• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ফকির লালনের স্বরূপ সন্ধানে

প্রকাশ:  ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৮ | আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৮, ১৯:৩৮
আবুল আহসান চৌধুরী

মরমী-সাধনপথের পথিকরাই বাউল নামে পরিচিত। গুরুর নির্দেশে দেহসাধনার পথ ও পন্থা জেনে নিয়ে তার যাত্রা হয় শুরু। মহাজন-বাক্য সুরের আশ্রয়ে গান হয়ে দিশা দেয় তাকে- গোপন-আঁধার পথের সুলুক-সন্ধান মেলে তারপর- আলোকিত হয়ে ওঠে তার মনের পৃথিবী। জীবন ও জগতের রহস্য ক্রমে উন্মোচিত হয় যখন সে দেহের ভাষা পড়তে পারে। বাউলের গান তাই একদিকে দেহজরিপের গান, স্বরূপ-অন্বেষার গান, ‘গভীর নির্জন পথে’ ‘মনের মানুষ’কে খুঁজে ফেরার গান- অপরদিকে এই গান নিম্নবর্গের মানুষের দ্রোহের গান- প্রতিবাদের গান- শ্রেণিচেতনার গান- শুভ্র-সুন্দর জীবনস্বপ্নের গানও।

বাউলের জন্ম দ্রোহ থেকে। তার সাধনা প্রচলিত শাস্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে অগ্রাহ্য-অস্বীকারের স্পর্ধার প্রতীক। তার দর্শন বর্ণশোষণ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে ‘মানুষসত্যে’র উদার মানবিকতার দর্শন। তার গান রূপক-প্রতীকের আড়ালে প্রবল প্রতিবাদের গান- প্রচলিত আচার-প্রথা-বিশ্বাসকে চূর্ণ করা নবজীবনের গান। বিশ্বাসের বদলে যুক্তি, প্রথার শাসন থেকে মুক্তি, সংস্কার-আচারকে মুক্তবুদ্ধি দিয়ে প্রতিস্থাপন- বাউলের জীবনচেতনার মূল কথা। শুভবুদ্ধি ও কল্যাণচেতনায় অভিষিক্ত হয়ে প্রথা-শাস্ত্র-ধর্মকে আঘাত করার সামাজিক শক্তি অর্জনের প্রয়াসী সে। লালনে এই বাউলচেতনার পূর্ণ প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাই বাউলসাধনার উৎস ও ধারা বিশ্লেষণ করে লালনকে মরমী ও দ্রোহী- এই দুই পরিপূরক চেতনার সমন্বিত রূপ-বৈশিষ্ট্যের আলোকে চিনতে পারলেই তাঁর স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেবে- তাঁর বক্তব্যের তাৎপর্য আবিষ্কৃত হবে- জীবন ও সমাজসত্যের শেকড়সন্ধানে তাঁর প্রয়াসের প্রকৃত মর্ম-উদ্ধার সম্ভব হবে।

দুই.

বাঙালির লোকধর্ম হিসেবে বাউলের মত ও সাধনার ধারা যথেষ্ট প্রাচীন হলেও গুরুবাদী সঙ্গীতাশ্রয়ী এই মরমী সম্প্রদায়ের রচিত আদি গানের সন্ধান পাওয়া যায় না। যদিও মরমী সাধনা ও সঙ্গীতের অনুরাগী ক্ষিতিমোহন সেন কিছু প্রাচীন বাউলগান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন, রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে তা বেশ প্রচারও পায়। কিন্তু বলতে হয়, রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতা সত্ত্বেও সেইসব গানের অকৃত্রিমতা ও পদকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ আছে। সে-ক্ষেত্রে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে ফকির লালন সাঁইকে বাউলগানের প্রথম ও প্রধান পদকর্তা এবং সেইসঙ্গে বাউলসাধনার শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার হিসেবে বিবেচনা করা যায়। পাশাপাশি এ-ও উল্লেখ করা প্রয়োজন, ব্রাত্যজনের এই সাধন-সঙ্গীতকে লালনই শিষ্টসমাজে গ্রহণযোগ্য ও সমাদরের সামগ্রী করে তোলেন।

তিন.

লালন সাঁই বাউলসাধনার সিদ্ধ পুরুষ। তাঁর সাধনার ভেতর দিয়েই বাউলমতের সর্বোচ্চ বিকাশ। লালন তাঁর অতুলনীয় সঙ্গীত-প্রতিভা ও তত্ত্বজ্ঞানের সমন্বয়ে বাউলগানের একটি স্বতন্ত্র ‘ঘরানা’ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর গানে বাউলের তত্ত্ব ও সাধনার গভীর পরিচয় প্রতিফলিত।

