• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ছাদ ধসে পড়া সেই স্কুলটির ঠিকাদার স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভাগিনা

প্রকাশ:  ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৫৩ | আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৫৮
বরগুনা প্রতিনিধি

বরগুনার তালতলী উপজেলার ছোটবগী ইউনিয়নের ৫নং ছোটবগী পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদের একাংশ ধসে প্রাণ হারায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মানসুরা।

জানা গেছে, ছাদ ধসে পড়া সেই স্কুলটির ঠিকাদার স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভাগিনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পিডিপি-২ প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) বাস্তবায়নে ২০০২ সালে একতলাবিশিষ্ট এ স্কুল ভবনটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০০৪ সালে ভবনটি হস্তান্তর করা হয়। ভবনটির দরপত্র আহ্বান করা হলে তৎকালীন সরকারদলীয় এক সংসদ সদস্যের (বরগুনা-২ আসনে সংসদ সদস্য আলহাজ মতিয়ার রহমান তালুকদার) ভাগিনা আবদুল্লাহ আল মামুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবীর উদ্দিন সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতু এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্সে দরপত্র জমা দিয়ে কাজটি পান।

পলেস্তারা খসে পড়ায় শ্রেণিকক্ষজুড়ে ছড়ানো ছিটানো বই। বেঞ্চগুলো এলোমেলো। শ্রেণিকক্ষেই পড়ে আছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যাগ-জুতা। সেই সঙ্গে ছাদ থেকে ধসে পড়া পাথরসম পলেস্তারা। একই শ্রেণিকক্ষজুড়ে রয়েছে সেই কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরই তাজা রক্তের দাগ। এ স্কুলেরই ছাদের একাংশ ধসে প্রাণ হারায় তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মানসুরা।

শনিবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে বরগুনার তালতলীর ৫নং পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের ছাদের একাংশ ধসে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মানসুরা নিহত হয়। আহত হয় আরও চার শিক্ষার্থী। নিহত মানসুরার বাবার নাম নজির হোসেন তালুকদার। তিনি পেশায় একজন কৃষক। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে মানসুরা ছোট। এ ঘটনায় আহতরা হলো সাদিয়া আক্তার, রুমা, ইসমাইল, এবং শাহিন। তারা তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী।

ঘটনার একদিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশে অভিযোগ করেনি কেউ। পরিবারের অনুরোধে ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহত ছাত্রীর মরদেহ দাফন করেছেন তার স্বজনরা। স্থানীয়দের অভিযোগ, দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারের স্কুল নির্মাণে নিম্নমান ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের উদাসীনতার কারণে শ্রেণিকক্ষেই নিভে গেছে একটি তরতাজা শিশুর প্রাণ।

অন্যদিকে ঘটনার তদন্তে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসন। দায়ীদের কঠোর শাস্তি নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী। এ ঘটনায় নিহত ছাত্রীর পরিবারকে এক কোটি টাকা ও আহতদের ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হাসান তারেক পলাশ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সংসদ সদস্য মামার প্রভাব বিস্তার করে অত্যন্ত নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ও কাজের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ফলে প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের অনেক আগেই ভবনটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। নিম্নমানের নির্মাণের কারণে ভবনটির সংস্কারকাজও কোনো কাজে আসেনি। এছাড়া স্কুলের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্তে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের গাফিলতির অভিযোগও তোলেন অনেকে।

সংশ্লিষ্ট ছোটবগী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৌফিক উজ জামান তনু (তিনি তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও) বলেন, নির্মাণে নিম্নমানের কারণে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ভবনের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভবনের ছাদের যে অংশ ধসে প্রাণহানি ঘটেছে, সেই অংশে ব্যবহৃত রডে ব্যাপক মরিচা ধরেছে। একাধিকবার ভবনটি সংস্কার করা হলেও তৎকালীন সংসদ সদস্যের ভাগিনা আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্মাণকাজে ব্যাপক অনিয়মের ফলে কোনো সংস্কারই কাজে আসেনি। ফলে মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে ভবনটি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ঘটনা নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ও ঠিকাদারদের দায়িত্বে অবহেলাকেই চিহ্নিত করে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে সেতু এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী কবীর উদ্দিন সেতু জানান, সেতু এন্টারপ্রাইজের মালিক তিনি। সংসদ সদস্যের ভাগিনা আবদুল্লাহ আল মামুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার লাইসেন্সের অনুকূলে মামুন ভবনটি নির্মাণ করেছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেতু এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে স্কুল ভবন নির্মাণকারী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ভবনটি ১৫ বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ভবনটি যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি বলে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানান, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি শিক্ষক ও অভিভাবকরা ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে মৌখিকভাবে উপজেলা শিক্ষা কমিটিকে অবহিত করেন। সাধারণত একটি স্কুল ভবনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় কমপক্ষে ৪০-৪৫ বছর। সেখানে মাত্র ১৫ বছরে একটি স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার পরও বিষয়টি কেউ আমলে নেয়নি বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিও) এম এম মিজান বলেন, স্কুল ভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। নিহত ওই শিক্ষার্থীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হবে বলেও জানান তিনি।

এ বিষয়ে বরগুনার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম কবীর বলেন, স্কুল ভবনটির গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য এলজিইডি কাজ করছে। এছাড়া স্কুল ভবনের ছাদ ধসে ছাত্রীর প্রাণহানির ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটিতেও তিনি রয়েছেন। তদন্তে নির্মাণকাজে অনিয়ম ও কারও দায়িত্ব অবহেলা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পিবিডি/জিএম

বরগুনা,তালতলী উপজেলা,ছাদ ধসে প্রাণ হারায়,তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close