• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আমদানির নামে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার

প্রকাশ:  ১৯ জুলাই ২০১৮, ০৯:৪৭
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

পণ্য আমদানির নামে দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলে পণ্যের দেনা শোধ করা হচ্ছে নিয়মমতো। কিন্তু পণ্য আসছে না। অনেক সময় পণ্য এলেও কনটেইনারে নির্ধারিত পণ্যের বদলে পাওয়া যাচ্ছে পরিত্যক্ত লোহা, রড, সিমেন্ট, চাল, ডাল- এসব কম দামি পণ্য।

পণ্য না আসায় বা ঘোষিত পণ্যের বদলে ভিন্ন পণ্য আসায় ব্যাংকের টাকা আদায় হচ্ছে না। ব্যাংক বাধ্য হয়ে ফোর্সলোন (বাধ্যতামূলক ঋণ) তৈরি করে এলসির দেনা শোধ করছে। এভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে।

সম্পর্কিত খবর

    এছাড়া এলসির বিপরীতে ভুয়া বিল অফ এন্ট্রি ব্যাংকে জমা দিয়ে পণ্য দেশে আনার প্রমাণ দেখাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বাস্তবে পণ্য দেশে আসেনি। আবার অনেকেই বিল অফ এন্ট্রি জমাই দেয়নি। এভাবেও দেশ থেকে টাকা পাচার হচ্ছে।

    বাংলাদেশ ব্যাংক ও শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের তদন্তে এসব ঘটনা বেরিয়ে আসছে। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে আমদানির নামে দেশ থেকে হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা ধরা পড়ে। এসব ক্ষেত্রে এলসির বিপরীতে পণ্য দেশে না এনে, এক পণ্যের ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য এনে এবং পণ্য না এনে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে মুদ্রা পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন তদন্তে সোনালী, বেসিক, বাংলাদেশ কমার্স, সোস্যাল ইসলামী, আল-আরাফাহ ইসলামী, ঢাকা, স্ট্যান্ডার্ড, সিটি, প্রিমিয়ার ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে খোলা এলসির ক্ষেত্রে জটিলতা পেয়েছে।

    এর সঙ্গে বেক্সিমকো ফ্যাশন, ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, এগ্রি ইকোনমি বাংলাদেশ, গ্রাডেনিয়া কর্পোরেশন, ইন্ট্রামেক্স টেক্সটাইল, এগ্রো বিডি, এবি কর্পোরেশন, আরামিট থাই অ্যালুমিনিয়াম, এসআর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ, ইয়াছির এন্টারপ্রাইজ ও সেবা এন্টারপ্রাইজ জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

    এসব প্রতিষ্ঠান যাতে কোনো ব্যাংকে নতুন করে এলসি খুলতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, অনিষ্পন্ন এলসির পণ্য দেশে আনা বা বৈদেশিক মুদ্রা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে। একটি সরকারি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এলসির নিষ্পত্তির বিষয়ে ব্যর্থ হওয়ায় এরই মধ্যে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না।

    সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অনেক আগে থেকেই একটি প্রভাবশালী মহল পণ্য আমদানির নামে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার করে আসছে। বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এসব ঘটনা ধরাও পড়ছে। কিন্তু টাকা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

    তদন্ত প্রতিবেদনকেই ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। ফলে টাকা পাচারকারীরা আইনি জালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এতে তারা আরও উৎসাহিত হচ্ছে টাকা পাচারে।

    এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, যেসব ঘটনা ধরা পড়ছে, তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। মানি লন্ডারিং হলে সেগুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অথবা দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হচ্ছে।

    যেসব কোম্পানি এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের নতুন করে এলসি খোলার অনুমোদন বন্ধ করার বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে বন্ধ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই এখন ঋণখেলাপি। এ কারণেও অনেক প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলা বন্ধ রয়েছে।

    বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, নির্বাচনী বছরে বড় একটি আশঙ্কা হচ্ছে টাকা পাচার। নির্বাচনের খরচ মেটাতে বিদেশ থেকে যেভাবে রেমিটেন্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) আসে, তার চেয়েও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়। এক্ষেত্রে দেশে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা থাকলে পাচার আরও বেশি হয়।

    ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি সীমার অতিরিক্ত বাড়ছে।

    ওই অনুপাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এক্ষেত্রে সিপিডি বারবার বলে আসছে, আমদানির আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে কিনা, বিষয়গুলোয় মনোযোগ দেয়া দরকার।

