• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ভোটের রাজনীতিতে যে কারণে বাড়ছে ইসলামপন্থীদের শক্তি

প্রকাশ:  ১২ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:১৯ | আপডেট : ১২ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:৩০
পূ্র্বপশ্চিম ডেস্ক

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় ৭০টি ইসলামী দল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এবারের অংশ নিচ্ছে। এসব দলের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল রয়েছে ১০টি। তাদের মধ্যে ৬টি রয়েছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে, আর ২টি বিএনপি জোটের সঙ্গে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইসলাম এবং ধর্ম দিনে দিনে কতটা জায়গা করে নিয়েছে তার প্রমাণ চোখে পড়েছে নভেম্বরের ৪ তারিখ, ঢাকায়।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর যে অংশটি ধর্ম এবং সমাজ নিয়ে অত্যন্ত রক্ষণশীল মনোভাব পোষণ করে সেই কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে সংবর্ধনা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় একই মঞ্চে ছিলেন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফি যাকে বাংলাদেশে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রতিভূ হিসাবে বিবেচনা করেন অনেকেই।

সম্পর্কিত খবর

    সন্দেহ নেই , নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ এখন হেফাজতের সাথে সখ্যতা তৈরির চেষ্টা নিয়ে কোনও রাখঢাক করতে চায় না। তারও কিছুদিন আগে সেপ্টেম্বর মাসে ১৫টি ইসলামী এবং সমমনা দল ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স নাম নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেই জানিয়ে দেয়, তারা আসছে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে।

    বাংলাদেশের সবচেয়ে সংগঠিত ইসলামী দল জামাতে ইসলামীর সাথে বিরোধী বিএনপির গাঁটছড়া এখন গা-সওয়া একটি বাস্তবতা। কিন্তু ইসলামপন্থীদের সাথে পেতে আওয়ামী লীগও যে দিন দিন তৎপর হচ্ছে, সেটা নিয়েও এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই।

    বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান বলেন, বাংলাদেশের বড় দু’টো দলই এখন বিশ্বাস করে, ইসলামপন্থীদের সাথে সম্পৃক্ততায় ভোটের রাজনীতিতে বাড়তি সুবিধার সাথে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। দু’টো বড় দলই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি তারা তাদের নীতি বা নির্বাচনী প্রচারণায় ইসলামী আবেগ অনুভূতির প্রতিফলন নিয়ে দিন দিন আগ্রহী হচ্ছে।

    তিনি বলেন, ষাটের বা সত্তরের দশকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইসলামী ইমেজ নিয়ে আগ্রহী ছিল না। '৭১-এ আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি ছিল ধর্মনিরেপক্ষতা। অথচ এখন সব দলেরই এটা একটা বিবেচনা। তাদেরকে যেন কোনোভাবেই অনৈসলামীক হিসাবে প্রতিপন্ন না করা হয়, তা নিয়ে তারা এখন খুবই উদগ্রীব।

    ‘মুখে হয়তো অনেকে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলছে, কিন্তু নিজেদের এমনভাবে দেখানোর চেষ্টা করছে যে কেউ যেন তাদের বলতে না পারে যে তারা ইসলাম রীতিনীতি মেনে চলেছেন না।’

    অন্য কোনো সিদ্ধান্তে বিএনপি যেতে পারবে না’

    যে দলটি খোলাখুলি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল সেই জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট নিয়ে বিএনপিকে এখনও সমালোচনা শুনতে হয়। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম মনজু বলেন, ইসলামী দলগুলোর সাথে জোটবদ্ধতা এখন বাস্তবতা এবং এ মুহূর্তে এ থেকে বেরুনো সম্ভব নয়।

    ‘বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ, এখানে ২৪/২৫টি ইসলামী দল রাজনীতিতে তৎপর। বিভক্ত হয়ে তারা বিভিন্ন জোটে আছে। এ থেকে এ মুহূর্তে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ যে ধরনের প্রতিযোগিতা চলছে, অন্য কোনও সিদ্ধান্তে বিএনপি যেতে পারবে না।’

    ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের ফ্যাক্টর যারা, তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগও জোট করে, আমরাও করি। বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ এ ভাবেই হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, জামাতের সাথে আমাদের সম্পর্ক নিয়েও জনগণের মধ্যে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। এটা শুধুই একটা নির্বাচনী জোট, যার যার রাজনীতি আলাদা।’

    শুধুই ভোট নাকি অন্য আরও অংক?

