কর্মক্ষেত্রে সন্তানসহ নারী পুলিশ, ভাইরাল ছবি
ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাইয়ের শহরের মেয়ে অর্চনা। তিনি অবশ্য লক্ষ্মীবাইয়ের মতো সুপরিচিত কেউ নন। ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের এক সাধারণ পুলিশ কনস্টেবল।
কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবি তাকে হঠাৎ বিখ্যাত করে দিয়েছে। আর এর ফলে গত তিনমাস ধরে তিনি যে কাজের জন্য পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে অনেক আবেদন-নিবেদন করেছেন, সেটাই মুহূর্তে সম্ভব হয়ে গেছে।
সম্পর্কিত খবর
উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌতে অনেক অফিসারকে অনুরোধ করেছিলেন অর্চনা, যাতে তাকে বদলি করে দেওয়া হয় আগ্রা শহরে। কিন্তু যেটাকে প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল তার, সেই বদলির অর্ডারটাই এক ঝটকায় করে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া একটি ছবি।
রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক স্বয়ং ফোন করেছিলেন ওই নারী কনস্টেবলকে- জানিয়েছেন তার বদলির অর্ডার।
ঘটনাটা এরকম:
ঘটনাটি ২৬ অক্টোবরের। ছয়মাসের কন্যাশিশুকে নিয়েই থানায় ডিউটি করতে আসতেন অর্চনা। মেয়ের ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভেতরের যে ঘরটায় বিছানা পাতা থাকে, সেখানে চলছিল এয়ার কন্ডিশনার।
ঘরে বেশ ঠান্ডা। তাই অর্চনা মেয়েকে নিজের কাজের ডেস্কে নিয়ে এসে সেখানেই পাতলা কম্বল মুড়ে শুইয়ে রেখেছিলেন। খাতায় একটা কিছু লিখছিলেন মন দিয়ে। সেখানেই একজন স্থানীয় সাংবাদিক হাজির ছিলেন, যিনি শিশুসন্তান সহ অর্চনার একটা ছবি তুলে নেন।
ছবিটা ওই সাংবাদিক যে পত্রিকায় কাজ করেন, তাদের অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত হতেই ভাইরাল হতে শুরু করে। অর্চনা অবশ্য জানতেনই না গোটা বিষয়টা।
তিনি বলেন, ছবিটার ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। কে তুলেছে, কোন পত্রিকায় বেরিয়েছে কিছুই জানা ছিল না। হঠাৎই ছবিটা আমাদের পুলিশকর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কেউ পোস্ট করে। তখনই মেয়ের আর আমার ছবিটা দেখতে পাই। তখনও ভাবছিলাম যে পুলিশ-গ্রুপেই ছবিটা ছড়িয়েছে। কিন্তু পরের দিন দেখি কাগজেও ওই ছবি!
