ডিমলায় অন্তঃসত্ত্বাকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের ঘটনায় আটক ৩

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০১৭, ২০:১৮

নীলফামারী প্রতিনিধি

অনলাইন নিউজ পোটাল পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজে অন্তঃসত্বাকে গাছে বেঁধে নির্যাতন করলো আ.লীগ নেতারা শিরোনামে প্রকাশিত হলে প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। সকাল থেকে নীলফামারীর ডিমলায় বাইশপুকুর গ্রামে পুলিশ ঘটনাটি দফায় দফায় তদন্ত করেন। এ সময় ঘটনার বিষয়ে জিজ্ঞাববাদের জন্য ৩জনকে আটক করা হয়েছে।

আটককৃতরা হলেন, শেফালী বেগমের ভগ্নিপতি রফিকুল ইসলাম (৩৫) রফিকুলের মাতা অপেয়া বেগম (৫২) ও গ্রাম্য পুলিশ সদার রশিদুল ইসলাম।

নীলফামারীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার (ডোমার সার্কেল) জিয়াউর রহমান, ডিমলা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, ওসি তদন্ত মফিজ উদ্দিন শেখ সকাল ১০টায় ঘটনাটি প্রথমে তদন্তে যান ডিমলা থানার ওসি (তদন্ত) মফিজ উদ্দিন শেখ। এ সময় ইউনিয়ন শ্রমিকলীগের সম্পাদক শিমুল ইসলাম উপস্থিত লোকজনকে হুমকি প্রদান করেন। এলাকাবাসী দ্রুত ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেন। দুপুরে ঘটনাটি তদন্ত যান অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম।

নীলফামারীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, প্রকাশিত সংবাদে ৭মাসের অন্তঃসত্বা গৃহবধুকে নির্যাতনের ঘটনা প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৩জনকে আটক করা হয়েছে। মামলা চলমান প্রক্রিয়া রয়েছে। তিনি বলেন, নির্যাতিতা শেফালীর বিরুদ্ধে গরু চুরির ঘটনাটি সাজানো মনে হচ্ছে। ২ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে দিনদুপুরে গরু চুরির ঘটনাটি পরিকল্পিত।

এ ব্যাপারে ডিমলা থানার ওসি (তদন্ত) মফিজ উদ্দিন শেখ বলেন, ঘটনার তদন্তে সময় শ্রমিক লীগ নেতা শিমুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। যে তো ভাল ছেলে কাউকে হুমকি দিতে তো শুনিনি। ডিমলা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ঘটনাটি যা সাংবাদিকরা লেখেছে তা সত্য নয় একটি পারিবারিক ঘটনা। গরু চুরিকে কেন্দ্র করে নির্যাতনের ঘটনাটি ঘটতে পারে।

শুক্রবার শেফালী বেগম (৩২) নামের এক গৃহবধুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে শারিরিক নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের বাইশপুকুর কোলন ঝাড় গ্রামে। ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে প্রভাবশালী নেতারা দিনদুপুরে শেফালী বেগম গরু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে মর্মে গরুসহ গাছে বেধে পুলিশকে সংবাদ দেয়। নির্যাতনকারীদের হুমকীর কারনে ওই গৃহবধু ডিমলা উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়ে শনিবার সকালে নীলফামারী জেলার বাহিরের এক হাসপাতালে গোপনে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

শেফালীর ভাই রমজান বলেন, আমার বোনকে দিনভর যারা নির্যাতন করেছে আমি এর বিচার চাই। কিন্তু আমার বোনকে প্রকাশ্যে নিলে একদিকে পুলিশের মামলার ভয় ও অন্যদিকে একটি প্রভাবশালী মহল হুমকি কারণে আত্মগোপনে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কারণ নির্যাতনকারীরা তার অবস্থান জানান জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধু শেফালী বেগম (৩২) উক্ত গ্রামের লালন মিয়ার স্ত্রী ও একই গ্রামের মৃত মবিয়ার রহমানের মেয়ে। এ সময় জীবন রক্ষাতে শেফালী বেগম খালিশা চাপানি ৪নং ওয়ার্ডের আ.লীগ সভাপতি আব্দুল কাদের বাম হাতে কামর দেয়। এতে ক্ষিত হয়ে উক্ত নেতার নির্দেশে গ্রাম পুলিশের রশিদুল ইসলাম তাকে গাছের সাথে বেধে রাখে বলে শেফালী বেগম অভিযোগ করেন।

জমি-জমা সংক্রান্ত এক বিবাদে শেফালীর বাবা মবিয়ার রহমানকে ২০১২ সালের ২৯ জুলাই ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে প্রতিপক্ষরা হত্যা করেছিল। মামলায় এলাকার ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে পুলিশ চার্জশীট প্রদান করেন। মামলাটি বর্তমানে নীলফামারী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী ২২ আগষ্ট হত্যার মামলা সাক্ষ্য রয়েছে। প্রভাবশালীরা ওই মামলা মিমাংসার জন্য চাপ দিয়ে আসছে। তারা পিতার হত্যা মামলা আপোষ না করায় সম্প্রতি আরেকটি মিথ্যা মামলা করেছে প্রতিপক্ষরা। ফলে শেফালীর একমাত্র ভাই রমজান পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এলাকায় কোন ঘটনা ঘটলেই শেফালী ও তার ভাইয়ের উপর নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে।

