• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

নিজেকে লেখক বলার ইচ্ছে বা সাহস আমার কোনদিন হয়নি!

প্রকাশ:  ০৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ০১:৫৩
মুন তাসলিমা শেখ

১১ বছর থেকে আমার ক্লাসের বই পড়া ফাঁকি দিয়ে বাইরের পড়া পড়ার আগ্রোহ থাকায় পরীক্ষায় ডাব্বা মারতাম। যেদিন রেজাল্ট বেরুতো আমার তিন ভাইবোন ফার্স্ট হওয়ার রেজাল্ট নিয়ে বাসায় আসতো। আমি জামার ভেতর পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে প্রচণ্ড রোদে ছাদে বসে থাকতাম মার মাইরের ভয়ে। এর সাক্ষী আমার বইন আমার ফেসবুকে আছে। মেট্রিকুলেশন পরীক্ষার আগের দিন পড়ন্ত বিকেলে একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ছাদে বসে আমি 'পথের দাবী' পড়ছিলাম। পরীক্ষার আগেরদিন গল্পের বই কেউ পড়তে পারে বলে আমার মা ক্ষুব্ধ রোষে চুপ মেরে গিয়েছিলেন। বুঝেছিলেন, পরীক্ষার আগে মারধোর করা তার পক্ষে সম্ভব না।

আসলে পড়া ছাড়া আমার কোন আনন্দ কোথাও ছিল না। বিদেশ আছি আমার বয়স যখন ২২ তখন থেকে। এখন আমার বয়স ৫২। বাংলা লেখা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। ইন্টারনেটে প্রথম বাংলা অক্ষর যেদিন দেখি হৃৎপিণ্ড লাফ দিয়ে উঠেছিল। এর আগে দেশ থেকে কেউ এলে আমার বোনরা আর বোনের হাসব্যান্ড কিছু ম্যাগাজিন পাঠাতো। কিন্তু তখন কেউ সেরকম ঘন ঘন আসতে পারতো না। জীবনযুদ্ধে এমনভাবে খাবি খেতাম দেশে যাওয়ার একটি টিকিট আমি পাঁচ বছরেও করতে পারিনি। সারাদিন বিশবদ্যালয়ের খাবি খাওয়া। রাতে ভাষা কোর্স করতাম দু’দিন। একদিন পরীক্ষার গার্ড দেওয়ার চাকরি করতাম। শনি-রবিবার একটি হাসপাতালে ক্লিনিং এর কাজ করতাম। রোগীর বমি টয়লেট এ হাতে পরিষ্কার করে ঘর ভাড়া বাজারের পয়সা যোগাড় করতাম। বাচ্চার জামা কিনতাম সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান থেকে। উইন্টারের বুট জুতা এসব এত দাম ছিল কেনার সাধ্য ছিল না। কিন্তু সোশ্যাল বেনিফিটে যাইনি। নিজের ইনকামে জীবন চালানোর যুদ্ধ করেছি। তবু মাস শেষে মান্থলি কার্ডটি কেনার পর হাতে থাকতো দু’একশ টাকা। সেসব দিন আমার অনেক গর্বের।

সম্পর্কিত খবর

    ডিগ্রী সমাপ্ত হলো ১৯৯৮ সালে। থিসিস কমপ্লিট হওয়ার সমসাময়িক সময়েই একটি চাকরি জুটেছিল ব্যাংকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান ব্যাংক নাম। চাকরি আর থিসিস একসাথে করে দেখলাম মান্থলি ইনকামের কাছে আমি পরাস্ত। অভাবের সময়ে ফেরত যেতে চাই না। পিএইচডিটা করা হলোনা আর। একের পর এক ফান্ড খোঁজার ধৈর্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবু এখনও সে দুঃখ কাটেনি। এখনও একটু সাধ হয় শুরু করি আবার।

    প্রথম লেখার শুরুটা এরকম। জীবন অভিজ্ঞতায় ন্যুজ। ৪০ বছর যুদ্ধের বিস্মৃতি বয়ে বেড়াতে পারছিলাম না জন্য তা লিখতে হলো। একটাই উদ্দেশ্য, যদি রাতের দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি ঘটে। চোখ বন্ধ করলেই আগুন, লাশ, ক্লান্ত বাবা ফিরে আসছে। এগুলোকে মুক্তি পেতে লিখলাম প্রথমে ''একাত্তরের চোখ'' পরে এডিটেড সংস্করণ ''আমি একটি বাজপাখিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম''।

    এগুলো আমার সেলফ থেরাপি। এরপর বই আসলো ''অর্থ এক দেবশিশুর নাম''। এটাও সেলফ থেরাপি। তিন বছরের আমার এ বাচ্চা অর্থর অটিজম ধরা পড়ে। প্যারেন্ট হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা মাত্র। এগুলোকে আমি বই না বলে জার্নাল বলি।

    আমার ফেসবুকে আমার কথা এক্সপ্রেস করার শুরু আসলে আমার এক্টিজম বিষয়ক। আমার ক্ষোভ ও যাতনা বিষয়ক! তার আগে কিছুদিন ব্লগ করেছিলাম মজা করার জন্য। নিজের রিফ্লেকশনগুলো মূলত আমি এক্সপ্রেস করি আমার দেওয়ালে। ২০১৩ সালের শাহবাগের সেইদিনগুলোতে প্রবাস থেকে মাতৃভুমির সাথে সংযোগ বৃদ্ধি পেলেও যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে আমার যুদ্ধ অনেক আগে থেকে। সুইডেন এবং ইউরোপে।

    আর নারীবাদ নিয়ে আমার লেখা পড়ার শুরু ১৯৯২ থেকে। আমি একটি সুইডিশ নারীবাদ স্টাডি সার্কলের সাথে জড়িত হই সে সালে। এখানকার নারীবাদী লেখকদের সাথেও। এসব বিষয় আমাকে আলোড়িত করে আগাগোড়া। আমি বুঝি, জীবনে এ বিষয়টির ভেতরটি অনুসন্ধান ছাড়া আমার অন্য সব কৃত কর্ম অর্থহীন। সেই থেকে এ বিষয়ের সাথে আমার বসবাস। আমি যা বিশ্বাস করি সেটাতে লিভ আপ করা আমার জন্য দরকারি। দুটো বাচ্চা একজন অটিস্টিক মানুষ করার পাশাপাশি নারী হিসেবে আমার প্রফেশন এবং আদর্শিক বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে আমি সম্পূর্ণ হতে পারিনি। আইন পড়লেও কাজ করি আজ পনেরো বছর সুইডিশ সোশ্যাল ইন্সিওরেন্স অথরিটিতে। দুধের সাধ ঘোলে মেটাতে কিছুটা সময় সুইডিশ ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে কাজ করি। আইনের সাথে কিছুটা ইনভ্লভ আছি এ শান্তনায় নিজেকে প্রবোধ দেই। আর এর মাঝেই ফেসবুক লিখে। কখনও লাঞ্চ আওয়ারে। কখনও ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে। কখনও ডেন্টিস্টের জন্য অপেক্ষা করার ফাঁকে। এর কিছুই কোয়ালিটি লেখা নয়।

    খুব সম্প্রতি Supriti Dhar এবং চৈতী আহমেদ আমার লেখা তাদের পোর্টালে ছাপাবে কিনা বলে বারবার আমার ইনবক্সে অনুমতি চেয়েছে। এসব আমার দেওয়ালে লেখা। আমি বারবার বলেছি, এগুলো কোয়ালিটি পাঠকের জন্য নয়। তবু তারা জোর করেছে। আমার দেওয়াল থেকে নিয়ে ছেপেছে। বদান্যতার জন্য দ্বিধা নিয়েই অনুমতি দিয়েছি। চৈতি জোর করে না, অনুমতি চায়। সুপ্রিতি দাবি খাটিয়ে কিছুটা জোর করে।

    আজ আমি বিনয়ের সাথে দুজনকেই অনুরোধ করবো, ত্রিশ বছর বিদেশ আছি। দেশের বিষয় বুঝতে পারেন এবং লিখতে পারেন যারা দেশে রয়েছেন তারা। আমার লেখাগুলো আমার দেওয়ালে থাকাতেই আমি বেশি স্বস্তি অনুভব করবো। আমার বই বের হলেও আমি বিজ্ঞাপন দিতে লজ্জা বোধ করেছি। ছাইপাশ লেখার লজ্জায় মরমে মরে থেকেছি। এখনও তাই। আমার এ ছাইপাঁশ আমার দেওয়ালে থাকতে দিও। আমার ফ্রেন্ডলিস্টও আশ্চর্যজনকভাবে ছোট। এক হাজারের মত। বিখ্যাত হবার মনোবাঞ্ছা কোনদিন নাই। আমি কোনদিন সেন্ট্রালে নিজেকে দেখতে স্বস্তি বোধ করি না। আমার নিভৃতি পছন্দ! আমি একজন সুখী সৌল! তোমাদের মঙ্গল কামনা করি। ধন্যবাদ।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close