অর্ধাঙ্গ: আমি ও তুমি
নারী সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। নারী পড়ে থাকলে সমাজে উঠবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বেঁধে রাখলে, সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কতদূর চলবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং নারীদের স্বার্থ ভিন্ন নয়-একই। তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যা আমাদের লক্ষ্যও তাই। শিশুর জন্য পিতামাতা-উভয়েরই সমান দরকার। কি আধ্যাত্মিক জগতে,কি সাংসারিক জীবনের পথে-সর্বত্র আমরা যাতে তাঁহাদের পাশাপাশি চলতে পারি, আমাদের এরূপ গুণের আবশ্যক। প্রথমত উন্নতির পথে তাঁরা দ্রুতবেগে অগ্রসর হলে-আমরা পশ্চাতে পড়ে রইলাম। এখন তাঁরা উন্নতরাজ্যে গিয়ে দেখছেন সেখানে তাঁদের সঙ্গিনী নাই বলে তাঁরা একাকী হয়ে আছে। তাই আবার ফিরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছে এবং জগতের যে সকল সমাজের পুরুষেরা সঙ্গিনীসহ অগ্রসর হচ্ছেন,তাঁরা উন্নতির চরমসীমায় উপনীত হতে চলছে। নারীদের উচিত যে, তাঁদের সংসারের এক গুরুতর বোঝা বিশেষ না হয়ে সহচরী, সহকর্মিনী, সহধর্মিণী ইত্যাদি হয়ে তাঁদের সহায়তা করা। নারী অকর্মণ্য পুতুল-জীবন বহন করবার জন্য সৃষ্ট নয়, একথা নিশ্চিত তা প্রমাণিত।
একটা মেয়ে যখন জন্মায় তখন সে ইন্দ্রিয় শক্তি দ্বারা তাড়িত হতে থাকে, এই তাড়না তাকে শিশু থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে বালিকা এবং বালিকা থেকে নারীতে পরিণত করে। আমাদের সভ্য সমাজে এই নারী কখনও মা কখনও বোন কখনও প্রেমিকা হয়ে আর্বিভাব হয়। বাবা আদম যখন বেহেশতে একা সময় কাটাচ্ছিলেন। তাঁর এই একাকিত্বেও প্রহর বিষন্নতার আকাশে খুশীর চাঁদ হয়ে আসেন মা ‘হাওয়া’। বাবা আদমের অর্ধাঙ্গী হয়ে। অর্ধ+অঙ্গ= অর্ধাঙ্গ। শব্দটা এমনই। নারী কে অর্ধ অঙ্গ বলা হচ্ছে। পুরুষ যদি হয় বাম হাত তবে নারী হবে ডান হাত। নারী যদি হয় বাম চোখ পুরুষ হবে ডান চোখে। আর এই হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারী পুরুষ সম্পর্ক পৌছায় এক ঐশ্বরিক আভায়। যে যাই ভাবুক রংপুরের পায়রাবন্দে জন্ম নেয়া বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এটাই মনে করেন। এবং তার লেখায় চেতনায় নারী কে এটাই ভাবতে অনুপ্রাণিত করেন যে,হে নারী তুমি অর্ধাঙ্গী’
সম্পর্কিত খবর
সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী!
নরককুণ্ড বলিয়া কে তোমা’করে নারী হেয়জ্ঞান?
তারে বলো,আদি-পাপ নারী নহে, সে যে নর-শয়তান।
অথবা পাপ যে-শয়তান যে-নর নহে নারী নহে।
এ-বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,
নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।
তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?
অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শা-জাহান।
জ্ঞানর লক্ষ্মী, গানের লক্ষ্মী,শস্য-লক্ষ্মী নারী,
সুষমা-লক্ষ্মী নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারি।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ!
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হ’য়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা ল’য়ে – নারী যোগায়েছে মধু।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হ’ল, পুরুষ চালাল হল,
নারী সেই মাঠে শস্য রোপিত করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হল, নারী বহে জল, সেই জল-মাটী মিশে
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে। (সঞ্চিতা, নারী, পৃ:৬৩-৬৪)জাতীয় কবি নজরুলের এই কবিতার প্রত্যেকটি লাইন যদি আমরা লক্ষ্য করি, পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে নজরুল বলতে চেয়েছেন অর্ধেক নর করেছে অর্ধেক নারী করেছে। সমান সমান হয়েই করেছে। নজরুলের আরও অনেক রচনা আছে যা নারীকে যথাযোগ্য সম্মান দেয়। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যা বার বার নারী কে বোঝাতে চেয়েছেন। নারীকূলের বিবেক কে জাগ্রত রাখতে বলেছেন যে এই বলে যে,- নারী তুমি অর্ধাঙ্গী তুমি চরণ দাশী নও!