    কিন্তু দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন- ঋণ বাড়বে, আমদানি বাড়বে, কিন্তু বিনিয়োগ হবে না- এটি কী ধরনের কথা। এখানে টাকা পাচারের বিষয়টি সামনে চলে আসে।

    সূত্র জানায়, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির নামে টাকা হস্তান্তর করেছে বেক্সিমকো গ্রুপ। কিন্তু দীর্ঘদিনেও পণ্য দেশে আসার প্রয়োজনীয় কাগজ (বিল অব এন্ট্রি) জমা দিতে পারেনি গ্রুপটি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন- টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

    বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফ্যাশনের নামে গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৩৬ লাখ ডলারের এলসি খোলে জনতা ব্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩০ কোটি ২৪ লাখ (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা হিসাবে) টাকা।

    এসব এলসির বিপরীতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে আগাম অর্থ পরিশোধ করেছে ব্যাংকটি। কিন্তু পণ্য এদেশে এসেছে- এ ধরনের কোনো ডকুমেন্ট ব্যাংকে দেখাতে পারেনি বেক্সিমকো। এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দু’দফা জনতা ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়।

    কিন্তু সন্তোষজনক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি ব্যাংকটিকে চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হয়। পাশাপাশি কাগজ দেখাতে না পারলে অথরাইজ ডিলারের (বৈদেশিক লেনদেন) লাইসেন্স বাতিলের হুশিয়ারি দেয়া হয়। এরপরও সন্তোষজনক জবাব না এলে জনতা ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে ওই জরিমানা মওকুফ করা হয়েছে।

    সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় বেক্সিমকো ফ্যাশনের নতুন এলসি বন্ধ করার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে।

    বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে।

    বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। তদন্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

    সূত্র জানায়, এসএ ট্রেডার্স ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার বৈদেশিক এলসি খোলার জন্য ঋণ নিয়ে খুলেছে স্থানীয় এলসি। এর বিপরীতে কোনো পণ্যের আদান-প্রদান হয়নি। অথচ ব্যাংক থেকে বিদেশে টাকা পাঠানো হয়েছে।

    কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য বারবার তাগাদা দেয়া হলেও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, তারা এখন গ্রাহককে খুঁজে পাচ্ছে না।

    একই ঘটনা ঘটেছে ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজের ক্ষেত্রে। এভাবে বেসিক ব্যাংকের গুলশান ও শান্তিনগর শাখা থেকে ১৬টি প্রতিষ্ঠান ১৭৭ কোটি টাকা পাচার করেছে। এসব অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে তা ফেরানো সম্ভব হয়নি।

    গত বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের সোনালী ব্যাংকের একটি শাখায় শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৮ কোটি টাকার এলসি খোলে এবি অ্যান্ড ডি কর্পোরেশন। ওই বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তারা দেশে কোনো পণ্য আনেনি। ব্যাংকের চাপাচাপিতে পরে পণ্য আসার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ওই কনটেইনারে শিল্পের যন্ত্রপাতির বদলে পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত লোহা।

    এ রকম আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আমদানির কনটেইনারে পাওয়া গেছে পরিত্যক্ত রড ও সিমেন্ট। শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ডাল আমদানি করেছে এসএস কর্পোরেশন। এসব মাধ্যমে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই ভুয়া। গত বছর এগ্রো বিডির শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির কনটেইনারে পাওয়া গেছে বালি।

    এগ্রি ইকোনমি বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৫ সালে সরকারি এক ব্যাংকে এলসি খোলে ভারত থেকে কৃষিপণ্য হিমায়িত করার যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য। তারা মোট সাড়ে ৬ কোটি টাকার এলসি খোলে। এর বিপরীতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো পণ্য দেশে আসেনি। গ্রাহকের পক্ষ থেকেও কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। ফলে ব্যাংক ফোর্সলোন তৈরি করে গ্রাহকের দেনা শোধ করেছে।

    এখন গ্রাহকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে আগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দেশে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলা বেড়েছে ৪৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ে এলসি খোলা বেড়েছিল ১৪ শতাংশ। একই সময়ে এলসির নিষ্পত্তি ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৭ শতাংশ হয়েছে।

    এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে খাদ্যপণ্য। এরপরেই রয়েছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। কিন্তু গত কয়েক বছরে দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা চলছে। শিল্পোৎপাদন ও স্থাপনেও মন্দা যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের গতি মন্থর। এর মধ্যে এসব আমদানি পণ্য কোথায় যাচ্ছে? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। সূত্র: যুগান্তর

    /অ-ভি

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close