• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বিশ্বের যত আর্থিক কেলেঙ্কারি

প্রকাশ:  ২২ জুলাই ২০১৮, ০৯:৪৮
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটেছে ছোট-বড় নানা রকম আর্থিক কেলেঙ্কারি। এসব অঘটনের পেছনে থাকা মূল হোতারা কাজ সেরেছেন নিভৃতেই। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি, শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে অনেককে। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে আজকের আয়োজন।

পারমালাট

ইতালিয়ান দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান পারমালাট। ইউরোপের সবচেয়ে বড় ব্যাংক দেউলিয়াত্ব বহন করছে এই কোম্পানি। তাছাড়া ইউরোপের সবচেয়ে বড় ডেইরি কোম্পানির তকমাও যে তার গায়ে ছিল। কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়েছিল বৃহৎ ইতালিয়ান ডেইরি ফার্ম দিয়ে। যারা মাত্র ১৮৫ মিলিয়ন বন্ড পেমেন্ট করতেও তখন সক্ষম ছিল না। সে সময় কোম্পানির নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থার নিবিড় পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় একটি ফাইনান্স কোম্পানিকে। এভাবে কেটে যায় দীর্ঘ ১৫ বছরের একটি অধ্যায়। কিন্তু পারমালাট কয়েক টন ভুয়া নথিপত্রের ফাঁক গলে অর্থ জালিয়াতি করে বসে। আর তা ছিল কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার কাজ। লোপাট হয়ে যায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। কোম্পানিটি প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অথচ এক সময় এই কোম্পানিটিই যাত্রা শুরু করেছিল খুব সততা নিয়ে। মালিকানা ছিল তিনটি ইউরোপিয়ান ফুটবল ক্লাবের। সেখানে উদ্যোগী কর্মপরিকল্পনা ছিল একজন চালকের। অথচ এই পারমালাটই পরে বিরাট অর্থ কেলেঙ্কারি ও অর্থ পাচারে নিজের নাম লেখান।

বার্নি ম্যাডফ পঞ্জি স্কিম

বার্নি ম্যাডফ স্কিম এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিম হিসেবে পরিচিত। এই স্কিম থেকে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি লাভ পেয়ে বিনিয়োগকারীরা আরও অনেক বেশি বিনিয়োগ করতেন। হয়তো দুজন ব্যক্তি ১০০ ডলার বিনিয়োগ করল। সেখান থেকে অপর ব্যক্তিকে সেই বছরই ১০ শতাংশ পরিশোধ করা হতো। ১৯৬০ সালে ৫০০০ ডলার দিয়ে যাত্রা করা বার্নার্ড এল. ম্যাডফ ইনভেস্টমেন্ট সিকিউরিটিস এলএলসি নামক ফার্মের মাধ্যমে ব্রিটেনের এইচএসবিসি হোল্ডিংস পিএলসি ও জাপানের নমুরা হোল্ডিংসয়ের মতো বিভিন্ন বিখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান, চ্যারিটি প্রতিষ্ঠান এবং অসংখ্য ধনী বিনিয়োগকারীদের থেকে দীর্ঘ ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ১৮০০ কোটি ডলার। এই জালিয়াতি পরিচালনা সময়কালে তিনি ৫০ বিলিয়নের মতো লভ্যংশ দিয়েছিলেন বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু পরে তার এই চাতুর্য ধরা পড়ে যায়। এই জালিয়াতির দায়ে তাকে ২০০৮ সালে গ্রেফতার করা হয়। তাকে শাস্তি হিসেবে ১৫০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং ১৭০ বিলিয়ন ডলার জরিমানা ধার্য করা হয়।

