• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মিস নেত্রকোণা, তোমার কথা মনে পড়ে...

প্রকাশ:  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১২:০১
হাসানুজ্জামান সাকী

সেপ্টেম্বর এলেই মিস নেত্রকোণার কথা মনে পড়ে আমার। ফেব্রুয়ারি এলেও...। আর মনে পড়ে যখন যেখানেই হতাশাগ্রস্ত কাউকে দেখি তখন।

জীবনে দুটি মৃত্যুর জন্য নিজেকে কিছুটা হলেও দোষী মনে হয়। এই জীবনে দুজন মানুষ আমার কাছে বাঁচার পথ খুঁজেছিল। আমি তাদের সেই পথ দেখাতে পারিনি। ব্যর্থ হয়েছিলাম। এ দু:খবোধ আমার জীবনে কোনোদিন দূর হবার নয়।

সম্পর্কিত খবর

    ছবির যে মেয়েটিকে দেখছেন তার সাথে আমার একটি অদ্ভূত রকমের সম্পর্ক ছিল। তার বাবার সাথেও। খুব ছোটবেলায় সোহরাব উদ্দিন আকন্দকে আমি দুটি নামে চিনতাম- এক. খায়রুল, দুই. আকাশ। তার পরিবারের সাথে আমার বাবা-মায়ের বন্ধুত্ব ছিল। সে হিসেবে তিনি সম্পর্কে আমার চাচা হন। ছোটবেলায় তাকে আঙ্কেল বলেই ডাকতাম। তার ছোট বোনকে এখনও আন্টিই সম্বোধন করি।

    তো খায়রুল আঙ্কেল এক সময় সোহরাব ভাই হয়ে উঠলেন। সন্তান যখন বড় হয়ে যায় তখন নাকি পিতার সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমার বাবাও তাই বলতেন। যা হোক, আমার ছোটবেলার আঙ্কেল বড়বেলায় ভাই হয়ে গেলেন। বন্ধু হয়ে গেলেন। সোহরাব উদ্দিন আকন্দের মতো উদার আধুনিক মানুষ আমি কমই দেখেছি। মানুষের বয়স তার কাছে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

    সেই সোহরাব ভাইয়ের বড় মেয়ে তৃষা। ভাল নাম আশরাফী আকন্দ। তৃষা আমার ছোট বোনের মতো হতে পারতো। কিন্তু তার বাবাকে ভাই ডাকার কারণে আমরা হয়ে উঠলাম চাচা-ভাতিজি। নেত্রকোণায়-ই শুধু নয়, তার মতো প্রিয়দর্শিনী আমি খুব কম দেখেছি। আমি মজা করে তাকে মিস নেত্রকোণা ডাকতাম। শান্ত ধীরস্থির নিটোল সৌন্দর্যের মেয়েটি সবার চোখের কোনায় স্থান করে নিয়েছিল।

    তৃষাকে মিস নেত্রকোণা ডাকি। কিন্তু তাকে তো ঘরকুনো হয়ে থাকলে চলবে না!! আমি মিডিয়ার মানুষ। আমার সব চিন্তা ভাবনাই যেন মিডিয়াকেন্দ্রিক। তাই তাকে আমি মিডিয়ায় ক্যারিয়ার গড়ার উৎসাহ দিতে থাকলাম। তৃষার বাবা-মাও হয়তো চাইতেন মেয়ে মিডিয়ায় ক্যারিয়ার গড়ুক। কিংবা হয়তো চাইতেন তাদের বড় সন্তান একমাত্র কন্যাটি অন্তত ঘরকুনো স্বভাব থেকে বের হয়ে আসুক। তাই আমার উৎসাহে তারা খুশি হয়েছিলেন।

    মনে আছে, আমি তখন দৈনিক সমকালে কাজ করি। শীতের পিঠা নিয়ে আমাদের ফিচার বিভাগ একটা পরিকল্পনা নিয়েছে। আমি তৃষাকে মডেল বানালাম। সে তেজগাঁও শিল্প এলাকার ভেতরের রাস্তায় বড় একটা গাছের নীচে বসে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে। আর পটাপট সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করছেন আলোকচিত্রী কাকলী প্রধান। মডেল হিসেবে তৃষার ছবি ছাপা হলো পত্রিকায়। সেই প্রথম এবং সেই শেষ। পরবর্তীতে আরও অনেকে তৃষাকে মডেল হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু তার আর মডেলিং করা হয়ে ওঠেনি।

    তৃষা একবার আমার সাথে বৈশাখী টেলিভিশনে এলো। মনে আছে, পুরো নিউজরুম তাকে দেখে একটু নড়ে চড়ে উঠল যেন। তাকে নিয়ে ঢুকলাম গ্রীনরুমে। সেখানে সুদর্শনা সংবাদ পাঠিকারাও প্রথম দর্শনে তাকে টেলিভিশনে চাকরির প্রস্তাব দিয়ে বসল।