লালনের গানে দেহবিচার, মিথুনাত্মক যোগসাধনা, গুরুবাদ, মানুষতত্ত্ব- বাউলসাধনার এইসব বিষয় সঙ্গতভাবেই এসেছে। বাউলের সাধনার মূল অবলম্বন মানবদেহ ও মানবগুরুর নির্দেশনা। তাই দেহজরিপ ও গুরুবন্দনাই রয়েছে বাউলসাধনার মূলে। তার অনুষঙ্গে এসেছে সৃষ্টিতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব, খোদাতত্ত্ব, নবিতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব বা গৌরতত্ত্ব।

দেহকে কেন্দ্র করেই বাউলের সাধনা। এই দেহেই ‘পরম পুরুষে’র বাস। তাই দেহবিচারের মাধ্যমে আত্মস্বরূপ নির্ণয় করতে পারলেই সেই পরম প্রত্যাশিত ‘মনের মানুষে’র সন্ধান মেলে। লালনের গানে এই মানবদেহ কখনো ‘ঘর’, কখনো ‘খাঁচা’, ‘নৌকা’, আবার কখনো বা ‘আরশিনগর’ নামে চিহ্নিত। দেহঘরের অচীন বসতির পরিচয়-সন্ধানের ব্যাকুলতা তাঁর গানে প্রকাশ পেয়েছে এইভাবে :

আমার এই ঘরখানায় কে বিরাজ করে।

তারে জনম-ভর একদিন দেখলাম নারে \

নড়েচড়ে ঈশান কোণে

দেখতে পাইনে এ নয়নে

হাতের কাছে যার

ভবের হাট-বাজার

ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে \

লালন বলেন, ‘এই মানুষে আছে রে মন, যারে বলে মানুষ-রতন’। কিন্তু সেই মানুষ-দর্শনের অন্তরায় হলো :

আমার ঘরের চাবি পরের হাতে।

কেমনে খুলিয়ে সে ধন দেখব চক্ষেতে \

মানবদেহই বাউলের পুণ্যতীর্থ। এই উপলব্ধি থেকেই লালনের ঘোষণা :

উপাসনা নাই গো তার

দেহের সাধন সর্ব-সার

তীর্থ-ব্রত যার জন্য

এ দেহে তার সকল মেলে \

বাউলসাধনার সঙ্গে ‘মিথুনাত্মক যোগসাধনা’র রয়েছে গভীর সম্পর্ক। ‘চারিচন্দ্র’-ভেদ কিংবা ‘মীন’-ধরা- এই রূপকের ভেতর দিয়ে সাধনার এই বিষয়টি বাউলগানে এসেছে। ‘তিরপিনির তীরধারে, মীনরূপে সাঁই বিহার করে’- লালনের গানে এই গুপ্ত ‘অধর মানুষ’কে ধরার প্রয়োজন ও কৌশল বর্ণিত হয়েছে :

সময় বুঝে বাঁধাল বাঁধলে না।

জল শুকাবে মীন পালাবে পস্তাবি রে মন-কানা \…

মাস-অন্তে মহাযোগ হয়

নীরস হতে রস ভেসে যায়

করিয়ে সে যোগের নির্ণয়

মীনরূপে খেল্ দেখলে না \

যৌন-সম্ভোগ নয়, যৌন-সংযম ও কাম-নিয়ন্ত্রণই বাউলের মোক্ষের সঠিক পথ। ‘কামলোভী মনে’র ‘মদনরাজার গাঁটরি-টানা’ই যাতে সার না হয়, লালন তাই হদিশ দিচ্ছেন সঠিক পথের :

জেন্তে-মরা প্রেম-সাধন কি পারবি তোরা।

যে প্রেমে কিশোর-কিশোরী হয়েছে হারা \

শোষায় শোষে না ছাড়ে বাণ

ঘোর তুফানে বায় তরী উজান

ও তার কাম-নদীতে চর পড়েছে

প্রেম-নদীতে জল পোরা \

রিপুকে জয় করে ‘কামের ঘরে কপাট’ না মারলে সাধন-ভজনের সকল আয়োজনই বৃথা। লালন তাই কামলোভী ভণ্ড সাধকের কৃত্রিম ভজনাকে ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘প্রেম জানে না প্রেমের হাটের বুলবুলা’, কেন না ‘তাঁর মন মেতেছে মদনরসে, সদায় থাকে সেই আবেশে’।

চার.

পারস্যের মরমী কবি হাফিজ বলেছিলেন, অবশ্যই রূপকার্থে,- ‘মুরশিদ যদি নির্দেশ করেন, তবে জায়নামাজ শরাব দিয়ে রঞ্জিত করে দাও’। বাউলও এমনই এক গুরুবাদী লৌকিক স¤প্রদায়। তাই গুরু বা মুরশিদের মাহাত্ম্য-কথা এই ধর্মসাধনার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। গুরুর হাত ধরেই জ্ঞানরিক্ত শিষ্যের সাধন-ভজনের জগতে প্রবেশ। মীর মশাররফ হোসেনের ‘হিতকরী’ (৩১ অক্টোবর ১৮৯০) পত্রিকায় তাই এ-বিষয়ে স্পষ্টই বলা হয় : লালন ‘বড় গুরুবাদ পোষণ করিতেন’। লালনের গানে বাউলসাধনার এই অনুষঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশিত। লালন বলেছেন :