রেফকো

আমেরিকার নিউ ইয়র্কভিত্তিক একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান রেফকো ফার্ম। সাধারণত এটি ব্রোকারেজ ফার্ম হিসেবেই পরিচিত ছিল। রেমন্ড আর্ল ফ্রিডম্যানের হাতে কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। সার্বিক কার্যক্রম ভালোভাবে চললেও ২০০৫ সালের আগস্ট মাসে তাদের সবকিছু গুটিয়ে নিতে হয়। ফার্মটির মালিকানায় ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন অর্থ। সেখানে প্রায় দুই লক্ষাধিক গ্রাহক ছিলেন। এমনকি শিকাগো মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জের সবচেয়ে বড় ব্রোকার হাউজও ছিল এটি। জালিয়াতির দায়ে রেফকোকে যখন সমস্ত কার্যক্রম গোটাতে হলো তখন এর ব্যালান্স শিটে কমপক্ষে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের গরমিল পাওয়া যায়। চারপাশে খবরটি রটে গেলে কোম্পানির সিইও এবং চেয়ারম্যান ফিলিপ বেনেট নিখোঁজ হন। এরপরেই অবশ্য ফার্মের ২৬.৫ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি করে মাত্র ২২ ডলার নিয়ে একটি পাবলিক কোম্পানিতে গঠন করা হয়। অথচ এই কোম্পানিরই আর্থিক মূল্য ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার।

এনরন

আমেরিকার সবচেয়ে উদ্ভাবনী কোম্পানি হিসেবে যখন এনরনের নাম ফুটল, নব্বইয়ের দশকে ফোর্বস ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে টানা ৬ বছর সেরা কোম্পানি হলো তখন যেন আকাশটাই তাদের হাতের মুঠোয় চলে এলো। ২২ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এই কোম্পানির ২০০০ সালের রাজস্ব ছিল ১০১ বিলিয়ন ডলার! অথচ এই বিশাল ব্যবসার নামটি এখন প্রতারণা, জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারির মতো শব্দের সমার্থক শব্দ হিসেবে আমেরিকায় ব্যবহূত হয়। সাধারণ মানুষ জানতই না কোম্পানিটি তাদের মগজ ধোলায় করছে দিনের পর দিন। ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করা এই কোম্পানিতে কয়েক বছর পরেই যোগ দেন জেফরি স্কিলিং এবং এন্ড্রু ফাস্টো নামক দুজন ব্যক্তি। তাদের দুর্নীতি ও প্রতারণার ফলে ২০০১ সালের ২ ডিসেম্বর কোম্পানিটি দেউলিয়া হতে বাধ্য হয়। বিনিয়োগকারীদের নিকট কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তির ভুল ও অতিরিক্ত উচ্চমূল্য প্রদর্শন সবই ছিল বানোয়াট ও পরিকল্পিত। আর এভাবেই কয়েকজন প্রতারকের হাতে শেষ হয় বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম অ্যানার্জি কোম্পানি।

ওয়ার্ল্ডকম

ওয়ার্ল্ডকম টেলিকমিউনিকেশন ছিল আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দূরপাল্লার কোম্পানি। কিন্তু ২০০১ সালে টেলিকমিউনিকেশনের জায়ান্ট খ্যাত এই কোম্পানিই ফেঁসে যায় ব্যাংক জালিয়াতিতে। এর ফলে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ব্যাংক জালিয়াতি হিসেবে পরিণত হয়। দেশের ইন্টারনেট যোগাযোগের অর্ধেকই ঘটত ওয়ার্ল্ডকমের মাধ্যমে। কোম্পানির সবচেয়ে বড় একটা ব্যয়ের খাত ছিল লাইন খরচ। এ খরচ হতো অন্য ফোন কোম্পানির নেটওয়ার্কে ঢোকার ফি বাবদ। অ্যাকাউন্টিংয়ের রীতি মোতাবেক এ-জাতীয় খরচ পরিচালন ব্যয় খাতে দেখাতে হয়। কিন্তু ওয়ার্ল্ডকম খরচটা পরিচালন ব্যয় খাতে না দেখিয়ে দেখাত মূলধন ব্যয় হিসেবে। ফলে লাইন খরচ পরিচালন ব্যয় হলেও খরচটা একসঙ্গে না দেখিয়ে বহু বছর ধরে শোধ করা হতো। এভাবে এ কোম্পানি তাদের প্রকৃত খরচ লুকিয়ে রেখে কাগুজে মুনাফা দেখাতে পারছিল। ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে এক বছর সময়ের মধ্যে কোম্পানির মুখ্য অর্থ বিভিন্ন ত্রৈমাসিকে ৫৬ কোটি থেকে ৯৪ কোটি ডলার লাইন ব্যয় হলেও তা পরিচালন ব্যয় থেকে বের করে নিয়ে লেজারে ‘সম্পত্তি, প্লান্ট ও সরঞ্জাম’ খাতে দেখানো হয়। নীতিবহির্ভূত এ কারসাজির কারণে তাদের এই বিপত্তি হয়।

