুর আগ পর্যন্ত। ধীরে ধীরে প্রয়োজনমতো প্রকল্পের কাজে টাকা সংগ্রহ করা হয়। এজন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে সুদ দেয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত অর্থ তথা রিজার্ভও বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা হয়। এতে প্রাপ্ত সুদে সরকারি প্রতিষ্ঠানের আয়ও বাড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার বিষয়টি মৌখিকভাবে আলোচনা হয়েছে সব পর্যায়ে। সুদের হার কমনোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো লিখিত নির্দেশনা নেই। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনো ধরনের সার্কুলার জারি করেনি। এজন্য সুদের হার নামিয়ে আনতে আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই ব্যাংকগুলোর। ফলে যাদের কাছে পর্যাপ্ত মূলধন আছে, তারাই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে পারছে, কিন্তু কম সুদে আমানত না পেলে একপর্যায়ে তারাও সমস্যায় পড়বে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি এক ব্যাংকের ডিএমডি বলেন, তাদের পর্যাপ্ত মূলধন আছে। তাই ১ জুলাই থেকেই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ শুরু হয়েছে। তবে এখন ছয় শতাংশ সুদে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে ঋণ সুদের হার কীভাবে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনবে ব্যাংকগুলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। তাই সংশয় তৈরি হয়েছে এমন ঘোষণার বাস্তবায়ন নিয়ে।

ওএফ

ব্যাংক
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close