    বাংলাদেশে নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো বড় জোর ১০% থেকে ১২% ভোট পায়, যার সিংহভাগই যায় জামায়াতে ইসলামীর বাক্সে। এই ১০%-১২% ভোটের ভাগ নিতেই কি শুধু ইসলামপন্থীদের নিয়ে দুই বড় দলের টানাটানি? নাকি আরও বড় কোনও বিবেচনা রয়েছে?

    যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রিয়াজ যিনি বাংলাদেশ ইসলামী রাজনীতির প্রভাব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন তিনি বলেন, ইসলামী দলগুলো বিভিন্নভাবে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। এক, সাংগঠনিকভাবে রাজনীতিতে এবং নির্বাচনে তাদের অবস্থান তৈরি। দুই, বাংলাদেশের সমাজে ইসলামপন্থী ভাবধারার প্রসার।

    তিনি মনে করেন, শুধু ভোটই নয়, সাংগাঠনিকভাবেও সাহায্য করতে পারে এসব ইসলামী দল। তারা লোক জোগাড় করে দিতে পারে, একইসাথে, সমাজে ইসলামী ভাবধারায় বিশ্বাসীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিতে পারে।

    কিন্তু সে ধরণের গ্রহণযোগ্যতা বা স্বীকৃতি এখন কতটা প্রয়োজন বড় দলগুলোর?

    বাংলাদেশের সমাজে ইসলামীকরণ একটি বাস্তবতা’

    রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সমাজে ইসলামী ভাবধারার দ্রুত প্রসার হচ্ছে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেই বাস্তবতাকে গ্রহণ করছে।

    ‘বাংলাদেশের সমাজে ইসলামীকরণ একটি বাস্তবতা যদিও সেটা নেতিবাচক কি ইতিবাচক তা ভিন্ন বিষয়। চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে, আচার আচরণের ক্ষেত্রে সেটা এখন ব্যাপক। বিশেষ করে গত এক দশকে এর ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে।’

    ‘সমাজে যখন এসব চিন্তা-ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন রাজনৈতিক দলগুলো সেগুলো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। সেটাই এখন হচ্ছে।’

    রিয়াজ বলেন, বড় দলগুলো ভাবছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাভাবনায় সায় দেওয়াই তাদের জন্য নিরাপদ, সুবিধাজনক। সে কারণেই তারা এ ধরনের জোট চাইছে। ইসলাম-পন্থার কথা বলে, ইসলামী মূল্যবোধের কথা বলে, মুসলিম পরিচিতির কথা বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আশা করছে।

    ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম আওয়ামী লীগ

    ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখনও বলে, তারা ধর্মনিরপেক্ষ দল। দলের নেতারা উদাহরণ দেন যে ২০১১ সালে তারা সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতি পুণঃস্থাপন করা হয়েছে।

    তাহলে ইসলামপন্থীদের সমর্থন আদায়ে তারাও কেন এত তৎপর? আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং দলের প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন স্বীকার করেন, সমাজে ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধির বাস্তবতার সাথে তাদের দলকে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে।

    ‘৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত ধর্মরিপেক্ষতার বোধ সমাজে যতটা ধারালো ছিল, এখন তা নেই। ৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়া হয়। একের পর এক সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করেছে এবং ধর্মীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, এসবের প্রভাব তো সমাজে পড়েছেই।’

    এছাড়া তিনি বলেন, এখন দুনিয়া-ব্যাপী মৌলবাদী ধর্মের প্রভাবে বাড়ছে, বাংলাদেশের মুসলমানরাও তার বাইরে নয়। আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থকদের বেশিরভাগই তো মুসলিম। তাদের মধ্যেও ধর্মান্ধতা না হোক, মৌলবাদ না হোক, ধর্মের প্রভাব তো বেড়েছেই, এটা নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

    লেনিন বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আনতে গিয়েও আওয়ামী লীগ ধর্মের বাস্তবতাকেই কার্যত মেনে নিয়েছে। আমরা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে এনেছি, কিন্তু একই সাথে বিসমিল্লাহির রাহমানের রহিম রেখে দিয়েছি। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম - তা রেখে দেওয়া হয়েছে। কারণ, এগুলো মানুষের ধর্মীয় আবেগের সাথে জড়িত। পরিস্থিতির পরিবর্তন, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির প্রভাবের কারণে আমাদের এ্যাডজাস্টমেন্ট, আপোষ করতে হয়েছে।

