• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

জয়পুরের রসনাবিলাস উপহার!

প্রকাশ:  ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০০:১৩
সজল জাহিদ।

সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত, সারা দিন জয়পুরের অনেক কিছু দেখে দেখে সবাই যখন ক্লান্ত, ক্ষুধায় কাতর তখন গাড়ি ছেড়ে দিলাম। আমাদের লক্ষ্য কেএফসি। ভারতে গেলে আমরা আমাদের প্রধান খাবারটা সাধারণত কেএফসিতে খেতেই পছন্দ করি। তেমন লোকেশন দেখেই নেমে গিয়েছি। কিন্তু নেমে খোঁজ নিয়ে জানলাম এখানে যে কেএফসিটা ছিল, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে কদিন আগেই। যা বাবা, এখন তবে খাবার কোথায় খুঁজবো?

আমার নাছোড়বান্দা মনোভাব সবাই জানে। একদম শেষ পর্যন্ত চেষ্টার কোনো ত্রুটি আমি কখনো রাখি না আমার কোনো ইচ্ছা পূরণের। যে কারণে সবাইকে আর একটু ধৈর্য ধরতে বললাম। যে আর একটু খুঁজে দেখি, একটু কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখি কেউ আমাদের পছন্দমতো কোন খাবারের জায়গা বা দোকানের খোঁজ দিতে পারে কিনা।

সম্পর্কিত খবর

    বন্ধ হয়ে যাওয়া কেএফসির মোড় থেকে পিংক সিটিকে পাশ কাটিয়ে জয়পুর নিউ মার্কেটের গলিতে ঢুকে পড়লাম। উদ্দেশ্য বাজারের ভেতরে, মোড়ে বা অলিগলিতে কোনো খাবারের দোকান পাই কিনা খুঁজে দেখতে আর সেই সাথে বাজারের পরিবেশ ও নতুন জায়গার নতুন মার্কেট কেমন হয় সেটাও দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু বাজারের মোড়ে গিয়েও তেমন কোনো খাবারের দোকান বা হোটেল পাওয়া গেল না।

    সবাই এবার বেশ বিরক্ত হতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে একটু এদিক ওদিক করলেই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। সবাইকে আরও একটু নিমরাজী করিয়ে আরও প্রাচীন পথ ধরে পুরনো বাড়িঘরে প্রায় ঘিঞ্জি হয়ে থাকা গলির দিকে পা বাড়ালাম।

    ক্ষুধার যাতনাকে সাময়িক বিরতি দিতে, পথের উপরেই পাওয়া ভ্যান গাড়ি থেকে ৫ রুপীর বিনিময়ে হাফ কেজি চিকন চিকন খয়েরি রঙের গাজর কিনলাম। পাঁচটি গাজর পাঁচজন মিলে চিবাতে থাকলাম। যদিও আমার এমন উদ্ভট কাণ্ডে সবাই বেশ হতাশ হয়েই গাজরে কামড় বসাতে লাগলো আর ভীষণ বিরক্তি নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকলো। কিন্তু আমার কেন যেন ভীষণ আশাবাদী লাগছে নিজেকে। এই দিকে কিছু না কিছু নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে আমাদের মনের মতো।

    আমার এত দিনের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তেমনই বলছিল ভিতর থেকে। একটি মোড়ে গিয়ে আর একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি সামনের মোড় দিয়ে সোজা চলে যেতে বললেন। ওদিকে পাওয়া যেতে পারে বলে আশ্বস্ত করলেন। বেশ চল তাহলে আর একটু যাই?

    দুই থেকে তিন মিনিট হবে এরপর। বেশ নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের পাশ দিয়ে নাক বন্ধ করে তিন রাস্তার মোড়ে যেতেই সবার চোখে মুখে দারুণ আনন্দ দেখা গেল। আরবি আর হিন্দি হরফে লেখা হোটেলের নাম। আমি তো পারলে খুশিতে লাফই দিয়ে দেই। কিন্তু না, নিজেকে সংযত করলাম আগে দেখে নেই কী পাওয়া যায়, তারপর না হয় লাফ দেয়া যাবে আনন্দে।