সকালের যে সূর্যরশ্মি একটা পুরুষ দেখে দুপুরের যে কড়া রোদে একটি পুরুষ দেখা তার সবকিছুই তো একটা নারীও দেখে। সমাজের তৈরি কৃত যে বলয় সে বলয় ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার মত ধৈর্য্য সাহস নমনীয়তা,কঠোরতা সবই আছে। মনে রাখা উচিত নারী তুমি আগে মানুষ পরে অর্ধাঙ্গী। তাই পঞ্চইন্দ্রিয় ভেদ করে নিজের বিবেক কে কাঠগড়ায় দাঁড় করাও নিজেকে জিজ্ঞেস কর কে তুমি! কি তুমি!
নারীকে প্রেমের এক অকৃত্রিম সম্মান দিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নারী প্রেমের অসংখ্য প্রমাণ তাঁর কবিতা,গান ছোটগল্প,উপন্যাস এ। শুধু নারী নিয়ে নয়। নারীর পথচলায় যে বিভিন্ন ধরণের প্রতিবন্ধকতা সেটা নিয়েও রবি ঠাকুর নাটক লিখেছেন গান লিখেছেন। তাঁর অনেক উদাহরণ প্রতিনিয়ত পাঠক খুজে পান। রবি ঠাকুর তাঁর রচনায় কোথাও কিন্তু পুরুষতন্ত্রবাদ বা শুধু পুরুষ কে গুরুত্বদিয়েই একটা রচনার আপাদমস্তক শেষ করেছেন তা কিন্তু নয়। তিনি কখনও নারীর কাছ থেকে প্রেম পেয়েছেন কখনও বা করুণাও পেয়েছেন কিন্তু কখনও নারীকে অসম্মান করেননি। পাশাপাশি থাকতে চেয়েছেন দু’জনে। ভালবাসার খুঁনসুটি করতে চেয়েছেন আমৃত্য। এই সুখ স্বর্গ সুখ। তিনি পাশে কাউ কে চেয়েছেন আজীবন। রবি ঠাকুর ‘সহযাত্রী’ কবিতায় বলতে চেয়েছেন-
কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি
যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে,
ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী
কোথায়, যেতেছি কোন দেশে সে কোন দেশে।
কূলহারা সেই সমুদ্র-মাঝখানে
শোনার গান একলা তোমার কানে,
ঢেউয়ের মতন ভাষা-বাঁধন-হারা
আমার সেই রাগিণী শুনবে নীরব হেসে।। (সঞ্চয়িতা, সহযাত্রী, পৃ:২৮৮)নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে বলতে একটা সময় কট্টরপন্থি হয়ে উঠলেন। নারীকে অসম্মান করলে তাঁর লেখার প্রতিটি শব্দ, বাক্য বজ্র্যপাত হয়ে ঝড়ে আকাশ থেকে। মানুষটি তসলিমা নাসরিন। নারীর অধিকার আদায়ে বরাবরই তিনি যথেষ্ট সচেতন এবং বেগবান। তাঁর অনেক লেখা বাজেয়াপ্ত হয়েছে এবং নির্বাসিত করা হয়েছে। তিনি বারবারই বলেছেন নারী তুমি বোকা নও। তোমাকে বোকা বানানো হচ্ছে। তোমাকে সংসার নামক জংগলে ফেলে সেখানে তোমাকে সন্তান উৎপাদনের মেশিন করে রাখা হচ্ছে। নারীকে তার মগজের বারান্দা ভেঙ্গে সমাজের অংশ হতে হবে। অংশীদার হতে হবে। দৃঢ় চিত্তে অর্ধেক অঙ্গ হতে হবে। নারী জাগলেই মানুষ হবে। নইলে নারী মানুষ নয় খেলার পুতুল। এমন অনেক লেখা আছে তসলিমা নাসরিনের যা সমাজের নারীদের নারীসত্ত্বাকে জাগ্রত করে তুলে। আর পুরুষতন্ত্রকে বলে নারী কে সম্মান করতে। নারী কখনও বৃষ্টি কখনও দূর্গাপ্রতিমা রূপে যেরূপ প্রতিয়মান হয়। নারী জলচ্ছাস হয়ে ভাসিয়ে শূন্য হাত করে দিতেও পিছপা হবে না। তসলিমা নাসরিন তার ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ কাব্যগ্রন্থেও অন্তর্ভূক্ত “মেয়ে মানুষ” কবিতায় বলেন-