ভবে মানুষ-গুরু নিষ্ঠা যার

সর্ব-সাধন সিদ্ধ হয় তার \

বাউলসাধনায় গুরুই সার্বভৌম শক্তি। গুরুর মূল্য-মর্যাদা ও প্রয়োজন-গুরুত্বের কথা তাই লালনের গানে বারবার এসেছে :

গুরু-রূপের ঝলক দিচ্ছে যার অন্তরে।

ও তার কিসের আবার ভজন-সাধন লোক-জানিত ক’রে \

তাই সেই গুরুর প্রতিই লালনের বিনীত নিবেদন :

আমার জন্ম-অন্ধ মন-নয়ন

গুরু তুমি নিত্য-সচেতন

চরণ দেখব আশায় কয় লালন

জ্ঞান-অঞ্জন দেও নয়নে \

– গুরু-বন্দনার উজ্জ্বল নিদর্শন শিল্প-শোভিত এই পদটি।

পাঁচ.

বাউল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মরীতি ও শাস্ত্রকথাকে অনুমোদন করে না বলে বেদ ও ব্রাহ্মণ্য-আচারের ঘোর বিপক্ষে সে। লালন সেই নিরিখেই সাধনঘরের বসতিদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘ভুলো না মন বৈদিক ভোলে’, কেনো না ‘বেদ-বেদান্ত পড়বে যত বাড়বে তত লখ্ণা’। অভিজাত উচ্চবর্ণের শাস্ত্র বেদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ, তাই :

বেদে কি তার মর্ম জানে !

যেরূপ সাঁইর লীলা-খেলা

আছে এই দেহ-ভুবনে \

বেদের জ্ঞান সহজিয়া-সাধককে কখনো সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে না;- বরঞ্চ এক ধরনের বিভ্রান্তিরই জন্ম দেয়। পরমতত্ত্বের রহস্যভেদের আকাক্সক্ষা যাঁর মনে, সেই লালন তাই আফসোস করে বলেন :

কার বা আমি কে বা আর

আসল বস্তু ঠিক নাহি তার

বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার

উদয় হয় না দিনমণি \

ছয়.

বাউলসাধনার মর্ম জুড়ে আছে মানুষতত্ত্বের ভূমিকা। ‘আরশিনগরের পড়শি’ যিনি, তিনিই লালনের ‘মনের মানুষ’, তিনিই ‘অচীন মানুষ’, ‘অলখ সাঁই’, ‘সাঁই নিরঞ্জন’। এই ‘মানুষে’র অন্বেষণেই বাউলের সাধনার দিন বয়ে যায়। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ আর ‘মানুষতত্ত্ব ভজনের সার’- এই জ্ঞানকে অন্তরে ধারণ করেই লালন বলেন :

মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে

সে কি অন্য তত্ত্ব মানে \

মনের মানুষের সন্ধান, সাহচর্য ও মিলনের জন্যে লালনের মন সর্বদাই ব্যাকুল ও উৎকণ্ঠিত :

আমার মনের মানুষের সনে

মিলন হবে কতদিনে \

কিন্তু সাধন-সিদ্ধি হয় না বলে :

সে আর লালন একখানে রয়

তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে \

সাত.

বাউলগান বাংলার একটি প্রধান লৌকিক ধর্ম-স¤প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। তাদের রহস্যময় অধ্যাত্ম-সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি কেবল দীক্ষিতজনের কাছে প্রচারের জন্যেই এই গানের জন্ম। শিল্প-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। লালনও তাই বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় তাঁর গান রচনা করেননি, বিশেষ উদ্দেশ্য-সংলগ্ন হয়েই তাঁর এই গানের জন্ম। তবে প্রায় ক্ষেত্রেই উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে অতিক্রম করে লালনের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে স্বমহিমায়। লালনের গান তাই একাধারে সাধনসঙ্গীত, দর্শনকথা ও শিল্পশোভিত কাব্যবাণী। তত্ত্বসাহিত্যের ধারায় চর্যাগীতিকা বা বৈষ্ণব পদাবলি সাধনসঙ্গীত হয়েও যেমন উচ্চাঙ্গের শিল্পসাহিত্যের নিদর্শন, তেমনি বাউলগানের শ্রেষ্ঠ নজির লালনের গান সম্পর্কেও এই একই কথা বলা চলে।

