• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আমরা নারী আমরাই পারি

প্রকাশ:  ০৮ মার্চ ২০১৯, ২৩:১০ | আপডেট : ০৮ মার্চ ২০১৯, ২৩:১৩
আদনীন কুয়াশা

সম্পর্কিত খবর

    সকাল থেকেই মাথা ব্যথা নীপার,তার আজকে অনেক কাজ,মাথা ব্যথায় কাইত হয়ে শুয়ে থাকার মতো বিলাশিতা করার মতো কোন উপায় নেই, নিজের উপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে কি দরকার ছিল ফযরের নামাযের পর জায়নামাযে বসে হা হুতাশ করে এতো কান্নাকাটি করার?বিয়ের পর থেকেই এই সমস্যা তার উপর ভর করেছে একটু কান্নাকাটি করলেই মাথা ধরে যায়।

    শুভ কে সে দু সাপ্তাহ আগেই বলে রেখেছিল ৮ তারিখ বিকেলে তাকে একজায়গায় ইনভাইট করা হয়েছে স্পেসাল গেষ্ট হিসেবে। সেদিন যেন কোন কাজ না রাখে,অথচ কথা নেই বার্তা নেই গতকাল অফিস থেকে ফেরার সময় সন্ধায় ইয়া বড় একটা কাতল মাছ,৩ কেজী চিংড়ী মাছ,৮ টা মুরগী,২ কেজী খাশির মাংস নিয়ে এলো।

    রাজশাহী থেকে তার কোন ছোট বোন জামাই নিয়ে ঢাকায় আসছে,তাদের সে দুপুরে খেতে ডেকেছে এই জন্য আয়োজন করতে হবে।

    প্রথম কথা মাছ মুরগী কিছুই সে কেটে আনেনি যেখানে সবসময় বাজার থেকেই ড্রেসিং করে আনা হয়,২য় কথা শুভর এই ছোট বোনের নাম নীপা কখনই শুনে নাই।

    তারপরও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাজার সামলাতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।শুভর চকচক করা চোখ দেখে তখন থেকেই কান্না আসছিল নীপার, অনেক কষ্টে নিজেকে ধরে রেখে স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছিল সে চায়না শুভ তার চোখের পানি দেখুক।

    নীপা যখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ত শুভর সাথে তার পরিচয়,ব্যবসায়ী বলে নীপার বাবা শুভ কে একদমই পছন্দ করলো না, তিনি চাইতেন তার মেয়েকে তার মতোই কোন সরকারী অফিসারের কাছে বিয়ে দিবেন।নানান বাঁধা বিপত্তির পরে তাদের বিয়ে হয়।

    বিয়ের দুদিন পর নীপার শাশুড়ি স্পষ্ট জানিয়ে দেয় চৌধুরী বাড়ির বউরা চাকরীবাকরী করতে পারবেনা এতে নাকি ওদের মান হানি হয়।

    নীপা অবশ্য নিজেকে এমন একটা পরিস্থিতির জন্য তৈরী করে রেখেছিল,শুভর সাথে রিলেসনের সময় নীপা বুঝতে পেরেছিল যে ছেলেটাকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে তার সাথে জীবন কাটাতে হলে অনেক কিছু মেনে নিয়েই ভালোবাসার মানুষের পাশে থেকে জীবন কাটাতে হবে।শুভকে বিয়ের পর তার আর মাস্টার্স আর করা হয়নি।

    তবে ডিবেট ক্লাব খুব মিস করতো নীপা,সে যে তুখোড় বিতার্কিক ছিল, জাতীয় পর্যায় তার দুটো গোল্ড মেডেলও আছে।এগুলো নিয়ে একদমই ভাবতো না তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে ছিল একটা যৌথ পরিবারের সংসার।

    বিয়ের দুবছরের বিবাহবার্ষিকীতে শুভ নীপাকে একটা ডিএসএলার ক্যামেরা কিনে দেয়েছিল,ছোটকাল থেকেই নীপার ফটোগ্রাফি সেন্স দারুন, যেখানেই বের হতো তার সঙ্গী থাকত এই ক্যামেরা,একটা ফটোগ্রাফি সাইডে তার তোলা ফুল বিক্রি করা ছোট একটা পথশিশুর ছবি ভীষণ ভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে,তারপরই খুব তাড়াতাড়ি সোস্যাল মিডিয়াতে নীপা পরিচিত মুখ হয়ে উঠে।ফ্রীলেন্সার হিসেবেও ভালো নামডাক হয় তার।