    তিন রাস্তার মোড়ে বিশাল বিশাল পিতল আর সিলভারের হাড়ি আঁকাবাঁকা হয়ে আছে কাঠের দগদগে চুলার লাল টকটকে কয়লার উপরে। প্রতিটি বিশাল গাড়ি দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সবার আগে ঢুকে গেলাম জেনে নিতে কী আছে আর নেই। কারণ তখন বিকেল হয়ে গেছে। আদৌ কোনো খাবার আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হয়ে নেই।

    নাহ, সব কিছুই আছে। কী চাই আমাদের? রুটি, চাপাতি, নান। সাথে মাংসের নানা রকম আইটেম, বিরিয়ানি কয়েক রকমের। আহ, পাগলের মতো অর্ডার দেয়া হলো আর উন্মাদের মতো খাওয়া হলো। খাসির রেজালার বিশাল বোলের সাথে নান রুটি, কেউ চিকেনের সাথে রুটি, কেউ বিরিয়ানি আর কেউ দুই রকমেরই।

    নানা রকম মুখরোচক খাবার, পানি, সালাদ দিয়ে পেট পুরে খেয়েদেয়ে, আয়েশ করে বসে বিশ্রাম নিয়ে সবার মিলে বিল হলো মাত্র ৩৫০ রুপী! ভাবা যায়? খাসির রেজালা, ডালগোস, চিকেন কারি, পর্যাপ্ত নানরুটি, বিরিয়ানি আর সবকিছু মিলে সবার বিল মাত্র ৩৫০ রুপী! এ উপহার নয় তো কী? আর সেই হোটেলের ভেতরের সজ্জা, একটু আলো আধারির মধ্যেও নজর এড়ায়নি কিছুতেই।

    সেই আকর্ষণে আকর্ষিত হয়েই খাওয়া দাওয়া শেষের বিশ্রাম শেষে একটু ছবি তুলে নিলাম সবকিছুর। সবাই পেট পুরে খেয়ে দেয়ে, আরাম করে আর তৃপ্তি নিয়ে বের হলাম হোটেল থেকে সুখে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে। খাওয়া দাওয়ার শেষে যখন হোটেল থেকে বেরিয়েছি তখন জানতে পারলাম এই জায়গার নাম চাঁদপোল। জামা মসজিদের পাশেই। জয়পুরের এটিই ছিল আমাদের উপহার। অন্তত আমাদের কাছে উপহার স্বরূপই ছিল।

    এবার বলি একটি গোপন কথা, আমি কীভাবে বুঝলাম যে এইদিকে কোথাও না কোথাও এমন মনের মতো স্বাদের আর দামের খাবার পাওয়া যাবে? আমার অভিজ্ঞতা বলে, যেখানেই একটু অগোছালো, একটু নোংরা পথঘাট আর একদম সংস্কারহীন স্থাপনায় ভরা থাকে সেখানে সাধারণত কোনো না কোনো অবহেলিত জনগোষ্ঠী বসবাস করে। আর এসব জায়গার মানুষজন তাদের নিজেদের জন্যই রাখে এমন ব্যবস্থা।

    কারণ এই অবহেলিত জনগোষ্ঠী সমাজ থেকে কিছুই তেমন পায় না বলে, যতটুকু পায় ততটুকুই তাদের ভোগ বিলাসে ব্যয় করে থাকে। এটাই তাদের একমাত্র আনন্দ, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা আর পুরনো বনেদী অভ্যেস। যেটা চাইলেও ছাড়তে পারে না, পারবে না। পেটভরে আর নানা রকম মুখরোচক খাবার খাওয়াটা তাদের কাছে একমাত্র বিলাসিতা।

    আর তাই জয়পুরের বাজারের মধ্যে থেকে এমন গলি দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এদিকে এমন খাবার পাওয়া যাবেই যাবে। শেষ পর্যন্ত একটু কষ্ট করে, অসহ্য পরিবেশ মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলাম বলেই পেয়েছিলাম এমন উপহার, মনপ্রাণ ভরে মনের মতো খাবারের স্বাদ। এটাই ছিল জয়পুরে আমাদের বিশেষ উপহার। আমাদের জন্য…

    জয়পুরের উপহার!

    লেখক: সজল জাহিদ।

    সৌজন্যে: ট্রিপ জোন।

    পিবিডি/ ইকা

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close