• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘কাদের ভাই! আমরা বেঁচে আছি আপনার জন্য’

প্রকাশ:  ১৫ জুলাই ২০১৮, ১২:৫২
ফিদা হাসান রিসলু

অবধারিত সত্যের মত করে মৃত্যু আসে সব মানুষের জীবনে। মৃত্যুর এই হীমশীতল হাওয়া কাউকে-কাউকে দপ্ করে নিভে দেয়; কাউকে আবার নিভে দিতে-দিতে বাঁচিয়েও দেয়-অবিশ্বাস্য। ১৯৯০ এর রাকসু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনের আগের রাতে স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন- ইসলামী ছাত্র শিবিরের দায়েরকৃত মামলা মাথায় নিয়ে নিরবে-নিভৃতে প্রচার চালাচ্ছিলেন সেই নির্বাচনের প্রোভিপি প্রার্থী- কাদের সরকার। এরই এক পর্যায়ের-রাতে রাজশাহী নগরীর ডিসেন্ট মেস'এ অবস্হানকালে জানতে পারেন তিনি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আর ছাত্র শিবিরের দ্বিপক্ষীয় সংঘর্ষে রাজশাহী প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ে দু'জন শিবিরকর্মী আহত হয়েছেন। তারই রেশ ধরে মেসে-মেসে অবস্হান নেয়া-শিবির কর্মীদের মধ্যে তখন আক্রোশের উন্মত্ততা। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে চারতলার পরিচিত একজনের কক্ষে গিয়ে, তাঁকে-বাহির থেকে তালা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে-তাঁর আঁটকে পড়ার খবরটি জানিয়ে দিতে বললেন। ততোক্ষণে শিবির কর্মীরা জেনে গেছে যে; কাদের সরকার আছেন-এখানেই। চাকু-কিরিচ-হাঁসুয়ার মত মারাত্মক সব অস্ত্রপাতি নিয়ে তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে থাকলো-তাঁকে। তালা ভাংগার বিকট শব্দের অশ্লীল চিৎকারে তাঁরা তছনছ করতে থাকে রুমের পর রুম। ধেঁয়ে আসা মৃত্যুর মাঝে অসহায়-বন্দী এই ছাত্রনেতার চোখ-জুড়ে ভেসে উঠতে থাকে-গর্ভধারিনীর মায়াবী মুখ। আত্মিক আকুতির সেই ইথারিত ধ্বনি- মায়ের বুকের প্রতিধ্বনী হয়ে সৃষ্টিকর্তার রহমের বিবেচ্য হয়। তালা দিয়ে যাওয়া-রুমের ছেলেটির বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের মোটিভেশনে, প্রাচীর টপকানোর নিচেই প্রোভিপির ছড়ানো-ছিটানো লিফলেটে বিভ্রান্ত শিবির কর্মীদের হা-হুতাশের মাঝে- রাতের নিস্তব্ধ গভীরে আশপাশের রুমগুলিতে তালা-ভাংগার তীব্র শব্দে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে শুনতে পান তিনি; কেউ যেন বলছেন এমোনি- "শিকার পালিয়ে গেছে; টপকানো প্রাচীর পেরিয়ে"। অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়া হাতুরীর হুল্লোড়; ফিরিয়ে দেয়-তাঁকে জীবনের জয়রব। ঘাতকেরা চলে যায়; কাদের সরকার বেঁচে যায়-অভাবিত ভাবনায়।

দলীয় এই নেতার পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে গিয়ে ভয়ংকর সেই রাতটির কথা স্মরণে এনে কেন-জানি মনে হচ্ছে বার-বার; স্বপ্নভংগের বেদনায় ব্যথিত এই রাজনৈতিক ব্যক্তির- শেষ মৃত্যুর দশবছর আগের সেই মৃত্যুই বোধহয় শ্রেয় ছিল তাঁর। ভুলে যাওয়া সংস্কৃতির এই ভূলুন্ঠিত ভূবনে পেতে পারতেন অন্তত: ইতিহাসের আকার।

সম্পর্কিত খবর

    প্রায় অকাল প্রয়াতই বলা যায়- কাদের সরকার। আশির দশকে যিনি ছিলেন বিখ্যাত ছাত্রনেতা; নব্বই দশকেও হতে চেয়েছেন- গনমানুষের নেতা। অথচ আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে কোথাও কোন আলো নেই; আলোচনা নেই। যদিও আছে- তাঁর ছোঁয়ায় পুষ্পিত, তাঁর সান্নিধ্যে বিকশিত কিংবা তাঁরই অন্নে যাপিত অনেক-অসংখ্যের সদম্ভ পদচারনা। এ-যেন সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের কথারই যথার্থতা: "এ কেমন স্বাধীনতা পেলাম- জীবিতদের সন্মান করিনা; মৃতজনদের স্মরনে রাখিনা"।