শুধু যে মানুষ নয়
মানুষের আগে মেয়ে।
পৃথিবীতে শুধু মানুষ হিসেবে আজও চিহ্নি হয়নি মেয়েমানুষেরা।
একটি পুরুষ-অঙ্গ
আর স্তনহীনতা কি মানুষের গুণাবরী?মানুষের তালিকা বিচ্যুত
নারী নামধারী পণ্য আজ বাজারে বিকোয়
পটল কুমড়ো আলু আর খাসির মাংসের মতো
পায়ে নূপুরের মতো বাজে পুরনো শিকল
অ্যাসিডে পুড়ছে তার মুখ
প্রতিদিন কেউ একজন তাকে ধর্ষণ করছে
তাকে গলা টিপে,কুপিয়ে মারছে
আজও সহমরণের আগুন জ্বলছে তার দেহে
তার স্বাধীনতার নাটাই ধরে বসে আছে কথিত মানুষ। (তসলিমা নাসরিন কবিতা সমগ্র, মেয়ে মানুষ, পৃ: ৫৪)পুরুষ ফেইসবুক ব্যবহার করবে ইনস্টাগ্রামে ছবি আপলোড দিয়ে কাঁপাবে বিশ্ব। নারী তখন রান্না ঘরে পেয়াজ কাটবে। কে কি খাবে, কোনটাতে লবন বেশি হল, ঝাল কম হলো কোনটাতে সেগুলো লক্ষ্য করবে। একটা পুরুষ যখন ডাক্তার হয়ে রোগ নির্ণয়ে ও সমাধানে ব্যস্ত নারী তখন সুঁই-সুতা নিয়ে মাফলার বুনছে জর্জ হয়ে পুরুষ যখন অন্যায়ের শাস্তি দেয় নারী তখন না খেয়ে থাকেন কর্তাবাবুর খাওয়ার অপেক্ষায়। সমাজ পরির্বতন হচ্ছে। পরির্বতন হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গির। নারীরা অর্ধেক অঙ্গ হয়ে সময়ের সাথে তালে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আগের সেই প্রচলিত প্রথা,রীতি ভ্রান্ত বিশ্বাস,এখন আর দেখা যায় না। এখন ফোরজি জেনারেশন চলছে। এখন মহাসড়ক গুলোতে নারী স্কুটি বা মটর বাইক চালালে মনে হয় নারীদের মধ্যে স্পিডি ব্যাপারটা এসেছে। এখন অসুস্থ হলে নারীরা পুরুষ ডাক্তারকে নিজের সমস্যাগুলো খুলে বলতে কুণ্ঠাবোধ করেনা। মহাকাশে কল্পনা চাওলা আকাশে কানিজ ফাতেমা রোকসানা’রা অনেক আগেই প্রমাণ করেছেন, নারীরা শুধু পাতালে নয় তাঁরা আকাশ পাতাল সর্বত্র বিরাজমান। শুধু তাদের প্রয়োজন পরে আর একটা অঙ্গের। অর্ধাঙ্গ হয়ে কেউ পরিপূর্ণ হয় না। বাম হাত ছাড়া যেমন ডান হাত অপূর্ণ। বাম চোখ ছাড়া যেমন ডান চোখ অপূর্ণ। একজন পুরুষ ছাড়া একজন একা নারীও তেমনি অপূর্ণ। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন,বোঝাতে চেয়েছেন সর্বত্র যে,একজন নারী একটি পুরুষের অর্ধেক অঙ্গ।
তথ্যপুঞ্জি:
১. রোকেয়া রচনাবলী-১ নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা,২/৮ সৈয়দ রোড মোহাম্মদপুর,ঢাকা।
২. সঞ্চিতা, আহমেদ মাহমুদুল হক মাওলা ব্রাদার্স,৩৯ বাংলা বাজার ঢাকা।
৩. সঞ্চয়িতা, মো:মোকসেদ আলী,সালমা বুক ডিপো,৩৮/২ বাংলা বাজার ঢাকা।লেখক: গবেষক, নাট্যকলা ও পরিবেশনাবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
/পিবিডি/একে