• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

তৎপর হচ্ছে ফুড সেফটি অথরিটি

বিজ্ঞাপনে অতিরঞ্জন থাকলেই শাস্তি

প্রকাশ:  ২৪ জুলাই ২০১৮, ১০:৪০
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক

‘টলার, স্ট্রংগার, শার্পার।’ ‘যতবার দুধ, ততবার হরলিক্স।’ ‘২ গ্লাস হরলিক্স সমান ৬৬৬ গ্রাম ইলিশ মাছের সমান আয়রন।’ ‘জুনিয়র হরলিক্স খেলে শিশুর শরীর ও বুদ্ধি তরতর করে বেড়ে উঠে।’ ‘মাদারস হরলিক্স মায়ের পেটে বাচ্চার সঠিক বৃদ্ধি, ওজন এবং ব্রেন ডেভেলপ করে।’ ‘বেড়ে উঠার ডোজ’। ‘ক্লান্তিহীন এই জীবনের স্বপ্ন, এবার আপনিও জেগে দেখতে পারেন’ ‘হরলিক্স তো রেগুলার খাবার, কেন আপনি দিচ্ছেন না?’

এসবই যুক্তরাজ্যের ফার্মাসিউটিক্যালস কম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) উৎপাদিত হরলিক্সের বাংলাদেশের বাজারে ক্রেতা আকৃষ্ট করার বিজ্ঞাপনী ভাষা। ভারতে ২০০৬ সালে কম্পানিটি একটি গবেষণা পরিচালনা করে এবং এখনো সেটা দেখিয়েই বাংলাদেশে এই মুখরোচক বুলি আউড়ে যাচ্ছে। যা দেশের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের দায়িত্বপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির (বিএফএসএ) মোড়াকাবদ্ধ খাদ্য লেভেলিং প্রবিধানমালা, ২০১৭-এর পরিপন্থী। এ কারণে প্রভাবিত করার এসব বিজ্ঞাপনী ভাষার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

জানা গেছে, বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি করতে পণ্যের লেভেলে এমনকি ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করছে। বিভিন্ন স্লোগানের মাধ্যমে তারা নানা দাবি তুলছে বা অপকৌশল অবলম্বন করছে। এনার্জি ড্রিংকস, জুস, দুধ, বিস্কুট, হরলিক্সসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে নানা কৌশলী বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিএফএসএর। যেমন—উৎপাদিত পণ্যটি সম্পূর্ণ ক্যামিকেলমুক্ত, বাজারের সেরা, আমারটাই সেরা, ১৬ কোটি মানুষের হৃদয় জয় করে, বিশ্বের সেরা ড্রিংকস, একটু বেশি পিওর, খেলে অসম্ভব হবে সম্ভব, রাতারাতি কমে যাবে বয়স, ভেজাল প্রমাণে লাখ টাকা পুরস্কার, ১০০ ভাগ পিওর, ত্বক হয়ে উঠবে উজ্জ্বল, রোগ থেকে দেয় সুরক্ষা, পণ্যটি যেন অমৃত সুধা! এসব আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।

প্রবিধানমালার দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেভেলিং শিরোনামে ৪নং ধারার (৭) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘লেভেলে চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ বা সমতুল্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সুপারিশকৃত কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ বা ঘোষণা করা যাইবে না, যাহা হইতে ক্রেতা বিভ্রান্ত হইতে পারে।’ আর উপধারা (৮)-এ বলা হয়েছে, ‘খাদ্য বা খাদ্যপণ্যের গুরুত্ব বৃদ্ধি করিতে উহার পরিমাণ ও পুষ্টিগুণের বিষয়ে লেভেলে কোনো মিথ্যা তথ্য, দাবি বা অপকৌশল অথবা রোগ নিরাময়কারী ইত্যাদি ধরনের কোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য বা দাবি এবং উৎসস্থল সম্পর্কে কোনো বিভ্রান্তিকর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করা যাইবে না। তবে সরকার বা কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে গুণগতমানের নিশ্চয়তা বিধানসংবলিত সিল প্রদান করা যাইবে।’

এর ব্যাখ্যায় বিএফএসএ বলছে, যারা উৎপাদক তারা কোনো প্রকার দাবি তুলতে পারবে না। খাদ্যে যদি পুষ্টি থাকে এবং যা উপাদান থাকবে তা উল্লেখ করতে পারবে। তবে এই উপাদান খেলে কী হয়, বা হবে তা কোনোভাবেই বলা যাবে না। কারণ সারা দিন একজন মানুষ অনেক ধরনের খাবারই গ্রহণ করে। তাই একজন মানুষ শুধু হরলিক্স খেয়েই লম্বা হয়ে যাচ্ছে এটা বলা অযৌক্তিক। পৃথিবীতে এমন ভূরি ভূরি মানুষই রয়েছে যারা কি না কোনো দিন হরলিক্সই খায়নি। ভোক্তাকে প্রভাবিত করতে এ রকম কোনো কথা বলা যাবে না। কারণ কোন পণ্য কিনবে সেটা একান্তই ভোক্তার নিজস্ব বিষয়। ‘হরলিক্স তো রেগুলার খাবার, কেন আপনি দিচ্ছেন না’—এই কথায় ভোক্তাকে এমনভাবে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে এটা না খেলে শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে বা অন্য কোনো সমস্যায় পড়বে।

বিএফএসএ বলছে, লেভেলে বা বিজ্ঞাপনী প্রচারে কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়া যাবে না। শুধু হরলিক্স নয়, সব ধরনের খাদ্যপণ্যের জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। প্রমাণ ছাড়া কোনো কথাই পণ্যের লেভেলে বলা যাবে না।

বিএফএসএর সদস্য মাহবুব কবীর বলেন, ‘এত দিন ধরে যা চলে আসছে সেটা আর চলতে দেওয়া হবে না। তারা কোনো দাবি করতে পারে না। পণ্যে কী আছে সেটা শুধু তারা বলে দেবে। বাকি পছন্দ পুরোটাই ভোক্তার। ভোক্তাকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করা যাবে না।’ ২০১৭ সালের মে মাসে প্রবিধানমালা জারি হলেও এর বাস্তবায়নে নজর দিতে পারেনি বিএফএসএ। তবে মাস দেড়েক আগে এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা দেশের বিভিন্ন খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটি সভা করে। এসব বিষয়ে সব কিছু ঠিকঠাক করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো দুই মাসের সময় চেয়েছিল। বিভিন্ন পণ্যের লেভেলিংয়ে পরিবর্তন আনার জন্য এই সময় চেয়েছিল তারা। এই সময় শেষ হবে চলতি মাসের ৩১ তারিখে। তবে তার আগেই পত্রপত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে বিএফএসএ।

জানতে চাইলে ডেনিস কনডেন্সড মিল্ক বাংলাদেশ লিমিটেডের ম্যানেজার (কিউএ) সামির পাল বলেন, ‘নীতিমালা বাস্তবায়ন করলে কোনো অসুবিধা নেই। আমরা এটার পক্ষে। কারণ আমরা পণ্যের প্যাকেটে যা উপাদান তার কথাই লিখি। বাড়তি কিছু লিখি না। তবে নির্দেশনাটা আসা উচিত ছিল বিএসটিআইয়ের কাছ থেকে। যেহেতু সব কিছুর অনুমোদন দেয় তারা।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুটি কম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, প্রবিধান যেটা করা হয়েছে তা ঠিক আছে। বাস্তবায়নের আরো একটু সময় এবং আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

ভোক্তা ও খাদ্য ব্যবসায়ীদের জন্য প্রকাশিত বিএফএসএর বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত মোড়কাবদ্ধ খাদ্য বা খাদ্যপণ্যে ব্যবহৃত সব উপকরণের তালিকা বা বিবরণ লেভেলে উল্লেখ করছে না। আবার কারো কারো উৎপাদিত মোড়কাবদ্ধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বা খাদ্যপণ্যে এলার্জি সৃষ্টিকারী বা অসহিষ্ণু প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী উপকরণ থাকলেও লেভেলে তার কোনো ঘোষণা থাকছে না, যা এই প্রবিধানমালার পরিপন্থী। এতে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-এর আওতায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

মাহবুব কবীর বলেন, ‘সবাইকে আমরা বলেছি, মিটিং করেছি, সতর্ক করে দিয়েছি। এর পরও বিজ্ঞাপন প্রচার করছি আবারও মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। ৩১ জুলাইয়ের পর আর কাউকে অনুরোধ করা হবে না। যারা অপরাধ করবে তারাই শাস্তি পাবে।’ কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘নানা পণ্যের মধ্যে এমন সব কথা বলা হয় যা বাস্তবসম্মত নয়। যে কারণে আমরা ভোক্তারা কনফিউজড হই, ক্ষতিগ্রস্ত হই। এখানে পণ্যের উপাদান এবং কী ধরনের ভিটামিন বা পুষ্টি রয়েছে সেসবের উল্লেখ থাকতে হবে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে প্রবিধানমালার বাস্তবায়নের কার্যক্রমকে আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। কারণ এটা সঠিক সিদ্ধান্ত।’ সূত্র: কালের কণ্ঠ

/এসএম

বিজ্ঞাপন,বিএফএসএ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close