    তৃষা ঢাকায় আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করছিল। হঠাৎ একদিন তৃষার বিয়ে হয়ে গেল। ভালোবেসেই বিয়ে করল সে। স্বামী চিকিৎসক। পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠল তৃষা। এরমধ্যে এক পুত্র সন্তানের জননী হলো। আমার সাথে কখনওই তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। বিয়ে-সন্তান হওয়ার পর সেই যোগাযোগে আরও ভাটা পড়ল। নতুন করে তার সাথে যোগাযোগ ঘটলো সে যখন ঢাকায় আমার পাশের একটি এপার্টমেন্টে উঠলো। সোহরাব ভাইয়ের স্ত্রী তৃষার মা আমাকে পছন্দ করতেন তাই ভাবীকে দেখতে মাঝে মাঝে তৃষার বাসায় যেতাম।

    ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। গণজাগরণ মঞ্চে উত্তাল রাজধানী ঢাকা। শাহবাগ। তৃষা বায়না ধরল সে শাহবাগে যাবে। কিন্তু কার সাথে যাবে সে? তৃষার স্বামী তখন পেশাগত কারণে কুমিল্লায়। একা বা কারও সাথে মেয়েকে শাহবাগে যেতে দিতে রাজী নন মা। তৃষার মা অর্থাৎ ভাবীর ভরসা একমাত্র আমি। তৃষাকে শাহবাগের আন্দোলনে নিয়ে গেলাম। শাহবাগে গিয়ে তৃষা পিজির (বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) বড় দালানটির উপরে উঠতে চাইলো। আমি র্যাব-পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তাকে নিয়ে বিল্ডিংয়ের ছাদে গেলাম। নীচে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনরত জনতার বিরল এক দৃশ্য আমরা দেখলাম পাখির চোখে।

    তৃষাকে দেখে গণজাগরণ মঞ্চও কি একটু নড়ে চড়ে উঠল নাকি? পত্রিকার আলোকচিত্রীদের ক্যামেরা যে তাকেই ফলো করছিল। এই ছবিগুলো সেদিন যিনি তুলেছিলেন তিনি রূপম চৌধুরী- বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত আলোকচিত্রী।

    আগেই বলেছি, ছোটবেলার সোহরাব আঙ্কেল বড়বেলায় ভাই হয়ে উঠেছিলেন। তৃষাও কী বোন-ভাতিজি সম্পর্কের জটিল রসায়নে না গিয়ে আমাকে বন্ধু ভাবা শুরু করেছিল? তা না হলে চির-চাপা স্বভাবের মেয়েটি নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা কেনই-বা বলতে চাইতো আমাকে? কেনই-বা আমার সাহায্য চেয়েছিল?

    তৃষার সাথে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আড্ডা দিয়েছি কয়েকবার। তার ইচ্ছায় আমরা দেখা করেছি দুইএকবার। সে আমার কাছে কিছু একটা বলতে চাইতো। কিন্তু শেষমেষ বলতো না। শেষ যে বার দেখা হয়েছিল ফুলার রোডে, ফুটপাতে বসে সে আমার কাছে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের নাম চেয়েছিল। বলেছিল, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা করতে চায় সে। কিন্তু কার সাথে দেখা করবে সে ধারণা তার নেই। আমার স্বভাব, আমি সব সময় দূরত্ব বজায় রেখে চলি। মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে কম কথা বলি। কেউ বলতে চাইলেও একটা দূরত্ব রেখে কথা বলি। সব কথা জানতে চাই না। তৃষার সমস্যা কিছু একটা হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু আমার স্বভাবগত কারণে তখন পাত্তা দেইনি বিষয়টা। এমনকি তার পরিবারকেও বলা হয়ে ওঠেনি। এর দুয়েক মাস পরই আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি।

    ওই বছরের সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে ঢাকার গ্রীনরোডে নিজ বাসায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে তৃষা- আমার মিস নেত্রকোণা।

    এই দু:খবোধ আমার কিভাবে কাটবে, জানি না। তাকে কেন বুঝতে চাইলাম না। তার পাশে কেন দাঁড়ালাম না। কেন তখন বিষয়টা সিরিয়াসলি নিলাম না। এই দায় কিভাবে এড়াবো আমি?

    তৃষা, তোমাকে অবহেলা করার জন্য আমাকে ক্ষমা করো। সোহরাব ভাই ও ভাবী, আমাকে ক্ষমা করবেন। তৃষার সন্তানের কাছেও আমি ক্ষমা চাই।

    পুনশ্চ: কিছুদিন আগে অভিনয়শিল্পী সোহানা সাবা হতাশাগ্রস্তদের নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। সেখানে হতাশা কাটাবার মন্ত্র ছিল। তখনই ঠিক করেছিলাম একটা লেখা লিখবো। আর হ্যাঁ, যারা পুরো লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন তাদের মনে হয়তো আরও একটি প্রশ্ন উকিঁ দিতে পারে- দুজন মানুষের মৃত্যুর জন্য আমি কিছুটা হলেও নিজেকে দোষী মনে করেছি, তাহলে আরেকজন কে? সেই প্রসঙ্গটা আরেকদিনের জন্য তোলা থাক।

    হাসানুজ্জামান সাকী নিউ ইয়র্ক

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close