• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

অপ্রতিরোধ্য কুষ্টিয়ার নোট ও গাইড ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ:  ১৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:৫৪
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

এবারো বাদ যায়নি কুষ্টিয়ায় নিষিদ্ধ নোট-গাইড বইয়ের অবাধ বাণিজ্য। এসব বইয়ের বাণিজ্যের সঙ্গে এক শ্রেণির শিক্ষকদের সহায়তায় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। আর সিন্ডিকেটের কারণেই বন্ধ করা যাচ্ছে না অসাধু এই ব্যবসা। ফলে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটটি প্রতিবছরই হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

কুষ্টিয়াতে এইসব নিষিদ্ধ গাইড বই বিক্রয় করার জন্য করা হয়েছে একটি কমিটি। এই কমিটির মাধ্যমেই সিন্ডিকেট করে বিক্রয় করছে নিষিদ্ধ গাইড বই। সাংবাদিকদের তৎপরতায় গত শনিবার বিকেলে শহরের ছয়রাস্তার মোড়ে অবস্থিত রয়েল কুরিয়ার সার্ভিস থেকে বিপুল পরিমান নোট ও গাইড বই জব্দ করেছে পুলিশ।

এরপর থেকে আরো ফুঁসে উঠেছে পুস্তক বিক্রেতারা। এদিকে বিক্রয় নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই জব্দ করলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না পুলিশ। এমনকি গতকাল রোববার মাসিক জেলা আইনশৃঙ্খলা সভায় নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই বিক্রয়ের অভিযোগ তুললেও তাতে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।

সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া শহরে শতাধিক বইয়ের দোকান রয়েছে। তার মধ্যে শহরের ইসলামিয়া কলেজের মার্কেটের বাজারগুলোতে নোট ও গাইড বিক্রির দোকান বেশি। প্রশাসন এসব বাজারে নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বইয়ের ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে অবৈধ ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে। জানা গেছে, ১৯৮০ সালে একটি আইনে এসব বই ছাপা ও বাজারজাত করা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এ আইন কার্যকর হচ্ছে না। সারাদেশেই অনেকটা প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে নোট-গাইড বই। শিক্ষার্থীরা বলছে, স্কুল থেকেই এসব বই কিনতে অনেক সময় শিক্ষকরা উদ্বুদ্ধ করেন। শিক্ষকরা ক্লাসে এসে বুকলিস্ট দিয়ে দেন। ওই লিস্ট অনুযায়ী নোট, গাইড, গ্রামার ও ব্যাকরণ বই কিনতে বলা হয়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই কিনতে হয় নির্দিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের এসব সহায়ক বই।

অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী ছেলে-মেয়েদের ভালো ফলের আশায় বুকলিস্ট অনুযায়ী বই কিনতে হচ্ছে। এসব নোট বা গাইড বই কেনার সময় ভাবারও অবকাশ থাকে না নিষিদ্ধ কিনা। মূলত এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থেকেই এসব বই কেনা হচ্ছে। আর কুষ্টিয়ার বাজারে সব থেকে বেশি বিক্রয় হচ্ছে পাঞ্জেরী, লেকচার, পপি, অনুপম ও ফলকড়ি প্রকাশনার নোট বই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ মার্কেটের পুথিঘর,পপি, জ্ঞানকোষ, সাহিত্যকোষ,বই নিকেতন, বই নীড় সহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে এক প্রকার প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই। সরকার থেকে বিক্রয় নিষিদ্ধ থাকলেও কুষ্টিয়ার স্কুলগুলোতে ৫ম শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত নোট কিংবা গাইড বই এক প্রকার বাধ্যতামূলক করেছে শিক্ষকরা। এসব লাইব্রেরিতে গ্যালাক্সি, লেকচার, অনুপম, জননী, জুপিটার, আদিল, দিগন্ত, ক্যামব্রিয়ান, গ্লোবাল, ক্লাস ফ্রেন্ড, অ্যাপোলো, সংসদ, ক্যাপ্টেন, সুপার, ছাত্রকণ্ঠসহ অন্তত ৫০টি পাবলিকেশন্সের বই বিক্রি হচ্ছে।

প্রতিযোগিতার এই বাজারে বেশি ব্যবসা করার জন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের ম্যানেজ করছে কমিশন দিয়ে নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই এর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে এসব বই কিনতে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের বাধ্যও করা হয়। ইসলামিয়া কলেজ মার্কেট জেলার প্রধান পুস্তক বিক্রয় বাজার। এখান থেকে বিভিন্ন উপজেলার স্কুলে যানবহনের মাধ্যমে পৌছে দেয়া নোট ও গাইড বই। আরো জানা গেছে, কোম্পানি থেকে বই আনা নেয়ার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে কুষ্টিয়ার কুরিয়ার সার্ভিসগুলো।