    ওর ছবির সাথে লিখা বাস্তবভিত্তিক কবিতাগুলো ওনলাইন পোর্টালগুলোতে হিট ভিউজ হতে থাকে।কিভাবে যেন তার তোলা একটা ছবি আমেরিকান ফটোগ্রাফি সাইটে ভাইরাল হয় তারপরপরই বিশ্বে সারা জাগানো আমেরিকান ফটোগ্রাফার স্টীভ ম্যাকারী এর পক্ষ থেকে একটা মেইল আসে।

    নীপা সেদিন খুশিতে আত্মহারা হয়ে শুভর অফিসে চলে আসছিল,যতটা আনন্দে সে শুভর কাছে ছুটে গিয়েছিল ততটা মর্মাহত হয়ে ফিরতে হয়েছিল যখন শুভকে সে জানাল স্বয়ং স্টীভ সাহেব নীপাকে তার সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে শুনেও শুভর চাপা ধমক খেয়ে।

    অথচ এই খবর ফেসবুক,নিউজ পোর্টাল,জাতীয় পত্রিকা সবখানে প্রকাশ পাবার পর খুব অহংকারে সবাই কে বলতো শুভর দেওয়া ক্যামেরা দিয়ে নীপার ছবি তুলার নেশা হয়েছে বলেই আজ সবাই তাকে চেনে।নীপার মুখ টিপে হাসি আসত শুভর এমন হ্যাংলামো দেখে, শুধু সেই জানে কত তিরষ্কার, কত রকমের ঠ্যাস মার্কা কথা শুনে তাকে ছবি তুলতে হয়,লেখালেখি করতে হয়।

    নীপা জানতো দেশেই যখন কোন কাজ করার পার্মিশন তার নেই সূদুর আমেরিতায় যেয়ে এতো বড় ফিল্ডে কাজ করার স্বপ্ন দেখা বৃথা।তাই সে স্টীভ ম্যাকারীর মেইলে উত্তরে খুব গুছিয়ে লিখেছিল তার অপারগতার কারণের কথা।

    ওরা নীপার কাজে এতোটাই মুগ্ধ ছিল যে তারা ওর সব প্রতিকূলতা পার করে যেন কাজে আসতে পারে সেই কামনা করে এবং অপেক্ষায় থাকবে জানায়।

    এই ঘটনায় নীপাকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। বেশ কয়েকমাস সে ডিপ্রেসনেও ভোগে,আর এই ডিপ্রেসন থেকেই তার লেখালেখির শুরু। এখন শুধু তার ফটোগ্রাফি নয় তার সাথে তার লেখা আর্টিক্যাল নানান গ্রুপে,ব্লগে, পেইজে তুমুল জনপ্রিয়।এখনকার সময়ে সোস্যল মিডিয়াতে “মাশিয়াত নীপা”একটা পরিচিত নাম।

    আজকের দিনে “নারী”ফোরাম থেকে তাকে স্পেশাল গেস্ট হিসেবে ইনভাইট করেছে গত মাসেই।ঘরে বসেই চাইলেই কিছু করা যায় শুধু দরকার দৃঢ় প্রত্যয় আর মানষিক শক্তি এই নিয়ে একটা মোটিভেসনাল সেসন করার জন্য।

    এমন প্রোগরাম নীপা বেশীরভাগ সময় একটু এভয়েট করার চেষ্টা করে কিন্তু ৮ই মার্চ বলে কেন যেনো তার এবার খুব ইচ্ছে করলো প্রোগরামটায় যাওয়ার,আসলেই কতকত মেয়ে এক পরিবার সংসারের দিকে তাকিয়ে নিজের স্বপ্ন, নিজের ক্যারিয়ার জলান্জলী দিয়ে দেয়।তার কথা শুনে যদি অন্তত নিজেদের প্রতিভার কিছুটা অংশ ঘরে বসে ধরে রেখে অস্তিত্বটাকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল শিখাতে পারে এতে যে কতোটা মানষিক শান্তি পাওয়া যায় এটাই বা কম কিসে?