টাইকো ইন্টারন্যাশনাল

টাইকো ইন্টারন্যাশনাল ছিল আমেরিকার নিউ জার্সিভিত্তিক এক সিকিউরিটি সলিউশন কোম্পানি। শেষমেষ এই কোম্পানিরই ঘটল অনিরাপত্তার মতো ঘটনা। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ডেনিস কজলোস্কি ও মুখ্য অর্থ কর্মকর্তা মার্ক শোয়ার্জের যোগসাজশে প্রায় ১৫ কোটি ডলার গায়েব হয়ে যায়। এ কাজের জন্য তারা কোম্পানির আয় প্রায় ৫০ কোটি ডলার বেশি দেখিয়েছিলেন। এত বড় ঘটনার সাক্ষীদের মুখ বন্ধ রাখতে ৪০ জন উচ্চপদস্থ কর্মচারীর নেওয়া ঋণ মওকুফ করে দেন। অথচ এ কর্মকর্তাদের অনেকেই ভিতরের খবর জানতেন না। ২০০২ সালের প্রথম দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানা যায় যে, আইনবহির্ভূত একটি লেনদেন ঘটতে যাচ্ছে কোম্পানিতে। কোম্পানির টাকায় কর্তারা উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন করতেন। ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র থেকে শুরু করে স্ত্রীর জন্মদিনের পার্টির জন্য কোম্পানির ২ লাখ ডলার খরচের অভিযোগ উঠে আসে তাদের বিরুদ্ধে। কোম্পানির টাকায় কিছু পেইন্টিং কিনতে গিয়ে আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠে এলে নিজের বিপদ আঁচ করতে পেরে কজলোস্কি তড়িঘড়ি করে পদত্যাগ করেন। কিন্তু শেষমেষ দোষের ভার বইতেই হয়। আইনের আওতায় এনে সাজা হিসেবে দুজনের ৮ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছিল।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কেলেঙ্কারি

১৮৯৪ সালে ল্যারি ব্যাক ব্যক্তিগত উদ্যোগে ‘বর্জ্য ব্যবস্থাপনা; ইনকর্পোরেটেড’ নামে কোম্পানিটি চালু করেন। পরবর্তীতে ১৯৭১ এবং ১৯৭২ সালে কোম্পানিটি সরকারি সংস্থা হিসাবে নতুনভাবে প্রকাশ পায়। হিউস্টনভিত্তিক কোম্পানিটির বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের অভিযোগ ওঠে। কোম্পানির প্রধান নির্বাহী খোদ এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিশাল কেলেঙ্কারির সহযোগিতায় ছিলেন কোম্পানির অডিটর অফিসার আর্থার অ্যান্ডারসন। অসংখ্য মিথ্যা ব্যালেন্স শিট তৈরি করে বিশাল অঙ্কের জালিয়াতির প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। শেষমেষ নতুন প্রধান নির্বাহী এবং পরিচালনা পর্ষদ কেলেঙ্কারির এপিঠ ওপিঠের সব ঘটনা সাধারণের সামনে তুলে ধরে এবং শেয়ারের মালিকরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেন।

লেহম্যান ব্রাদার্স স্ক্যান্ডাল

এটি একটি বৈশ্বিক আর্থিক সেবাদাতা সংস্থা। গোটা বিশ্বেই দারুণ পরিচিত লেহম্যান ব্রাদার্স। এখানে প্রধান নির্বাহী এবং কোম্পানির অডিটর অফিসারের যোগসাজশে বিশাল অঙ্কের অর্থ জালিয়াতি করে বলে অভিযোগ ওঠে। সেখানে বলা হয়, প্রধান নির্বাহী এবং কিছু কর্তা কোম্পানির নামে বিক্রি দেখিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি ঋণের তথ্য আড়াল করেন। সঠিক সময় উল্লেখ না করে ব্যাংকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বিক্রির অভিযোগ আনা হয় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এবং পরবর্তীতে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় লেহম্যান ব্রাদার্স। কিন্তু এত কিছুর পরও প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে ফৌজদারি মামলা হয়নি। মজার ব্যাপার হলো— ফরচুন ম্যাগাজিনের তৈরি ২০০৭ সালের ‘মোস্ট অ্যাডমায়ার্ড সিকিউরিটিজ ফার্ম’-এর তালিকায় শীর্ষে ছিল লেহম্যান।