দীর্ঘজীবী লালন প্রায় পৌনে এক শতাব্দী ধরে গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও অনুমান করা যায় তা অনায়াসেই হাজারের কোঠা ছাড়িয়ে যাবে। তবে এ-যাবৎ সংগৃহীত তাঁর প্রামাণ্য গানের সংখ্যা কোনোমতেই সাতশো ছাড়িয়ে যাবে না। লালন ছিলেন নিরক্ষর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের কোনো সুযোগই তাঁর হয়নি। কিন্তু তাঁর সঙ্গীতে বাণীর সৌকর্য, সুরের বিস্তার, ভাবের গভীরতা আর শিল্পের নৈপুণ্য লক্ষ করে তাঁকে নিরক্ষর সাধক বলে মানতে দ্বিধা থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন স্বশিক্ষিত। ভাবের সীমাবদ্ধতা, বিষয়ের পৌনঃপুনিকতা, উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের বৈচিত্র্যহীনতা ও সুরের গতানুগতিকতা থেকে লালন ফকির বাউলগানকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর সমকালেই তাঁর গান লৌকিক ভক্তমণ্ডলির গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষিত সুধীজনকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাই তাঁর গানের যোগ্য কদরদানি করেছিলেন। উত্তরকালে লালনের গান দেশের ভূগোল ছাড়িয়ে বিদেশেও স্থান করে নিয়েছে। এই নিরক্ষর গ্রাম্য সাধককবির শিল্প-ভুবনে প্রবেশ করলে বিস্মিত হতে হয় যে, তিনি কতো নিপুণভাবে শিল্পের প্রসাধন-প্রয়োগ করেছেন তাঁর গানে। ভাব-ভাষা, ছন্দ-অলঙ্কার বিচারে এই গান উচ্চাঙ্গের শিল্প-নিদর্শন এবং তা তর্কাতীতরূপে কাব্যগীতিতে উত্তীর্ণ। লোকপ্রিয় লালনের গান আজ তাই সঙ্গীত-সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।

লালনের কবিত্ব-শক্তির পরিচয় তাঁর অনেক গানেই পাওয়া যায়। বহুল উচ্চারিত তত্ত্বকথা ও সীমাবদ্ধ বিষয়ের অনুবর্তন সত্ত্বেও লালন তাঁর সঙ্গীতে সেই গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে নতুন ভাব-ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন। তত্ত্বকথার দুরূহ ও ক্লান্তিকর বদ্ধ আবহে এনেছেন শিল্প-সৌন্দর্যের সুবাতাস। তাই বাংলার মরমী কবিদের মধ্যেই যে কেবল তিনি শ্রেষ্ঠ তাই নয়, বাংলার সঙ্গীতসাহিত্যের ইতিহাসেও তিনি এক কালোত্তীর্ণ স্মরণীয় শিল্পী-ব্যক্তিত্ব।

মূলত লালনের গানের অসামান্য শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য, উচ্চাঙ্গের দর্শন ও প্রবল মানবিকতাবোধের জন্যে এ দেশে রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্নদাশঙ্কর রায় এবং বিদেশে চার্লস ক্যাপওয়েল থেকে ক্যারল সলোমন- এঁরা লালনের গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। বাউলগানের রসজ্ঞ বোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন :

সাহিত্যের ঐকতানসঙ্গীতসভায়

একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়-

[“ঐকতান”, ‘জন্মদিনে’]

-তার এই আন্তরিক প্রত্যাশা বাংলা সাহিত্যের দরবারে লালন ফকিরের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্থকভাবে পূরণ হয়েছে এ-কথা বলা যায়।

আট.

বাউলগান লৌকিক সমাজের মরমী অধ্যাত্মসাধনার অবলম্বন হলেও লালনের হাতে তা অধিকতর সামাজিক তাৎপর্য ও মানবিক বিশ্বাসে সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। লালনের গানে ধর্ম-সমন্বয়, স¤প্রদায়-স¤প্রীতি, মানব-মহিমাবোধ, অসা¤প্রদায়িক চেতনা, আচারসর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধতা, বর্ণশোষণ-জাতিভেদ ও ছুঁৎমার্গের প্রতি ঘৃণা, সামাজিক অবিচার ও অসাম্যের অবসান-কামনা- এইসব বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। মূলত তাঁর বিদ্রোহ প্রথাগত শাস্ত্রাচার ও প্রচলিত সমাজধর্মের বিরুদ্ধে। এই ধরনের বক্তব্যের ভেতর দিয়ে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতাবাদী মনের পরিচয় পাওয়া যায়। লালন তাঁর আন্তরিক বোধ ও বিশ্বাসকে অকপটে তাঁর গানে প্রকাশ করেছেন। তাঁর আদর্শ ও জীবনাচরণের সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের কোনো অমিল হয়নি- বিরোধ বাধেনি কখনো।

লালনের গান মানব-বন্দনা ও মানব-মহিমারও গান। ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনকে সুকর্মে উদ্বুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে ইহজাগতিকতার চেতনায় বিশ্বাসী লালন বলেছেন :

অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই

শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই

দেব-দেবতাগণ করে আরাধন

জন্ম নিতে এই মানবে \

কত ভাগ্যের ফলে না জানি

মন রে পেয়েছো এই মানবতরণী

বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়

যেন ভারা না ডোবে \

সাধন-ভজনের পথ-নির্দেশের জন্যে দেব-দেউল কিংবা কোনো প্রত্যাদেশ নয়, মর্ত্যরে মানবগুরুকেই সাধনপথের চলমান পথিক ধ্রæবতারা মেনেছে। দুর্লভ মানব-জনমের গুরুত্ব, মানবমুখীন চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ এইভাবেই বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রিক লালনের গানে জয়ী হয়েছে।

এ দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে জাতিভেদ ও ছুঁৎমার্গের অস্তিত্ব ছিল দুষ্টক্ষতের মতোই। এই কুপ্রথা ও কুসংস্কার ধর্মকে আশ্রয় করে সমাজজীবনে শক্ত আসন প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। মানুষের মনে এই সংস্কার ও ভেদবুদ্ধি এমন গভীর ছাপ ফেলেছে যে সহজে ও সমূলে এর উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। লালন এরই বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন। লালন জানতেন, শুদ্ধ সাধনভক্তির জোরে অবজ্ঞাত তন্তুবায় কবির ও অস্পৃশ্য চর্মকার রামদাস মহাসাধকে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

তাই তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে :

ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই।

হিন্দু কি যবন বলে তার জাতের বিচার নাই \

লালন জীবনভর বর্ণশোষণ, জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সংগ্রাম করে এসেছেন। তাঁর নিজের জীবনেও এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে অনেকবারই। প্রথম জীবনে মুসলমানের গৃহে অন্ন-জল-আশ্রয় গ্রহণের জন্যে লালনকে শুধু সমাজচ্যুতই হতে হয়নি, স্নেহময়ী জননী ও প্রিয়তমা পতœীকেও হারাতে হয়েছে। এইসব নির্মম ও বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো তাঁর ভেতরে গড়ে উঠেছিল একটি প্রতিবাদী সত্তা। লালন তাই কখনোই জাতিত্বের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। একজন মানবপ্রেমী সংস্কারমুক্ত বাউল হিসেবে তিনি জানতেন, জাতের অহমিকা ও দ্ব›দ্ব মানুষকে খণ্ডিত ও ক‚পমণ্ড‚ক করে রাখে। তাই জাতধর্মের বিরুদ্ধে চরম বক্তব্য পেশ করে তিনি বলেছেন :

জাত না গেলে পাইনে হরি

কি ছার জাতের গৌরব করি

ছুঁসনে বলিয়ে।

লালন কয় জাত হাতে পেলে

পুড়াতাম আগুন দিয়ে \

লালন মধ্যযুগের সন্ত-সাধক কবির-তুলসিদাস-দাদু-রামদাস-পল্টু-রজ্জবের মতোই ধর্মীয় বিভেদকে তুচ্ছ করে স¤প্রদায়-স¤প্রীতির স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি হিন্দু-মুসলমানের জাতিগত বিরোধ ও বৈষম্যের বিপক্ষে আন্তরিক ও জোরালো মত প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর গানে অনবদ্য ও অকাট্য যুক্তি-সন্নিবেশের মাধ্যমে বিভেদকামী মানসিকতাকে ধিক্কার দিয়েছেন তীব্রভাবে :

একই ঘাটে আসা-যাওয়া

একই পাটনি দিচ্ছে খেওয়া

কেউ খায় না কারো ছোঁয়া

বিভিন্ন জল কে কোথায় পান\

পাশাপাশি আবার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন :

বেদ-পুরাণে করেছে জারি

যবনের সাঁই আর হিন্দুর হরি

আমি তা বুঝতে নারি

দুইরূপ সৃষ্টি করলেন কি তার প্রমাণ \

অন্যত্র নিজেই সিদ্ধান্ত করেছেন এইভাবে :

এক চাঁদে হয় জগৎ আলো

এক বীজে সব জন্ম হলো

ফকির লালন কয় মিছে কল’

কেন করিস সদাই \

লালনের এই বক্তব্যে বিভেদহীন অখণ্ড মানবসমাজের ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

লালনের আচার-আচরণ ও বক্তব্যে সমকালের মানুষ ধাঁধায় পড়েছিল তাঁর জাত-পরিচয় নিয়ে। লালন বহুবার তাঁর জাত-ধর্ম সম্পর্কে অবাঞ্ছিত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু সা¤প্রদায়িক জাতিত্বে অবিশ্বাসী লালন অনুদারভেদপন্থীদের এই কৌত‚হল নিরসন না করে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন। তাঁর সেই বক্তব্যের যুক্তিতে জাতবিচারী মানুষের অহঙ্কার চূর্ণ হয়েছে। লালন স্পষ্টই বলেছেন, তিনি হিন্দু না মুসলমান এ-প্রশ্ন তার কাছে অর্থহীন ও অসমাধ্য। এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য :

সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।

লালন কয় জেতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে \

মানুষের জাতি-গৌরব-চেতনাকে প্রশ্রয় দেননি লালন, তাই সে ‘জেতের ফাতা’ বিকাতে চেয়েছেন ‘সাধ-বাজারে’।

লালনের গান বাউল স¤প্রদায়ের গুহ্য-সাধনার বাহন হলেও এর ভেতরে মাঝে-মধ্যে বিস্ময়কর সমাজচেতনা প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক অবিচার ও অসাম্য, ধর্মীয় গোঁড়ামি, শ্রেণি-শোষণ ও গোত্র-বৈষম্য এই মরমী সাধকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাই অধ্যাত্ম-উপলব্ধির অবসরে, প্রক্ষিপ্ত চিন্তার চিহ্ন হলেও, তিনি এসব বিষয়ে তাঁর অকপট-আন্তরিক বক্তব্য পেশ করেছেন। বিত্তবান ও বিত্তহীন, কুলীন ও প্রাকৃত, শোষক ও শোষিতে বিভক্ত সমাজে দরিদ্র-নিঃস্ব-নির্যাতিত নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন লালন।

নয়.

প্রচলিত ধারণায় লালন ছিলেন সমাজবিচ্ছিন্ন অধ্যাত্ম-বিবরবাসী এক আত্ম-সমাহিত সাধক। কিন্তু সমাজমনস্কতার বিচারে এই ধারণা পুনর্বিবেচনার অপেক্ষা রাখে। যেমন, লালনের সাহসী সামাজিক ভূমিকার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে তাঁর পরম-বান্ধব কাঙাল হরিনাথকে জমিদারের সহিংস আক্রোশ থেকে রক্ষার ঘটনায়। হরিনাথ তাঁর ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকায় শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়নের সংবাদ প্রকাশ করলে জমিদারপক্ষ তাঁর ওপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। কাঙালকে শায়েস্তার জন্যে তাঁরা দেশীয় লাঠিয়াল ও পাঞ্জাবি গুণ্ডা নিয়োগ করেন। কাঙালের অপ্রকাশিত ‘দিনপঞ্জি’ থেকে জানা যায়, জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে বিপন্ন বন্ধু হরিনাথকে রক্ষার জন্যে বাউলসাধক লালন ফকির ‘তার দলবল নিয়ে নিজে লাঠি হাতে সেই লাঠিয়ালের দলকে আচ্ছা করে ঢিঢ্ করে সুহৃদ কৃষকবন্ধু হরিনাথকে রক্ষা করেন’।

দশ.

লালনের গান সমাজ-সম্পর্কের ধারা বেয়ে সা¤প্রদায়িকতা-জাতিভেদ-ছুঁৎমার্গ- এইসব যুগ-সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছিল। এই প্রয়াসের মাধ্যমে লালন সমাজসচেতন, মানবতাবাদী ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিচয় দিয়েছেন তার স্বরূপ নির্ণয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। লালনের এই ঐতিহাসিক ভূমিকাকে কেউ কেউ বাংলার সামাজিক জাগরণের পুরোধা রাজা রামমোহন রায়ের অবদানের সঙ্গে তুলনা করতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অন্নদাশঙ্কর রায় মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোক-মানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব’। অধ্যাপক অমলেন্দু দে-ও লোকায়ত জীবনে লালনের সুগভীর প্রভাব এবং নবজাগৃতির প্রেক্ষাপটে লালন ও রামমোহনের ভূমিকার তুলনামূলক আলোচনার গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।

আমাদের বিশ্বাস, নবজাগৃতির পটভূমিকায় রামমোহন ও লালনের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবদানের আলোচনা হলে দেখা যাবে লালনের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদ, সংস্কার ও জাতিভেদ-বিরুদ্ধ মনোভাবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কতোখানি। জানা যাবে, লালনের মানবিক মূল্যবোধ ও মানবধর্মী চিন্তাধারার প্রভাব বাংলার গ্রামদেশের প্রাকৃত জনগোষ্ঠী এবং নগরবাসী কিছু শিক্ষিত কৃতী পুরুষের মনেও কী গভীর প্রভাব ফেলেছিল, কতোখানি আন্তরিক ও অকৃত্রিম ছিল সেই প্রচেষ্টা। নবজাগতির অন্যতম শর্ত যে অসা¤প্রদায়িক মানবতাবাদ, তা এই স্বশিক্ষিত গ্রাম্যসাধকের বাণী ও সাধনার ভেতরেই প্রকৃত অর্থে সত্য হয়ে উঠেছিল- প্রাণ পেয়েছিল। যথার্থই গ্রাম-বাংলার এই মানবতাবাদী মুক্তবুদ্ধি-আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন লালন সাঁই।

এগারো.

দ্রোহী ও প্রতিবাদী লালন প্রথা-সংস্কার-শাস্ত্রের দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে নতুন এককালের অভ্যুদয় কামনা করেছিলেন। নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন সমাজহারা মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে। সমাজশিক্ষকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে সামাজিক শোষণ-অন্যায়-কলুষতাকে দূর করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। শত সংকটেও বিচলিত হননি। কাল বিরোধী ছিল- সমাজশক্তি ছিল অন্তরায়। তাই কখনো আফসোস জেগেছে আক্রান্ত লালনের মনে, খেদের সুর চড়িয়ে গান ধরেছেন :

এ দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথা যাই না জানি।

পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেলো ছেঁচতে পানি \

কিন্তু লালন হারতে চাননি- তাঁর লড়াই জারি রেখেছেন খাঁচার পাখি উড়াল দেওয়ার আগ পর্যন্ত। দুঃখ এসেছে- ঝড় উঠেছে- নির্যাতন সইতে হয়েছে, তবু এই সহিষ্ণু-সৌম্য সাধক ধীর পায়ে এগিয়ে গেছেন তাঁর গন্তব্যের লক্ষ্যে। অবিচল বিশ্বাস ছিল জীবনের প্রতি- আস্থা ছিল মানুষের প্রতি। তাই তো দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করতে পেরেছেন :

মানুষ অবিশ্বাসে পাই নে রে সে মানুষনিধি।

এই মানুষে মিলতো মানুষ চিনিতাম যদি\

সুবিচার ছিল না- বিবেক ছিল না- প্রেম ছিল না, তাই প্রচলিত শাস্ত্র-ধর্ম-শাসন-বিচার সবকিছু সম্পর্কেই তাঁর ছিল অবিশ্বাস, অনাস্থা ও ক্ষোভ। সে-কারণেই রূপকের আড়ালে হলেও উচ্চ কণ্ঠে বলতে দ্বিধা করেননি :

রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি

চোরেরও শিরোমণি

নালিশ জানাবো কার কাছে\

প্রত্যাদেশ বিশ্বাস করেননি- পাপ-পুণ্য মানেননি; শুধু আরাধনা করেছেন মানুষের- দুর্লভ মহিমাময় বিবেচনা করেছেন মানবজনমকে। কী সাহসে বলেন লালন, ভেবে বিস্মিত হই :

এক এক দেশে এক এক বাণী

পাঠান কি সাঁই গুণমণি

এসব মানুষের রচনা জানি

লালন ভেবে কয়\

পৃথিবীতে পাপ-পুণ্য বলে কিছু নেই, ছিলও না কখনো- যুক্তির শর-নিক্ষেপে পাপ-পুণ্যের বিশ্বাসকে বিচূর্ণ করেছেন :

দেশ সমস্যা অনুসারে

ভিন্ন বিধান হতে পারে

সূ² জ্ঞানের বিচার করে

পাপ-পুণ্যের নাই বালাই\

একমাত্র মানুষই সত্য, আর সব মিথ্যা, অলীক-কুহক-মায়ার বিভ্রম। কেবল এই মানবজন্মই সত্য- ইহলোকের ওপারে আর কিছু দৃশ্যমান নয়। লালনের কাছে এ-কারণেই ‘জগৎ সত্য, ব্রহ্ম মিথ্যা’। তাই তাঁর কণ্ঠে শুনি ইহজাগতিকতার জয়ধ্বনি :

এমন মানব-জনম আর কি হবে।

মন যা কর ত্বরায় কর এই ভবে\

মানুষের মুক্ত ভূমির সন্ধানে- মহৎ জীবনের অভিসারে লালন যাত্রা করেছিলেন। তিনি হতে চেয়েছিলেন তরঙ্গমুখর এক জলধি, কিন্তু বিরূপ পরিবেশের চাপে হয়ে রইলেন এক গণ্ডুষ পানীয়ের ‘ক‚পজল’। তাই দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকারে দীর্ণ লালনের কণ্ঠে ফুটে ওঠে ক্ষোভ আর নৈরাশ্যের যুগলবন্দি :

রাখলেন সাঁই ক‚পজল করে আন্ধেলা পুকুরে।

কিন্তু অমৃতের সন্তান- মহৎ জীবন-অভিসারের যাত্রী লালন ভরসা হারাননি, বিশ্বাসচ্যুত হননি,- সময়ের প্রত্যাশায় তাই অপেক্ষায় থেকেছেন :

কবে হবে সজল বরষা

রেখেছি মন সেই ভরসা…

-এই আশাবাদের নামই লালন- এই বিশ্বাসের নামই লালন- এই ভবিষ্যতের নামই লালন।

বারো.

উদার ও প্রগতিশীল মানসতার কারণে সমকালীন সমাজে লালনকে যথেষ্টই নিন্দিত ও নিগৃহীত হতে হয়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় স¤প্রদায়ের শাস্ত্রবাহক মৌলবাদীরাই লালনের বিপক্ষে ছিলেন। মুসলমানের চোখে লালন বেশরা-বেদাতি নাড়ার ফকির, -আবার হিন্দুর কাছে ব্রাত্য-কদাচারী হিসেবে চিহ্নিত। ধর্মগুরু ও সমাজপতি উভয়ের নিকটেই লালনের বাণী ও শিক্ষা অস্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু লালন তাঁর উদার প্রেমধর্মের বাণীকে সমাজশিক্ষার বাহন করে ক্রমশ তাঁর অনাকাক্সিক্ষত গন্তব্যে যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলেন। উত্তরকালেও লালন আক্রান্ত হয়েছেন- বাউল বা লালনবিরোধী আন্দোলন থেমে থাকেনি। জারি হয়েছে ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’,- রচিত হয়েছে ‘রদ্দে নাড়া’, ‘ভণ্ড ফকীর’, ‘সাধু সাবধান’, ‘বাউল একটি ফেতনা’, ‘নেড়ার ফকিরের গুপ্তকথা’-র মতো বিদ্বেষপূর্ণ পুস্তিকা। মৌলবাদী আক্রমণে কিছুকাল আগে ঢাকায় বিধ্বস্ত হয়েছে লালন-স্থাপত্য। তবে আশার কথা, স্বদেশে অনুদার-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির লালনবিরোধী ভূমিকার পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির সুস্থ ধারার চর্চা যাঁরা করেন, তাঁরা লালনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাই লালনের সমাধিসৌধের শান্ত-সৌম্য আবহ ক্ষুণœ করার প্রয়াস প্রতিহত করতে গড়ে ওঠে ‘লালন আখড়া রক্ষা কমিটি’। লালন-স্থাপত্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালি। এরই পটভূমিতে ২০০৮-এ বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের জাতীয় সম্মেলনে মূল থিম ঘোষিত হয়- ‘লালন আমার প্রাণের স্পন্দন’। কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক গণিত উৎসব (২০০৯) উৎসর্গিত হয় লালনের উদ্দেশে। এই সাধক পদ্মার বুকে ঠাঁই পান ‘লালন-সেতু’ নামকরণের ভেতর দিয়ে। বাংলাদেশের বাউলগান, যার প্রধান রূপকার লালন সাঁই- সেই বাউলগানকে ইউনেস্কো ২০০৫-এ ‘ধ গধংঃবৎঢ়রবপব ড়ভ ঃযব ঙৎধষ ধহফ ওহঃধহমরনষব ঐবৎরঃধমব ড়ভ ঐঁসধহরঃু’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে লালন পৌঁছে গেছেন দেশান্তরে। এইভাবে লালন হয়ে ওঠেন কালান্তরের পথিক- বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারার কালপুরুষ।

লালনের পরিচয় ও প্রতিষ্ঠার পরিধি আজ দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বের মানচিত্রকে স্পর্শ করেছে। তাঁর প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশে বাউল ও লালন সম্পর্কে আগ্রহ ও অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায় চার্লস ক্যাপওয়েল, এডওয়ার্ড সি. ডিমক, জোসেফ কুকার্জ, জুনে ম্যাকড্যানিয়েল, ক্যারল সলোমন, ম্যান্ড্রিন উইনিয়স, ফাদার মারিনো রিগন, মাসাউকি ও’নিশি, জান ওপেনশ’, মাসাহিকি তোগাওয়া প্রমুখের রচনায়। অদূর ভবিষ্যতে বহির্বিশ্বে লালন বাংলাদেশ ও বঙ্গ-সংস্কৃতির প্রতিনিধি-ব্যক্তিত্ব হিসেবে গৃহীত হবেন সে সম্ভাবনা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

তেরো.

লালনের মৃত্যুর পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ১২৭ বছর। তবু আজও লালন সমান প্রাসঙ্গিক, জনপ্রিয় ও আধুনিক। তাঁর গান বাউলসমাজের সাধনার উপকরণ হিসেবে যেমন বিবেচিত, তেমনি সঙ্গীতরসিকের মরমী চিত্তকেও আলোড়িত করতে সক্ষম, পাশাপাশি সমাজভাবনার অনুষঙ্গেও তা মূল্যবান। লালন-গবেষক ডক্টর ক্যারল সলোমন একবার এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘লালন যে সা¤প্রদায়িকতা-বিরোধী, সে ম্যাসেজটা বেশ কয়েকটা গানে পাওয়া যায়।… আবার বেশকিছু গান আছে যা গোঁড়ামি এবং সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে। লালন বিশ্বাস করেছিলেন যে, মানুষ শ্রেষ্ঠ। তা হলে দেখা যায় যে, লালনের গানে বিশ্ব-মানবমৈত্রীর উপকরণ আছে’। আজ আবার নতুন করে সা¤প্রদায়িকতা-মৌলবাদের উত্থানের কালে- মনুষ্যত্ব-মানবতার লাঞ্ছনার সময়ে- সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের বৈরী যুগে লালনের গান হতে পারে প্রতিবাদের শিল্প- শান্তি ও শুভবুদ্ধির প্রতীক- মানুষের প্রতি হারানো বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার পরম পাথেয়।

ড. আবুল আহসান চৌধুরী: সাহিত্যিক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও লোকসংস্কৃতি বিশ্লেষক

এনই

বাউলের জন্ম,ফকির লালন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close