• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

রাজনীতি করার জন্য স্বনির্ভর হওয়া জরুরি

প্রকাশ:  ১০ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:২৭ | আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৮, ০৯:২৯
ডাঃ দীপু মনি

আমার যখন চার/পাঁচ বছর বয়স তখন ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান চলছে। আমার বাবা ছিলেন রাজনীতিবিদ। আমাদের বাড়ির পরিবেশও তাই সেরকম ছিল। সারাক্ষণ বাড়িতে পাড়ার ছেলেরা পোস্টার লিখছে, ফেস্টুন বানাচ্ছে, নেতারা আসা যাওয়া করছেন, পুরোই হুলস্থূল কান্ড। ছোট ছিলাম, লোকে জিজ্ঞেস করত, বড় হয়ে কি হবে? আমি বলতাম, আমি পলিটিক্স করব। আমার মনে পড়েনা আমি কখনো অন্য কিছু হতে চেয়েছি।

আমি যেহেতু রাজনীতিই করব বলে ঠিক করেছিলাম, ইন্টারমিডিয়েট শেষ করার পর ভাবলাম বাংলা অথবা ইংরেজি সাহিত্য, নয়তো পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ব। কিন্তু মা মানলেন না, বললেন, প্রফেশনাল হতে হবে, ডাক্তার নয়ত ইঞ্জিনিয়ার। বাবা বললেন, ‘জীবন তোমার, সিদ্ধান্তও তোমার হওয়া উচিত। তবে যেহেতু তুমি পলিটিক্স করবে বলেই ঠিক করেছ, যদি তুমি ডাক্তার হও তাহলে তুমি কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে তা করতে পারবে। রাজনীতি করার জন্য স্বনির্ভর হওয়া খুব জরুরী। ডাক্তারিতে মানুষের যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায় তা অন্য পেশায় সম্ভব না। আর যদি ডিএমসিতে ভর্তি হতে পার, তাহলে খুব ভাল হয়, এখানে যেমন রাজনৈতিক পরিবেশ আছে, কালচারাল পরিবেশও অনেক সমৃদ্ধ।’ আমি তাই শুধু মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং ঢাকা মেডিকেলেই চান্স পেলাম।

তখন মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় বেশ ভালোভাবে ভাইভা হত। ভাইভা বোর্ডে বিশ মার্ক্স ছিল। আমি ভাইভা দিতে গেলাম। প্রফেসর যিনি ছিলেন তিনি ভ্রু কুচকে আমার কাগজপত্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাম কি?’ আমি বললাম, দীপু মনি। উনি বললেন, ‘কি?!’ আমাকে আবার নাম বলতে হল। তারপর আমার বাবা মায়ের নাম জিজ্ঞেস করলেন, বললেন, ‘তোমার বাবা মা তো মুসলিম, তাহলে তোমার নাম এ রকম কেন? হিন্দু নাম কেন?’ আমি বললাম, ‘এইটা হিন্দু নাম না, বাংলা নাম।’ আমার উত্তর হয়ত তাঁদের পছন্দ হয়নি, আমাকে আর তেমন কিছু জিজ্ঞেস না করেই ওই বোর্ডে সবচেয়ে কম মার্ক্স দেয়া হয়েছিল। এভাবে গোড়া থেকেই আমাকে নামের জন্য ভুগতে হয়েছে, সেই থেকে একটু হলেও বুঝতে পারি, যে কোন দেশের সংখ্যালঘুদের এমন কতরকম ধাক্কা খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

আমাদের অরিয়েন্টেশন ছিল ৬ এপ্রিল। তখন ছিল এরশাদের আমল, মার্শাল ল চলছে। অরিয়েন্টেশনে আমি বাবাকে নিয়ে গেলাম। বাবা তখন অসুস্থ, জিয়াউর রাহমানের আমলে বেশ কয়েকবার জেলে নেয়া হয়েছিল, সেই ক্লান্তি বাবাকে ভর করেছিল। তাও বাবা আমার সাথে আসলেন। প্রিন্সিপালসহ সিনিয়র প্রফেসর সবাই বাবাকে ঘিরে ধরেছিলেন, কুশল জিজ্ঞেস করেছিলেন মনে পড়ে। তাঁর মেয়ে ভর্তি হয়েছে শুনে সবাই বেশ অবাক হয়েছিলেন। নতুন ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বাবাকে বক্তৃতা দিতে বললেন সবাই। আমার অত্যন্ত সুবক্তা বাবা বক্তৃতা দিলেন, ‘তোমরা সবাই ঢাকা মেডিকেলে পড়ছ, ডাক্তার হবে, সেই সঙ্গে সমাজ নিয়ে সচেতন হতে হবে, রাজনীতি নিয়ে সচেতন হতে হবে। এই মিলিটারির বুটের তলায় আমাদের চাপা পড়ে থাকলে চলবে না।’ খুব স্বাভাবিকভাবেই বাবার কারণে প্রথমদিন থেকে সবাই আমাকে চিনে গেল আওয়ামীলীগার হিসেবে। ছাত্র ইউনিয়ন অবশ্য খুব চেষ্টা করল, আমাকে দলে নেয়ার জন্য। বলল, তুমি ভাল ছাত্রী, তাই ছাত্র ইউনিয়ন কর। আমি বললাম, আমার বাবাও ভাল ছাত্র ছিলেন, ছাত্রলীগ করেছেন, কোন অসুবিধা হয়নি। আমারও অসুবিধা হবেনা। সেদিন দুটো অর্গানাইজেশনের মেম্বার হয়েছিলাম, একটা ছাত্রলীগ, আরেকটা সন্ধানী। পরবর্তিতে সন্ধানীর সেক্রেটারি হয়ে গেলাম। সন্ধানীর পদ পেলে পার্টির কোন পদে থাকা যায় না, সেজন্য ছাত্রলীগের কর্মীই থাকলাম।