সত্যম কম্পিউটার সার্ভিস

সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস। ভারতীয় বহুল পরিচিত আইটি সেবা ও ব্যাক অফিস অ্যাকাউন্টিং ফার্ম। ২০০৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। যার মূল হোতা ছিলেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান রামলিঙ্গম রাজু এবং কিছু সদস্য। অভিযোগ ওঠার পরই ফার্মটির প্রতিষ্ঠাতা ও তার ভাইসহ সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে অন্ধ প্রদেশের পুলিশ। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের প্রতারণার মাধ্যমে কোম্পানির রাজস্ব, মার্জিন এবং নগদ অর্থের খতিয়ান ৫ হাজার কোটি রুপি দেখায়। কিন্তু এক পর্যায়ে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের কাছে একটি চিঠির মাধ্যমে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন রাজু। তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গ, ষড়যন্ত্র, প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়। অর্থ আত্মসাতের মামলায় তাকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে ব্যর্থ হলে আদালত তাদের মুক্তি দিয়ে দেয়।

হেল্থসাউথ কেলেঙ্কারি

হেল্থসাউথ আমেরিকার সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাহীর নির্দেশে হিসাব কারসাজি করে শেয়ারহোল্ডারদের ধোঁকা দিয়ে শেয়ারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যালান্স শিটে ১৪০ কোটি ডলার ভুয়া আয় দেখানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী রিচার্ড এম স্ক্রুশি সাত বছর ধরে এই জালিয়াতি করে আসছিলেন যা ধরা পড়ে ২০০২ সালের শেষের দিকে। আর বিশাল এই আত্মসাতের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কোনো এক বছর কোম্পানির আয় ৪ হাজার ৭০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানো হয়। এসব দুষ্কর্ম করার জন্য কোম্পানির বিশেষ কর্মকর্তাদের হিসাব কারচুপির নির্দেশও দিয়েছিলেন স্ক্রুশি। তবে আদালতে স্ক্রুশি তার অপরাধ অস্বীকার করেন এবং তিনি দাবি করেন, কোম্পানির অন্য কর্তারা এসব ঘটিয়ে তার কাছে সব গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু এতে শেষরক্ষা হয়নি, বিচারে তার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়। মজার ব্যাপার, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি একজন প্রেরণাদায়ী বক্তা হিসেবে এখানে সেখানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান।

চার্লস পঞ্জি

শূন্য থেকে শিখরে— শব্দটি অনেকেই নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে মরিয়া থাকেন। কেউ সৎ পথে কেউ অসৎ পথেই তার বাস্তবায়ন ঘটান। পকেটে মাত্র আড়াই ডলার নিয়ে ১৯০৩ সালে ইতালি থেকে আমেরিকায় আসেন চার্লস পঞ্জি। আমেরিকার পূর্ব উপকূলবর্তী অঞ্চলের এক রেস্টুরেন্টে কাজ নেন ডিশ ওয়াশার হিসেবে। রাতে ঘুমাতেন রেস্টুরেন্টের মেঝেতে। কিন্তু মাথায় থাকা ধনী হওয়ার নেশা। হঠাৎ স্বাক্ষর জালিয়াতির কুবুদ্ধি ঢোকে মাথায়। সে জন্য অবশ্য জেলও খেটেছেন। ১৯২০ সালের দিকে ডাক বিভাগের রিপ্লাই কুপন দেখে তার মাথায় এই অবৈধ আয়ের বুদ্ধি আসে। খুলে বসেন ব্যবসা। বিনিয়োগকারীদের ৪৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং ৯০ দিনে পুরো বিনিয়োগের দ্বিগুণ লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংগ্রহ করতে থাকেন অর্থ। ১৯২০ সালের জুলাই মাসের দিকে পঞ্জি প্রায় ১ মিলিয়ন ডলারের মালিক বনে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ডাক সংক্রান্ত জালিয়াতির অভিযোগে পঞ্জিকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার অর্থ আয়ের এই অবৈধ নীলনকশা ইতিহাসে ‘পঞ্জি স্কিম’ নামে পরিচিত।

আলভেস ডোস

বড় কোনো কেলেঙ্কারির জন্য একটি কুবুদ্ধিসম্পন্ন মাথাই যথেষ্ট। হয়তো অঘটনের মূল যে হোতা তিনি ঠিকঠাক মতো স্কুলের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি; অথবা বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী। ব্যক্তিজীবনে তিনি যা-ই হন না কেন, ্বৃহৎ বিপর্যয় ঘটাতে তার মতো একজনই যথেষ্ট। এই বিচারে আলভেস ডোস রাইস তেমনি একজন। তিনি এখন পর্যন্ত বিশ্বের কাছে পরিচিত একজন পর্তুগিজ অপরাধী হিসেবে। ১৯৫২ সালে ভুয়া কাগজ দেখিয়ে পর্তুগিজ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংক নোট ছাপানোর কাজ শুরু করেন। পেয়ে বসে রাতারাতি ধনী হওয়ার নেশা। পরবর্তীতে আসল নোটের পাশাপাশি তিনি প্রচুর পরিমাণে জাল নোট বাজারে ছাড়েন। সরকারি কর্তাব্যক্তিরাও যেন কিছুই টের পাননি তত দিনে। এরই মধ্যে পর্তুগিজে ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। দেশটি প্রচণ্ড রকম আর্থিক চাপের মুখে পড়ে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব দেশীয় মুদ্রা বাজার থেকে তুলে নেয়। খুঁজে বের করা হয় ঘটনার মূল হোতা রাইসকে। ১৯২৫ সালের ৬ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের আওতায় এনে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শাস্তি হিসেবে তাকে দেওয়া হয় ২০ বছরের কারাদণ্ড।

লিবর

লিবর রেট এমন একটি সুদের হার যা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করত। তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল বিশ্বব্যাপী। লিবরের প্রতি মানুষের বিশ্বস্ততাও ছিল অগাধ। লিবর পরিচিত ছিল একটি বিশ্বব্যাপী সুদের হার নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তাদের কাজ হিসেবে দেখানো হতো, গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি পর্যালোচনা এবং সাম্য বজায় রাখতে সুদের সঠিক হার নির্ধারণ। তাদের এখতিয়ারে প্রায় ৩৫০ ট্রিলিয়ন সম্পদকে প্রভাবিত করতে পারত। এমনকি আমেরিকান অর্থনীতি পুনর্গঠনে ২০ বার এই প্রতিষ্ঠান সহায়তা করেছে। কিন্তু কেলেঙ্কারিটা বাধে তখনই যখন সবার সামনে উঠে আসে তাদের অনৈতিক রেট নির্ধারণের বিষয়। ব্যাংকের রেট কম বা বেশি যাই করা হোক না কেন এর পেছনে ছিল তাদের লাভের বিষয়। এতে তাদের অভাবনীয় লাভের সুযোগ থেকে যেত। সামান্য কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে রেট বাড়ালে হয়তো দুই মিনিটে তাদের পকেটে ঢুকে যেত ২০০ মিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন কোম্পানির স্বার্থে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তারা এসব অনৈতিক কাজ করত। ধারণা করা হয়, লিবর ফিক্সিংয়ের কারণে আমেরিকান সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।

মার্চেন্ট ব্যাংক

ব্রিটেনের কাউটস ব্যাংকে সামান্য একজন কেরানি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন নিকোলাস। অথচ তার প্রতারণার কারণেই দেউলিয়া হতে হয়েছে লন্ডনের সবচেয়ে প্রাচীন মার্চেন্ট ব্যাংককে। ১৭৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই ব্যাংকের সিঙ্গাপুর অফিসের দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের কর্মী নিকোলাসকে। অথচ তিনি হেড অফিসের অনুমতি না নিয়েই ঝুঁকিপূর্ণ লেনদেনগুলোর কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাতে ক্ষতি হয় অনেক। সেই ক্ষতির তোয়াক্কা না করে তিনি জাল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ক্ষতির হিসাব লুকিয়ে রেখে উচ্চ লাভের ভুয়া বিবরণী তৈরি করেন। কিন্তু খুব শিগগিরই ব্যাংককে ১.৩ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এ অভিযোগে নিকোলাসকে সাড়ে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাগার থেকে ১৯৯৬ সালে তিনি তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘রউগ ট্রেডার’ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি তার প্রতারণার বর্ণনা সবিস্তারে তুলে ধরেছেন। ঘটনাটি এতই আলোচিত যে, ১৯৯৯ সালে একই নামে একটি সিনেমাও মুক্তি পায়। সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

/এসএম

কেলেঙ্কারি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close