মান্নাকে স্মরণ: ফটোশুটের আগে শর্ত দিলেন নায়ক
২০০৬ সালের কথা। আমি তখন পাক্ষিক আনন্দ আলোর সিনিয়র রিপোর্টার। ম্যাগাজিনটির ঈদ ফ্যাশন সংখ্যার কাজ শুরু হলো। পুরো অ্যালবামটিতে ঈদের পোশাক পড়ে ফটোশ্যুটে অংশ নিচ্ছেন শোবিজের টপ সেলিব্রিটিরা। সেশন হচ্ছে ফটোগ্রাফার আশীষ সেনগুপ্তের পল্টন বটতলার স্টুডিওতে। আমার ওপর দায়িত্ব সেলিব্রিটিদের ধরে ধরে স্টুডিওতে আনা।। নায়ক মান্না তখন ঢালিউডের টপ হিরো। রিয়াজ, ফেরদৌস আর শাকিব খানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও কেন জানি মান্নার সঙ্গে সেটা হয়ে ওঠেনি।সম্পাদক রেজানূর ভাইয়ের কড়া নির্দেশ মান্নাকে ফ্যাশন সংখ্যায় রাখতে হবে। আমি মহাফাপঁড়ে। নির্বাহী সম্পাদক সৈকত সালাউদ্দিন উদ্ধার করলেন, তিনিই মান্নার সঙ্গে কথা বলে ফটোশ্যুটের শিডিউল ঠিক করে দিলেন।
তবে শেষ রক্ষা হলো না। আমার উপর দায়িত্ব পড়লো মান্নাকে স্টুডিওতে নিয়ে আসার। রোজা শুরু হয়ে গেছে। ইফতারের পর পর সেশনের শিডিউল। মান্নার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে সৈকত ভাই ফোনটা ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে।চলচ্চিত্রের পর্দা কাঁপানো টপহিরো টাঙ্গাইলের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, শোনো ভাই বেশি সময় দিবার পারুম না। ইফতারের পর আধঘন্টা সময় পাইবা। আর ইফতার করবা আমার সঙ্গে আমার অফিসে...।
সম্পর্কিত খবর
কী মনে করে ইফতারটা স্টুডিওতেই করলাম। এরপর ছুট দিলাম কাকরাইলের ফরিদপুর ম্যানশনে। মান্নার প্রযোজনা সংস্থা কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্রের অফিসে ঢুকতেই কয়েকজন স্টাফ ছুটে এলো...আপনের নাম বিপুল? ভিতরে যান, ভাই আপনের জন্য অপেক্ষা করতেছে। ভেতরের রুমে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন মান্না ভাই। আমি ঢুকতেই সব চুপ। সবাই রাগি চোখে আমার দিকে তাকালেন। শান্ত ভঙ্গিতেই নায়ক বললেন, তোমার নাম বিপুল। তোমারে তো চিনি, এফডিসিতে দেখছি। তুমি তো কথা রাখলা না, এখন আমিও কথা রাখবো না। ফটো তুলতে যাবো না।
অকূল পাথারে পড়ে গেলাম, হায় হায় কী বলে... আমি আবার কী করলাম। মান্না বললেন, তোমার তো আমার লগে ইফতার করার কথা। চকবাজারতে ইফতার আনায় রাখছি। এখন তোমার সঙ্গে যাইতে পারি একশর্তে। আমার সামনে বইসা তুমি ওইগুলা খাইবা, তারপর আমি যাবো। ওই উনারে ইফতার দে।
ইয়া বড় ট্রে ভর্তি ইফতার, কয়েক রকম কাবাব, নাম না জানা আরো কতো আইটেম। এতো খাবার আমি তো আর শেষ করতে পারি না। মান্নার এককথা, সব খেতে হবে। কোনো রকমে অর্ধেক শেষ করলাম। মান্না ভাই যখন বুঝতে পারলেন আর পারছি না, আমাকে মাফ করলেন।
নায়কের কালোগ্লাসে ঢাকা কালো রঙের গাড়িতে ওঠলাম। গন্তব্য কাকরাইল টু নয়াপল্টন বটতলা মোড়। কপাল খারাপ, আবার বেকায়দা। ইফতার শেষে সব গাড়ি বের হয়েছে রাস্তায়। একাবারে আন্ধা গিটটুর মতো কঠিন জ্যাম। নাইটিঙ্গেল মোড়ের কাছে সেই যে আটকা গাড়ি আর নড়ে না, আধঘন্টা শেষ। মান্না আগেই জানিয়েছিলেন, রাত ৯টা থেকে এফডিসিতে তার শ্যুটিং। ৮টা বেজে গেছে। ফটোশ্যুটের টাইম কই? মান্না ভাই জানতে চাইলেন, স্টুডিও কতো দূর? বললাম, কাছেই তো... হেটে যেতে ১০ মিনিটও লাগবে না। আমাকে চমকে দিয়ে ওই সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক বলে ওঠলেন, তাইলে চলো হাঁটা ধরি।
পকেট থেকে মান্না ভাই একটা বড় রুমাল বের করলেন। আমাকে বললেন, ড্রাইভারকে স্টুডিও'র লোকেশনটা বুঝিয়ে বলতে। আর তিনি কায়দা করে রুমালটা এমনভাবে মুখের ওপর বাঁধলেন যে, চোখের নিচ থেকে চেহারার বাকি অংশ ঢাকা পড়ে গেল। গাড়ি থেকে নামলাম, ১০ মিনিটের আগেই হেটে হেটে আমরা আশীষ সেনগুপ্তের স্টুডিওতে পৌছে গেলাম।
আজ থেকে এগার বছর আগে ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি নায়ক মান্না অসময়ে দুনিয়াকে বিদায় বলেছেন। মান্না ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে সেদিনের ঘটনা চলচ্চিত্রের মতোই চোখে ভাসছে।
লেখক: পূর্বপশ্চিমবিডি ডটনিউজের বার্তা প্রধান
পিবিডি-এনই