এলাকাবাসী জানায়, শেফালী বেগমের দুই ছেলে মেয়ে ও তিনি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শেফালীর স্বামী রিক্সা চালাতে ঢাকায় অবস্থান করছে। ঘটনার দিন শুক্রবার (৪ আগষ্ট) সকাল ১০টার দিকে একই গ্রামে বসবাসকারী তার বড় বোন আকলিমা (৩৫) সঙ্গে তার স্বামী রফিকুল ইসলামের মধ্যে বচসা শুরু হয়। ওই বচসা থামাতে যায় শেফালী বেগম। এ নিয়ে ধাক্কাধাক্কি হলে শেফালীর বড় বোনের স্বামী সামান্য আহত হয়। আর এ ঘটনাকে পূঁজি করে হত্যা মামলায় জামিনে থাকা আসামীরা গ্রাম্য মাতব্বরদের সহযোগীতায় শেফালীকে গরু চুরির মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে একটি গাছে বেধে ফেলে।

অভিযোগ মতে, খালিশাচাপানী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল কাদের, ইউনিয়নের শ্রমিক লীগের সেক্রেটারী শিমুল ইসলাম, ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিদার রহমান, সদ্য বিএনপি হতে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী ইউনিয়নের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম, সামছুলের ছেলে মজনুর রহমান মঞ্জু ও এলাকার দেবারু, দবিরুল নির্যাতন শুরু করে। শেফালীর শরীরে মারপিটের সময় ওই গৃহবধু নির্যাতনকারীদের বেশ কয়েকজনের হাতে কামড় দেয়। এতে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা গরু ও মাদকসহ শেফালীকে ধরিয়ে দিতে ডিমলা থানা পুলিশকে খবর দেয়। এ জন্য শেফালীর বড় বোনের স্বামী রফিকুল ইসলামকে দিয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করায়। ইউনিয়নের গ্রাম পুলিশ সর্দার ও চার নম্বর ওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ রশিদুল সর্দার বলেন ঘটনার দিন দুপুর ১২টা দিকে গৃহবধু শেফালীকে গাছে বেধে নির্যাতনের ঘটনা দেখতে পেয়ে ডিমলা থানায় অবগত করি এবং শেফালীর বাঁধন খুলি দেই। তিনি নিজে বেধে রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।

বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ডিমলা থানার এসআই ফিরোজ, দুইজন নারী পুলিশসহ বেশ কিছু পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে আসে। তারা পুলিশ প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে মাটিতে পড়ে থাকা শেফালীকে উঠিয়ে তাকে হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে ফিরে যায়।

এদিকে গোপনে চিকিৎসাধীনে থাকা গৃহবধু শেফালীর সঙ্গে কথা হয় সাংবাদিকদের। শেফালী জানায়, পুলিশ চলে যাওয়ার পর তার পরিবারের লোকজন তাকে ডিমলা হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করার জন্য নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। এ সময় ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক তানজিদার রহমান এসে হুমকী দেয় শেফালীকে হাসপাতালে ভর্তি করলে ফেন্সিডিল দিয়ে তাকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়া হবে। এই ভয়ে ডিমলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। রাতে স্থানীয় একজন চিকিৎসক এসে তাকে স্যালাইন পুশ করে চলে যায়। শনিবার ভোরে গ্রাম হতে বেরিয়ে জেলার বাহিরের একটি হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছি। 

শেফালীকে নির্যাতনের ব্যাপারে ঘটনাস্থলে উপস্থিত গ্রাম্য মাতব্বর ও আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলা হয়। ইউনিয়নের শ্রমিকলীগের সাধারন সম্পাদক শিমুল ইসলাম বলেন, কারা কেন ওই গৃহবধুকে গাছে বেধে নির্যাতন করেছে আমাদের জানা নাই। পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম আমি। এ ছাড়া আর কিছুই জানি না।

খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের আওয়ামীলীগের সভাপতি সোহরাব হোসেন বলেন, শেফালী বেগম নামের এক গৃহবধুকে গাছে বেধে কে বা কারা নির্যাতন করেছে বলে শুনেছি। তবে এ ঘটনার সঙ্গে কোন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী জড়িত নই। ঘটনাটি নিয়ে কিছু মানুষ আওয়ামীলীগের নেতাদের উপর মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে।

খালিশাচাঁপানী ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তানজিদার রহমান তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঘটনাস্থলে বিকালে গিয়েছিলাম পুলিশের সঙ্গে। শুনেছি ওই মহিলা নাকী ভাল নয়। ডিমলা থানার এসআই ফিরোজ জানান, দিন দুপুরে গরু চুরির ঘটনাটি তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায়নি।

ডিমলা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ওই মহিলার নামে গরু চুরি ও মানুষজনের হাতে কামড় দেয়ার অভিযোগ এসেছিল। কিন্তু ঘটনাটি তেমন কিছু নয়। এ বিষয়ে থানায় কোন মামলা হয়নি। ঘটনার দিন গাছে বেঁধে নির্যাতনের বিষয়টি আমার জানা নেই।