    অথচ রাজনীতি যখন একজন মানুষকে শুধু অবগাহিতই করেনা; ডুবে থাকবার অভিজ্ঞানে স্পন্দিতও করে-কম্পিতও করে এবং সেই স্পন্দন আর কম্পন চেতনার স্তরে-স্তরে ধ্বনীত হয়ে প্রতিধ্বনীত হতে থাকে- বারংবার; তখন তার নাম হয় আব্দুল কাদের সরকার। ব্যক্তি-পরিবারের উর্দ্ধে উঠে পায়ের নোখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত মুজিবাদর্শীয় রাজনীতির অচ্ছেদ্য বন্ধনে বেষ্টিত ছিলেন তিনি। লোভ-লালসার বিপরীত প্রেষণে দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষকে কাছে টানবার, বিশেষত: তারুণ্য-যৌবনকে বুকে রাখবার ঐকান্তিক সন্মেহনী ক্ষমতা ছিল- তাঁর প্রসারিত ভিতরে। আশির দশকের শুরুতেই সরকারি আযিযুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পা-রাখবার প্রথমাতেই কাদেরভাইয়ের সংগে যখন আমার পরিচয়; তখনই তিনি সীমাবদ্ধ জলে অফুরন্ত সবুজ। জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৈশাচিক হত্যাকান্ডের পর তিনিই ছিলেন প্রথম ছাত্রনেতা, যিনি জাসদ ছাত্রলীগের প্রবল প্রতাপকে তছনছ করে দিয়ে কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। আশির দশকের পুরোটা জুড়েই বগুড়ার বিস্তৃত তারুণ্য আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় যৌবন জলতরংগে তিনি ছিলেন - অবধারিত রিদম। স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে মুখর এই কারানির্যাতিত ছাত্রনেতা তাঁর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বগুনে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রবল প্রতিরোধ-নিপীড়নের মুখেও রাকসুতে শুধু প্রোভিপিই নির্বাচিত হননি; সিনেটেও থেকেছেন- নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল সময়ের এই নিষ্ঠাবান ছাত্র সংগঠক জাতীয় ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহসভাপতি হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজসমূহে লড়াকু পদচিন্হ এঁকে দিয়ে স্বৈরাচারের পতনে রেখেছেন অবিস্মরনীয় ভূমিকা। মিটিং-মিছিল, অান্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের স্বর্নোজ্জ্বল সময়ের সহযোদ্ধা কিংবা সহকর্মীর জমাট-বুনোট অংগীকারে সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতির বিবিধ কন্টকাকীর্ন পথ পাড়ি দেয়ার চাক্ষুষ অভিজ্ঞানে বুঝতে পারি: সংগ্রাম-সংগঠনের ক্লান্তি-শ্রান্তির পরেও প্রতিদিনকার ডাইরীর পাতা-লিখে রাখা রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই সাবলিল বহতা- নব্বইয়ের পুরোটা জুড়েই ছিলেন; স্বপ্নভংগের বেদনায় কাতর এক তৃষ্ণার্ত চাতক। জোতদার পরিবারের সন্তান তিনি, কর্মী-সংগঠনের জন্য অর্থ-বিত্তের প্রায় সবটুকু বিলিয়ে দেয়ার পরেও নিজস্ব অবস্হান থেকে মেধা-মননের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নিজেকে উৎসর্গিত করতে না-পারবার দগ্ধতায় ছিলেন যন্ত্রণা-কম্পিত এক আলোক শিখা। রক্তের সমস্ত কনিকা-অনুচক্রিকায় চেপে বসা রাজনীতির নেভা-নেভা আলো তাই- বারবার জ্বালাতে গিয়ে অবশেষে কোন এক দমকা হাওয়ায়; একদিন ১৫ জুলাই-২০০০, শিখাটি চিরতরে নিভে গেল। আজ সেই নিভে যাওয়া আলোকশিখার ১৮ তম বার্ষিকীতে বলতে ইচ্ছা করে-খুব করে: কাদের ভাই! আপনি মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন; আমরা বেঁচে আছি- আপনার জন্য।

    (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

    কাদের সরকার
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close