ইসলামীয়া কলেজের বই ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফ পারভেজ বলেন, আমরা জানি নোট ও গাইড বই সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। পুথিঘর ও পপি লাইব্রেরী থেকে বই কমিশনে কিনে বিক্রয় করছি। আমাদের ধরে লাভ কি? পুস্তক প্রকাশক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সব জানে। তাদের বাইরে কিছুই হয় না।

এ ব্যাপারে পুথিঘর বইয়ের মালিক হিমেল বলেন, আমাদের কাছে কোন নোট বা গাইড বই নেই। বিক্রয়ও করি না।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইসলামীয়া কলেজের দুইতলা মার্কেটের বারান্দায় প্লাষ্টিকের বস্তায় সারি সারি সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন লাইব্রেরীর নামে নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই। খোদ তার কাছ থেকে কমিশনে নোট বই কিনে বিক্রয় করা এক দোকান মালিক বললেন ০১১৮৯-৩ কোড দেখলেই বুঝবেন সেগুলো পুথিঘরের বই। আমরা স্থানীয়ভাবে পুথিঘর ও পপি লাইব্রেরী থেকে বই কিনে বিক্রয় করি।

এদিকে সাংবাদিক তৎপরতায় শনিবার দুপুরেই গোডাউন থেকে নোট ও গাইড বই সরিয়ে ফেলে দোকান মালিকরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক পুস্তক বিক্রেতা বলেন, কুষ্টিয়ার প্রতিটি বই এর দোকানে গাইড বইয়ের বাণিজ্য চলছে অবাধে। আর এসব বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি স্থানীয় স্কুলগুলোর অসাধু কিছু শিক্ষক। তারা লাইব্রেরির সাথে যোগাযোগ রেখে কমিশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বই কিনতে বাধ্য করছে।

এদিকে পপি লাইব্রেরীর মালিক জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে জানান, বই আমি একা বিক্রি করি না। এখানে সব সিদ্ধান্ত হয় পুস্তক সমিতির মাধ্যমে। তাই কিছু করার নেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক সমিতি কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি রহমত আলী বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমরা যেটা বিক্রয় করছি সেটা সহায়ক বই। নিষিদ্ধ কোন গাইড নয়।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার ছিল জেলা আইনশৃঙ্খলার মাসিক সভা। সভায় কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি গোলাম মহসিন কুষ্টিয়ায় নিষিদ্ধ নোট ও গাইড বই বিক্রয়ের অভিযোগ তোলেন। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, মাসিক সভায় আমি নোট ও গাইড বই বিক্রয়ের অভিযোগ তুলেছি। তাৎক্ষণিক কোন মন্তব্য পাইনি। হয়তবা এ ব্যাপারে কর্তাব্যক্তিরা পদক্ষেপ নেবেন।

আগামী সভায় বোঝা যাবে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা। অন্যদিকে শনিবার বিকেলে শহরের ছয়রাস্তার মোড়ে অবস্থিত রয়েল কুরিয়ার সার্ভিস থেকে বিপুল পরিমান নোট ও গাইড বই জব্দ করে পুলিশ। তবে গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত জব্দকৃত বইয়ের মালিকের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি পুলিশ।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন জানান, হাইকোর্টে পুস্তক প্রকাশনা সমিতির নেতৃবৃন্দ রিট করেছে। তারা স্থগিত আদেশের কপি আনতে ঢাকায় গিয়েছে। স্থগিত আদেশ আনলে জব্দকৃত বই ছেড়ে দিতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শিক্ষক জানান, বছরের শুরুতেই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে নানাভাবে প্রস্তাব দেয়। কখনো বিভিন্ন উপহার দিয়ে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বই কিনতে শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিতে বলা হয়। কখনো কখনো ঘুষ দেয়া হয় নগদ টাকা। টাকার পরিমাণ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ভেদে ২০ হাজার থেকে লাখও ছাড়িয়ে যায়।

এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়কে আসবাবপত্র দিয়ে থাকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান।

কয়েকজন অভিভাবক বলেন, আমাদের এলাকার বই বিতানগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির নোট, গাইড বই বিক্রি হচ্ছে। শ্রেণীভেদে দামের ভিন্নতা রয়েছে। তারা বলেন, শ্রেণিতে যে সিলেবাস আছে, তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্বল্প শিক্ষকদের দিয়ে বুঝিয়ে পড়াশোনা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ কারণে সহায়ক হিসেবে অভিভাবকেরা নোট ও গাইড কেনেন।

এ ব্যাপারে পপি ও পাঞ্জেরী প্রকাশনীর আঞ্চলিক বিপণন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।

কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা জায়েদুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা পেলে নোট ও গাইড বই বিক্রয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পিবিডি/পি.এস

কুষ্টিয়া,অপ্রতিরোধ্য,ব্যবসায়ী

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close