কাজের সময়ে শিশুসন্তানকে সামনে শুইয়ে রাখার ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় ভয় পেয়েছিলেন কী? এই প্রশ্নের জবাবে অর্চনা বলেন, আমি তো চুরি করিনি। ডিউটিতেও কোনও গাফিলতি করি নি। ভয় পাব কেন? তবে ছবিটা ভাইরাল হয়ে যাওয়ার পরে সিনিয়ার অফিসারদের কয়েকজন ফোন করেছিলেন। আর রোববার তো স্বয়ং ডিজিপি স্যার ফোন করে জানতে চাইলেন কী করলে আমার একটু সাহায্য হতে পারে।
তিনি জানান, আমি বলেছিলাম আগ্রায় বদলি করে দিলে খুব সুবিধা হবে। সঙ্গে সঙ্গেই ডিজিপি স্যার আমার আবেদন মঞ্জুর করে দিয়েছেন।
অর্চনার গল্প
অর্চনার বিয়ে হয়েছে ২০০৬ সালে। তার স্বামী গুরুগ্রামে [পূর্বতন গুরগাঁও শহর] একটা বেসরকারি চাকরি করেন। ২০০৮ সালে তাদের প্রথম কন্যাসন্তান জন্মায়। বিয়ের আগে থেকেই সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা ছিল অর্চনার। এম এ পাশ করেছেন, বি এড-ও পড়েছেন। চাইছিলেন শিক্ষকতার চাকরি। তবে সেটা যখন পাওয়া গেল না, তখনই পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদের জন্য আবেদন করেছিলেন একবার। সেই চাকরি হয়নি।
তবে ২০১৬ সালে কনস্টেবল পদে চাকরীতে যোগ দেন অর্চনা। চাকরি পাওয়ার বছর দেড়েকের মধ্যে আবারও সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন অর্চনা। কিন্তু প্রথম সন্তানের জন্মের থেকে দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময়টা ছিল একেবারে আলাদা। সেই সময়ে তিনি চাকরি করতে না। কিন্তু এখন পুলিশের চাকরী রয়েছে তার।
ভারতে আগে ১২ সপ্তাহের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়া যেত। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে চালু হওয়া নতুন আইনে সেটা বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ, বা ছয় মাসের করা হয়েছে। অর্চনাও নতুন নিয়মে সেই সুবিধাই পেয়েছিলেন।
নিয়মমতো প্রসবের কিছুদিন আগে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন। তবে মেয়ের বয়স পাঁচ মাস হওয়ার পরে ফের কাজে যোগ দেন তিনি। আর বড় মেয়েকে শাশুড়ির কাছেই কানপুর শহরে রেখে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সদ্যোজাতকে তো আর সেটা করা যায় না! তাই থানায় ডিউটিতে আসার সময়েও শিশুসন্তানকে নিয়েই আসতে শুরু করেন তিনি।
জীবনটা মোটেও মসৃণ নয় অর্চনার। বলেন, এমনিতে নয় ঘণ্টার ডিউটি। কিন্তু কাজ থাকলে রাত-দিন যখন প্রয়োজন, তখনই হাজির হতে হয়। সপ্তাহে একটা নাইট ডিউটিও করতে হয়ে। খুব চাপ পড়ে তখন। বাচ্চাটা তো একেবারে ছোট! ন অর্চনা।
দ্বিতীয় কন্যার নাম রেখেছেন অনিকা। পরিবারের অন্য তিনজনের নামের অদ্যাক্ষর রয়েছে এই অনিকা নামে। অর্চনার ‘অ’, স্বামী নীলেশের ‘ন’ আর বড় মেয়ে কনক এর ‘ক’।
মেয়ের সঙ্গে ভাইরাল হয়ে যাওয়া তার ছবির কারণে নিজের বাবা-মা যে শহরে থাকেন, সেই আগ্রায় পোস্টিং হয়েছে অর্চনার। তিনি বলেন, এখন বাচ্চাটাকে দেখাশোনার জন্য আমার বাবা-মায়ের কাছাকাছি থাকতে পারব এটাই খুশির খবর। বড়মেয়ে তো শাশুড়ির কাছেই মানুষ হচ্ছে।
ছবি ভাইরাল হওয়ার পর নিয়ম পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা
তবে শুধু যে তার নিজের সুবিধা হয়ে গেছে ওই ছবিটি ভাইরাল হয়ে যাওয়ার ফলে, তা নয়। রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশক ঘোষণা করেছেন, অর্চনার মতো চাকরিরত নারী পুলিশকর্মীদের সন্তানদের দেখাশোনা করতে প্রতিটা থানায় ক্রেশ বা সেরকম কোনও ব্যবস্থা করা যায় কী না, তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছেন তিনি।
এতদিন শুধু ৫০ জনের বেশি নারী কর্মচারী রয়েছেন, এরকম সংস্থাতেই ক্রেশ তৈরি নিয়ম ছিল। অর্চনার দৌলতে অনেক মা হয়তো এই সুবিধাটাও পাবেন এরপরে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
/অ-ভি