    মাথা ব্যথা নিয়ে নীপা এক কাপ কড়া করে কফি বানিয়ে বারান্দায় বসল ,মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা এ্যাপস ডাউনলোড করল, তাদের টাইমিং দেখল সঙ্গে সঙ্গে মনে হল মাথাটা হালকা হয়ে কপালের চিন্তার বলিটা অদৃশ্য হয়ে গেল,গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে টবের মাটিগুলো একটু খুঁচিয়ে পানি দিল।

    ঘড়ির এলার্ম বাজছে নয়টা বেজে গেছে আজকে শুক্রবার।শুভ বের হয়েছে নাস্তা আনতে,প্রতি শুক্রবার সকালে স্টার থেকে মগজ নিয়ে আসে সকালের নাস্তার জন্য তারপর কিছুক্ষন খবরের কাগজ নাড়াচাড়া করে গোসল করে জুম্মার নামায পড়ে কবরস্থানে যায়।নীপা তার খোলা চুল পেছন থেকে হাত খোপা করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।

    ২ টায় বাসায় ফিরে শুভ নীপা কে দেখে অবাক হয়ে গেল। অন্যদিনের চেয়ে আজকে নীপা কে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে,হালকা বেগুনী জামদানী,হাতে কাচের চুরি,মোটা করে কাজল লাগিয়ে খোপায় সাদা গোলাপ গুজে সে যেন শুভরই অপেক্ষা করছিল।

    _তুমি এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছ?

    _ তোমাকে বলেছিলামনা আজকে একটা প্রোগরাম আছে আমাকে যেতে হবে।

    _ ওহো আজকে ত ৮ তারিখ, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু গেষ্ট আসবেতো, মায়ের শরীরটা ভালোনা তুমি জাননা?রান্নাবান্না কেমনে কি?

    -আহা এতো চাপ নিচ্ছ কেন শুভ? আজ পর্যন্ত কখনও আমি তোমাকে কোন কিছুতে কি নিরাশ করেছি? তুমি কি রান্নার সুঘ্রাণ পাচ্ছনা? টেবিলে সব রেডি করে দিয়েছি, মেহমান আসলে ঝুমা সব ওভেনে গরম করে দিবে,ডোন্ড ওয়েরী তাছাড়া আমি সন্ধার মধ্যে চলে আসব তারপর জম্পেস আড্ডা হবে আর তোমার এই বোনকে তো আমি চিনলামইনা গত ৮ বছরে নামও শুনি নাই আমি এসে তার সাথে সব কথা হবে, ওকে সোনা তাইলে আমি যাই?

    শুভ হেঁটে এসে প্রথমে ফ্রীজ খুলল, হু কিছুই নেই শুধু কাতল মাছের মাথাটা ছাড়া,তারমানে নীপা সত্যিই রান্না করেছে বাইরে থেকে অর্ডার দিয়ে করা নয়।মুখ ভোতা করে ড্রয়িং রুমে এসে অন্যমনষ্ক হয়ে বসল,সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে হাতে একটা ছ্যাকাও খেলো।

    নীপা বের হবার সময় মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে শুভ কে বলল”আমাকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা দাও”শুভ হালকা হেসে মাথা কাইত করে শুভেচ্ছা বিনিময় করল। নীপার এতো হাসি পেল শুভর অবস্থা দেখে।

    সকালে নিজের মাথা ব্যথায় কাইত হয়ে যাওয়া আর এখন শুভর বিমর্শ কাইত হওয়াটায় ভয়াবহ মিল খুঁজে পেয়ে কেমন যেন একটা পৈশাচিক শান্তিতে ভরে গেল মনটা।

    রিক্সায় বসে ফাগুনের মিষ্টি বাতাস গায়ে লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নিল আর মনে মনে প্রযুক্তি এবং কিছু ট্যালেন্টেট স্টার্টআপ ওনলাইন বিজন্যাস ওমেনদের কে দিল গভীর ধন্যবাদ।আজকে “কুক ডাকো” এ্যাপটা ছিল বলেই ৩০ মিনিটের মধ্যে একজন অভিজ্ঞ কুক কে নীপা বাসায় ডাকতে পারলো এবং তার কাজকে সামলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রোগরামটাও এটেন্ড করার জন্য বের হতে পারলো।

    হঠাৎ কি জানি হলো নীপা চিৎকার দিয়ে বলে উঠল “আমরা নারী আমাই পারি শুভ নারী দিবস”।

    রিক্সাওয়ালা মামা কিছু না বুঝেই ফিক করে হেসে নীপার দিকে তাকিয়ে বলল আফা আপনারেও “শুভ নারী দিবস”

    এই নারী দিবসে সকলকে শুভেচ্ছা..এগিয়ে যাক সকল নারী,নিজেকে ভালোবাসতে হবে তাহলেই সম্ভব সব বাঁধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাওয়া।

    আমরা নিজেকে ভালোবাসবো,ভালো থাকবো এবং ভালো রাখবো।।

    লেখিকা: কথাসাহিত্যিক, গল্পকার

    আদনীন কুয়াশা
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close