    ধর্মীয় রক্ষণশীলতা প্রসারের পেছনে নব্য মধ্যবিত্ত

    কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মীয় রক্ষণশীলতার এই প্রসার কেন ঘটলো? ড. আলী রিয়াজ মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি ছাড়াও বাংলাদেশের সমাজে গজানো নতুন একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

    তার মতে, নতুন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ধর্মীয় আচরণকে লোকচক্ষে দেখানোর একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এটা করতে গিয়ে সমাজ এবং রাজনীতিকে তারা প্রভাবিত করছে। এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের একটা ফল।

    একই মনোভাব পোষণ করেন ড. রওনক জাহান। তিনি বলেন, কোনও সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশের সমাজে ধর্মের উদযাপন এবং বাহ্যিক প্রকাশ অনেক বেড়ে গেছে। অনেকের হাতে অনেক পয়সা এখন তারা হজ করতে যাচ্ছেন।

    ড. জাহান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো এতে প্রভাবিত হচ্ছে। নতুন এই বাস্তবতার সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।

    কট্টর রক্ষণশীলতার প্রভাব বাড়বে?

    বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি? ড. রিয়াজ মনে করেন, ধর্মের প্রভাব বাড়বে, এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অব্যাহত অনুপস্থিতি সেটিকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে। যদি বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি না আসে, তাহলে মূলধারার দলগুলোকে এই ধরণের ধর্মীয় রক্ষণশীল শক্তির মুখাপেক্ষী হতে হবে।

    ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার দিক হচ্ছে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির অভাবে এমন সব ইসলামপন্থীদের প্রভাব বাড়ছে যারা তুলনামুলকভাবে অধিকতর রক্ষণশীল। তারা এমন সব ধারণা উপস্থিত করছেন যা সমাজ প্রগতির জন্য বিপজ্জনক।’

    তিনি কি হেফাজতের কথা বলছেন? এই প্রশ্নে ড. রিয়াজ বলেন, হেফাজত তাদের একটি প্রতিনিধি, সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি, কিন্তু একমাত্র নয়।

    আওয়ামী লীগের হেফাজত কৌশল

    বাংলাদেশের সমাজে বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব যত কমেছে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের প্রধান ভরসার জায়গা উঠেছে আওয়ামী লীগ। হেফাজতের মত ধর্মীয় রক্ষণশীল দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের সখ্যতায় সমাজের সেই অংশটি যে উদ্বিগ্ন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

    আওয়ামী লীগের নুহ-উল আলম লেনিন বলেন, হেফাজতের সাথে তার দল যদি ‘কম্প্রোমাইজ’ করেও থাকে, সেটা ভোটের বিবেচনায় নয়, বরঞ্চ ‘বিপজ্জনক ধর্মীয় রাজনীতি থেকে দেশকে বাঁচানোর’ কৌশল হিসাবে তা করেছে।

    ‘ধর্মের নামে যে রাজনীতি হচ্ছে, তা থেকে যদি ধর্মে বিশ্বাসী বা ধর্মীয় বড় একটি গোষ্ঠীকে আমরা দুরে রাখতে পারি, সেটা ইতিবাচক। এবং সেটা করতে আমাদের কিছুটা আপোষ করতে হয়। আমরা সেটা করেছি।’

    ‘আমরা মনে করি এর ভেতর দিয়ে আমাদের প্রতিপক্ষ জামায়াত যারা ধর্মীয় রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, তাদের কাছ থেকে যদি সমাজের আমরা একটি অংশকে দূরে রাখতে পারি, সেটা আমাদের উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের জন্য ভালো। তাদেরকে সাথে রাখা নয়, সঠিক শব্দ হবে 'নিউট্রালাইজ' (নিষ্ক্রিয়) রাখা, গায়ে পড়ে তাদেরকে না ক্ষেপানো।’

    মি. লেনিন বলেন, সেটাই আওয়ামী লীগের কৌশল। হেফাজতের মত এসব গোষ্ঠী আপাতত প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে না ঢুকলেও, ক্ষমতার বাইরে থেকে তারা যে রাজনীতিকে যে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে - তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

    ড. রিয়াজ মনে করেন, এই প্রবণতা সামনে দিন দিন বাড়বে। খবর: বিবিসি বাংলা।

    /অ-ভি

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close