ভালবাসা ও প্রেমের তুলনামূলক পাঠ
অনেকদিন ধরেই ভালবাসা ও প্রেম নিয়ে লিখার কথা ভাবছিলাম, হয়ে ওঠেনি। মানবিক সম্পর্কে ভালবাসা ও প্রেম যে এক নয় তাই এ লেখার প্রতিপাদ্য। লেখাটি মানব-মানবীদের নিজেদের সম্পর্কের ধরন ও অবস্থা বুঝতে সহায়ক হবে বলে মনে করি।
ভালবাসার ইংরেজী যদি love হয় তাহলে প্রেম হচ্ছে romantic love.
সম্পর্কিত খবর
ভালবাসতে, ভালবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লাগে। কিন্তু আপনি মূহুর্তেই প্রেমে পড়তে বা প্রেমে যুক্ত হতে পারেন। যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তা প্রেমের নয়, ভালবাসার। প্রেম হলে প্রথমেই (কাছে আসায় কিছুদিনের মধ্যেই) হয় নাহলে (ঐ দুজনের) কখনোই নয়। প্রেমের সম্পর্ক ভালবাসায় পরিণত হতে পারে, ভালবাসার সম্পর্ক কখনোই প্রেমে যেতে পারে না।
প্রিয়জনের অংশগ্রহণ এমনকি সম্মতি না থাকলেও আপনি ভালবাসতে পারবেন। ভালবাসা একপাক্ষিক হতে পারে, ভালবাসার বিনিময় নাও থাকতে পারে। কিন্তু প্রেমে দুইজনের সক্রিয় অংশগ্রহন অবশ্য দরকার। প্রেম একপাক্ষিক নয়, প্রেমাবেগ প্রকাশ ও বিনিময়ে উভয়পক্ষের সতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ আবশ্যক।
ভালবাসা নিরবে নিভৃতে আসতে পারে, গোপনে গহীনে বাঁচতে পারে। প্রেম ঝড়-তুফান-সুনামী হয়ে আসে, সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি প্রেমে পড়লেও টালমাটাল হয়ে পড়েন। সব এলোমেলো হয়ে যায়। তা গোপন করা যায় না, চারিদিক দিয়ে আঁটকে রাখতে গেলেও যেকোনদিক ঠেলে বের হয়ে আসে।
প্রেমে প্রকাশ ও প্রকাশের পারদর্শিতা গুরুত্বপূর্ণ। ভালবাসার বাহ্যিক প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রকাশ নাও থাকতে পারে। প্রেমে বাহ্যিক সৌন্দর্য্য গুরুত্ববাহী, ভালবাসা সেখানে আটপৌড়ে। ভালবাসায় প্রিয়জনের ভাললাগাই মূখ্য, প্রিয়জনকে সুখী করতে পারাই সেখানে নিজের সুখ। প্রেমে নিজের ভাল লাগাই মুখ্য, প্রিয়জনের কিছু কষ্টে সুখ আসলে তাতে বিশেষ আপত্তি নেই।
প্রেমে ছলনা, মিথ্যাচারীতা যুক্ত থাকতে পারে। ভালবাসায় এগুলো কখনোই যুক্ত থাকে না। প্রেমে হারানোর ভয় থাকে; ভালবাসলে-ভালবাসা পেয়ে গেলে হারানোর ভয় নেই। প্রেমে সন্দেহ যুক্ত থাকে, ভালবাসা সন্দেহাতীত। ভালবাসা শারীরিক সংসর্গ নিরপেক্ষ, থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। প্রেম শারীরিক সংসর্গযুক্ত, সুযোগ থাকলে এটি অবশ্য যুক্ত হয়; সুযোগ না থাকলে সুযোগ তৈরীর সচেতন প্রচেষ্টা থাকে।
