• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

লাভবান হচ্ছে বিকাশ-হুন্ডি ব্যবসায়ীরা; রেমিট্যান্স হারাচ্ছে দেশ

প্রকাশ:  ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৫ | আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৬:৫৯
বিজনেস ডেস্ক

সিঙ্গাপুরে চলছে বিকাশের রমরমা হুন্ডি ব্যবসা। দেশটির সেরাঙ্গন এলাকায় দুই ডজন প্রতিষ্ঠান বিকাশের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এ ব্যবসা করছে। এতে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও দেশ হারাচ্ছে মূল্যবান রেমিট্যান্স।

গত সপ্তাহে সিঙ্গাপুরের সেরাঙ্গন এলাকায় মোস্তফা প্লাজার কাছে কাদের কার্গো অ্যান্ড কুরিয়ার ও টাঙ্গাইল মিনি মার্টের সামনে দেখা গেল বিকাশের লোগো ব্যবহার করে টাকা পাঠানো হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের সেরাঙ্গন, মোস্তফা প্লাজা, লিটল ইন্ডিয়ায় ২০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান বিকাশের লোগো, স্টিকার ও সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে। সেখানে বাংলায় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘এখানে ব্যাংক রেটে বিকাশের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠানো হয়’। বাংলাদেশের দোকানগুলো যেভাবে বিকাশের লোগো সাজিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি সিঙ্গাপুরেও পুরো দোকান সাজিয়ে রেখেছে বিকাশের লোগো সংবলিত স্টিকারে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে, অবৈধভাবেই তারা ব্যবসাটি করছে।

প্রবাসী পরিচয় দিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে উভয় প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হয় বিকাশ নম্বর ও পাঁচ ডলার দিলে দেশে আপনার বিকাশ হিসাবে টাকা পৌঁছে যাবে। সিঙ্গাপুরে ডলারের প্রচলিত রেটে টাকা পাওয়া যাবে বাংলাদেশে। কাদের কার্গো অ্যান্ড কুরিয়ার ও টাঙ্গাইল মিনি মার্টের মতো এ অবৈধ ব্যবসা ফেঁদে বসে আছে প্রায় দুই ডজন প্রতিষ্ঠান। প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন বিকাশের মাধ্যমে গড়ে দুই লাখ ডলার পাঠানো হচ্ছে। সূত্র: শেয়ার বিজ।

সেরাঙ্গন এলাকায় কথা হয় প্রবাসী রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, নিয়মিত বিকাশের মাধ্যমেই তিনি দেশে টাকা পাঠান। তার বন্ধুরাও এভাবেই টাকা পাঠান। হুন্ডির চেয়ে এতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। রহমান বলেন, বিকাশের মাধ্যমে টাকা পাঠালে তা দেশে বৈধভাবে যায় বলে তাদের বলা হচ্ছে। এটি বিশ্বাস করেই তারা টাকা পাঠাচ্ছেন।

বিকাশের মাধ্যমে হুন্ডিতে অর্থ আসায় এর প্রভাব পড়েছে বৈধ চ্যানেলে। ফলে প্রতিবছরই কমছে সিঙ্গাপুর থেকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসা। চার বছরের ব্যবধানে প্রায় ২৬ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে বৈধ পথে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সিঙ্গাপুর থেকে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪৪ কোটি ৩৪ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিল বাংলাদেশে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে হয়েছে ৩৮ কোটি ৭২ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০ কোটি ও সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছের তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ডলারে। গত চার বছরের ব্যবধানে দেশটি থেকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স কমেছে ১১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৯৫২ কোটি টাকারও বেশি। এ হিসাবে চার বছরে কমেছে এক-চতুর্থাংশের বেশি বা ২৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

সবকিছু জেনেও নীরব থাকছে বিকাশ। এ বিষয়ে বিকাশ লিমিটেডের হেড অব করপোরেট কমিউনিকেশনস অ্যান্ড পিআর শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, বাংলাদেশের বাইরে বিকাশের কোথাও কোনো এজেন্ট নেই। সিঙ্গাপুরে বিকাশের লোগো বা সাইনবোর্ড ব্যবহার করে টাকা পাঠানো সম্পূর্ণ অবৈধ।

তিনি আরও বলেন, বিকাশের লোগোর অবৈধ ব্যবহার রোধে এরই মধ্যে প্রবাসী অধ্যুষিত আট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশন এবং সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসনকে অবহিত করে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর হাইকমিশনও রয়েছে। একই সঙ্গে সেসব দেশে বিকাশের লোগো নিবন্ধন করে এর অপব্যবহার রোধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সিঙ্গাপুরে থাকা ব্যক্তি ডলার গ্রহণ করে তা মুহূর্তের মধ্যেই বাংলাদেশে হুন্ডিকারীকে মেসেজ দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট বিকাশ অ্যাকাউন্টে পাঠানো হচ্ছে সমপরিমান টাকা।

সূত্র জানিয়েছে, বিকাশের মাধ্যমে লেনদেন হলেও এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয় না। সিঙ্গাপুর থেকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে না। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা এজেন্টের মাধ্যমে পরিশোধিত টাকার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারে ইচ্ছুক ব্যক্তিই জোগান দিচ্ছে এই অর্থের। পরবর্তী সময়ে সিঙ্গাপুরে থাকা ব্যক্তির কাছ থেকে বুঝে নিচ্ছে সমপরিমাণ অর্থ। এভাবেই বড় হচ্ছে হুন্ডি ব্যবসা।

বিকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে হুন্ডি ব্যবসার কারণে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছিল। এ বিষয়ে লেখালেখির কারণে অভিযোগের তদন্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রবাসী অধ্যুষিত কয়েকটি দেশে প্রতিনিধি পাঠানো হয়। তারা ফিরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রতিবেদন দেন বিকাশ ও কয়েকটি মাধ্যমে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স আসছে। বৈধপথে না এলেও হুন্ডিতে ঠিকই রেমিট্যান্স আসছে। তখন কয়েকটি দেশে এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো হয় ও বিকাশকে নজরদারির আওতায় আনা হয়। কিন্তু তারপরও বন্ধ হয়নি বিকাশের হুন্ডি কার্যক্রম।

সিঙ্গাপুরের বিকাশের হুন্ডি ব্যবসার খবর দেশটির প্রবাসী, বাংলাদেশি পর্যটকদের নজরে এলেও বাংলাদেশ দূতাবাসের নজরে আসেনি। যে কারণে বন্ধ হয়নি বিকাশের কার্যক্রম। এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনার ড. মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সিঙ্গাপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনের অফিশিয়াল ই-মেইল ঠিকানায় জানতে চাওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিকাশের মাধ্যমে রেমিট্যান্স হুন্ডি হচ্ছে এ বিষয়ে আমরা অবগত নই। এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে, আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রহণ করবে।’

প্রসঙ্গত, বিকাশ হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবা দিতে ১৮টি ব্যাংককে এ অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের বিকাশ মোবাইলের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সিংহভাগই হচ্ছে বিকাশের মাধ্যমে।

ওএফ

হুন্ডি,বিকাশ,রেমিটেন্স
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close