অনেক মজার সব স্মৃতি জমা হয়ে আছে ঢাকা মেডিকেলের ক্যাম্পাসে। মনে পড়ে, মিছিলে তখন মেয়েরা বের হত না। আমি খুব চেষ্টা করতাম ওদের মিছিলে আনার। মেয়েদের কমন রুমের একপাশ দিয়ে ওদের বের করতাম, অন্যপাশ দিয়ে ওরা আবার কমনরুমে ঢুকে যেত। তখন সন্ধানীর পরের রুমটা ছিল মেয়েদের কমন রুম, তার পরেই ছিল ক্যান্টিন। সেখানে কোন মেয়ে ঢুকত না। ক্যান্টিনের পিচ্চি পিচ্চি ছেলে ছিল, ওরা মেয়েদের কমন রুমে ঢুকে অর্ডার নিয়ে যেত। আমি বললাম, ‘ক্যান্টিন কি শুধু ছেলেদের?’ ওরা বলল, ‘না। তবে মেয়েরা কেউ ঢুকে না।’ আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি, কেন মেয়েরা যায় না জানতে দুই তিন জন বান্ধবী নিয়ে ক্যান্টিনে ঢুকলাম। দেখি বড় একটা রুম, পর্দা টানা। একটা বাতি টিমটিম করে জ্বলছে, সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার ভাব। এক পাশে কয়েকজন চাবি বাজিয়ে গান করছে। আমরা ঢুকতেই কথা বন্ধ হয়ে গেল, গান থেমে গেল। সব উপেক্ষা করে আমরা একটা টেবিলে বসে বললাম, ‘এই চা দাও তো।’ বের হওয়ার সময় ক্যান্টিনের পিচ্চিগুলোকে বলে গেলাম, ‘এখানে পর্দা সরাবে, আলো ঢুকবে। আমরা রোজ আসব।’ সেই থেকে আমরাও ক্যান্টিনে যাওয়া শুরু করলাম।

আমি ফার্স্ট ইয়ারে তখন। ১৫ আগস্ট সন্ধানী থেকে আয়োজন করা রক্তদান কর্মসূচির কথা খুব মনে পড়ে। শেখ হাসিনা আপা এসেছিলেন। তিনি বললেন, আমার রক্ত দিপু নেবে। আপার রক্ত নেয়ার সময় বেশ নার্ভাস লাগছিল, আপাকে বলেছিলাম, আপা সুঁই ভিতরে রয়ে গেলেও কিন্তু ব্যাথা পাচ্ছেন সেটা কাউকে বুঝতে দেবেন না। আপা হেসে বলেছিলেন, আচ্ছা বুঝতে দেবো না।

তরুণ পলিটিশিয়ানদের জন্য বলব, রাজনীতিতে কি করছি, কেন করছি, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা খুব জরুরী। অনেকেই রাজনীতিতে আসে, বন্ধুবান্ধব করছে, তাই আমিও করছি অথবা হোস্টেলে ভাল সিট পেতে হবে, তাই করছি। আওয়ামীলীগ মানে কি, গোড়া থেকে কোন চিন্তা নিয়ে দলটা হয়েছে, দলের কোন মুহূর্তে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হল, কেন নেয়া হল, সে সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। দলের প্রতি সত্যিকারের কমিটমেন্ট থেকে যদি কেউ পলিটিক্স করে, কেবল তখনই কিন্তু ভাল কিছু করার সুযোগ থাকে। ডাক্তারদের যেমন টেকনিকাল নলেজের পাশাপাশি রোগীর জন্য সহমর্মিতা থাকা দরকার, রাজনীতিও ভিন্ন না। রাজনীতিতে নলেজের পাশাপাশি, মানুষকে বুঝতে পারা, সেই সাথে সেন্স অফ হিস্ট্রি থাকাটা খুব দরকার। আজকাল দেখা যায় নগদে পাওয়ার বিষয়টা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু রাজনীতি মানেই দেশের সেবা, মানুষের সেবা। ওই অর্থে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। সেটা করতে গেলে হয় স্বাধীনভাবে রোজগারের ব্যাবস্থা থাকতে হবে, অথবা সাধারণ জীবন মেনে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কিছু করে খাওয়ার দক্ষতা নেই, আবার সাধারণ জীবনটাও মেনে নিতে পারছে না, তখনই নিজের রাজনৈতিক পরিচয় বিক্রি করে খাবে। তবে খারাপের সংখ্যাটা কিন্তু বেশি না, এখন প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষ পলিটিক্সের সাথে জড়িত, অনেকেই দেশের জন্য কষ্ট করছে। আগাছা সব জায়গায় আছে, তার জন্য গোড়া থেকে গাছটা কেটে ফেলব তা তো নয়। কেউ ষড়যন্ত্র করলে আমরা বলে ফেলি, ‘আমার সাথে পলিটিক্স করবে না।’ রাজনীতি এবং ষড়যন্ত্রকে আমরা সমার্থক শব্দ বানিয়ে ফেলেছি। এভাবে জেনে হোক বা না জেনে হোক রাজনীতির মানুষগুলোকে ছোট করছি, খারাপ রাজনীতির সুযোগ করে দিচ্ছি। এই মানসিকতা যদি পরিবর্তন করতে না পারি, তাহলে রাজনীতিতে যে শুদ্ধাচার আমরা আশা করি তা পাওয়া সম্ভব হবে না।

(সরফুল তাজের ফেসবুক স্ট্যাটাস)

ডাঃ দীপু মনি,রাজনীতি
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close