কোন কারণে ভালবাসার সম্পর্কে যুক্ত থাকা মানুষের সাথে বিচ্ছেদ হলেও প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসা থেকে যায়, আটকানো যায় না। প্রিয়জন অন্যায় করলেও ভালবাসা থেকে নিজেকে নিঃবৃত করা যায় না। প্রেম তীব্র, বিচ্ছেদের প্রকাশও তাই তীব্র। বিচ্ছেদে প্রিয়জনকে ঘৃণা থেকে শুরু করে খুন পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ভালবাসায় বৈচিত্র কম, প্রেম বৈচিত্রময়। ভালবাসায় উত্তেজনা কম, প্রেম উত্তেজনায় পরিপূর্ণ। মানুষ মূলত ভালবাসায় বেঁচে থাকে, ভালবাসতে পেরে বেঁচে থাকে কিন্তু যুগৎপদ সৌভাগ্যজনক ও দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, তারা সর্বদা প্রেম চায়।
আশার কথা হচ্ছে ভালবাসাহীন প্রেম বেশিদিন চলতে পারে না। নিউরো বিজ্ঞানীদের মতে রোমান্টিক লাভ বা প্রেমের স্থায়িত্ব সাধারণত তিন বছরের অধিক হয় না। সম্পর্ক বেঁচে থাকতে হলে যেকোন প্রেমের সম্পর্ককে এই সময়ের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্কে আসতে হয় বা রুপান্তরিত হতে হয়। প্রেম যদি ভালবাসায় রুপান্তরিত হতে না পারে তাহলে তা টিকে থাকতে পারে না বা সমাপ্তি ঘটে। যাদের সম্পর্ক প্রেম থেকে ভালবাসায় যায় তারা মধ্যবর্তী সময়ে প্রেম আর ভালবাসার মিশেল এক অনুভূতি পায়।
বিপদের কথা হচ্ছে- প্রেম, ভালবাসা মানে না। ভালবাসার সম্পর্কে থাকা মানুষ বায়োলজিক্যাল কারণে ভিন্ন মানুষের প্রতি অনুরক্ত হয়ে প্রেমে পড়তে পারে। আর প্রেমের ধর্ম অনুসারে তা সবকিছু ভেঙেচুরে ফেলে। এটি মানুষের বায়োলজিক্যাল প্রবণতা। অধুনা এসব বেশি আলোচিত হলেও তা মানব সমাজে চিরকালই ছিল।
ততোধিক বিপদজনক হচ্ছে- প্রেম, প্রেমকেও মানে না; অর্থাৎ প্রেম নিজেকেও মানে না। ভাবুন প্রেমের সাতটি লেভেল বা স্তর আছে যথাক্রমে ১ডিগ্রী, ২ডিগ্রী,.........৭ডিগ্রী পর্যন্ত। ধরুন, আপনি প্রিয়জনের সাথে ৩ ডিগ্রী প্রেমে যুক্ত আছেন, দূর্ভাগ্যক্রমে আপনি এমন এক নারী বা পুরুষের প্রেমে পড়লেন যার সব কিছু আপনার চাওয়ার সাথে মেলে আর তারও মেলে আপনার সবকিছুর সাথে। তাহলে ঘটনা বুঝতেই পারছেন, প্রেম জমে ক্ষীর! ৭ ডিগ্রী প্রেম!! ইন্দোনেশিয়ার সুনামীর ন্যায় আপনার নব্য ৭ ডিগ্রী প্রেম আপনার বর্তমান ৩ ডিগ্রী প্রেমকে ভাসিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত সাগর, আরব সাগর, অ্যাটল্যান্টিক পার করে একেবারে কাসপিয়ান সাগরে পাঠিয়ে দিবে।
আপনাদের সবার জীবনে ৭ ডিগ্রী প্রেম আসুক, অতঃপর তা প্রকৃত ভালবাসায় রূপান্তরিত হোক!
পিবিডি/ এইচ কে
লেখক- শুকদেব বিশ্বাস: বস্ত্র প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা।