• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ফেসবুকজুড়ে নুসরাত হত্যার প্রতিবাদ-নিন্দা, দ্রুত খুনিদের শাস্তি দাবি

প্রকাশ:  ১১ এপ্রিল ২০১৯, ০২:২৮
নিজস্ব প্রতিবেদক

যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদের কারণে গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছেন। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। অনেকে টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ দেখে হাউমাউ করে কেঁদেছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও দোষীদের ফাসি দাবী।

পাঁচ দিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন নুসরাত। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও শারীরিক অবস্থার কারণে তা সম্ভব হচ্ছিল না।

বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন।

তিনি আরও জানান, মৃত্যুর কারণ রক্ত ও ফুসফুসের মারাত্মক সংক্রমণ থেকে কার্ডিও রেসপিরেটরি ফেইলিয়র (হৃদযন্ত্রে ক্রিয়া বন্ধ) হয়। এতেই মৃত্যু হয় তার।

রাতে ফেসবুকজুড়ে একাধিক প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। দাবি একটাই, নুসরাতকে বাঁচানো যায়নি, বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

নারীবাদী লেখক সাদিয়া নাসরিন লিখছেন, আমার যা হয় হোক, তার যেনো বিচার হয়... কথাটার ওজন কি আমরা বুঝি ? আমরা কি বুঝতে পারছি যে এই কাজটা আমাদের করতে হবে? করবো আমরা? এতোটুকু এতোটা লড়াই একলা করতে করতে পুড়ে মরেছে মেয়েটি, বাকিটুকু আমরা পারবো না? পারবো না আমরা?’

ভিকারুন্নুনিসা নুন স্কুলের শিক্ষক সৈয়দা তানজিনা ইমাম লিখেছেন, নুসরাতরা চলে যায়। চলে গিয়ে বেঁচে যায়। যারা থেকে যায় তাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় বন্ধুর হন্তারক আর নিজের ধর্ষককে বাঁচানোর মিছিলে।

এই বিচারকাজের মনিটরিং এবং ফলোআপ থেকে আমরা যেন বিচ্যুত না হই উল্লেখ করে অ্যাক্টিভিস্ট শামীম আরা নীপা লিখেছেন, আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত... আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলবো, সারা পৃথিবীর কাছে বলবো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য, আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো...। নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে করতে...। সমগ্র দেশ জাতি ও জগতের কাছে রাফি দাবি রেখে গেছে...। সমাজের মানুষগুলোর মানুষ হওয়ার, মানুষ করার, মানুষ জন্ম দেওয়ার শেষ সময়টাও চলে যাচ্ছে– তাও ঘুমাচ্ছে প্রাণীগুলো...!

নুসরাত জাহান রাফির যৌন নির্যাতক মাওলানা সিরাজ এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি পিশাচের ফাঁসির দাবি জানাই...।’

বিচারের দাবি নিয়ে নাট্যকার মাসুম রেজা লিখেছেন, নুসরাতকে বাঁচানোর জন্যে সব ব্যবস্থা নিয়েছিলেন আপনারা...। তাকে বাঁচানো যায়নি...। এবার শুধু এই ব্যবস্থাটুকু করুন যাতে ইতিহাসের দ্রুততম সময়ে লোলুপ সিরাজুদ্দৌলাদের বিচার হয়...। নুসরাত জানতো, তার এই পরিণতি হতে পারে তারপরেও সে সিরাজুদ্দৌলাকে কঠিন শাস্তি দিতে চেয়েছিলো...। নুসরাত আত্মহত্যার পথ পরিহার করে আত্মদান করে গেলো... এ যেনো ভুলে না যাই...।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ লিখেছেন, আই ডিমান্ড জাস্টিস ফর নুসরাত।

অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ রহমান লিখেছেন, ৮০% পুড়ে যাওয়ার পরেও যেই মেয়ে বলে যে, সে চিৎকার করে সবাইকে বলবে, একটা “অন্যায়” হয়েছে, মরে গেলেও সেই মেয়ে একটা সাহসী মেয়ে, বাংলাদেশে নিরাপত্তাহীন লাখ লাখ নারীর জন্য নুসরাত সাহস।

মেয়ে তুমি মরে যাও, তবু চিৎকার করে মরো। তুমি চিৎকার করেছ দেখেই সোনাগাজির দুইশ’ কিলোমিটার দূরে আমরা চিৎকার করেছি।

‘নুসরাত দেখিয়ে দিলো অবস্থা হয়তো আরও দুইশ’ বছরেও পরিবর্তন হবে না, কিন্তু চিৎকার করাটা জরুরি।

‘আমি আমৃত্যু একটা হত্যার বিচারের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেবো বলে পণ করেছিলাম। সেই লিস্টটা দুজনের হলো। ২৬/২/২০১৫ ও ১১/৪/২০১৯।’ এমডি হানিফ লিখেছেন, আগুনে দগ্ধ মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত রাত ৯.৩০ মিনিটে মারা গেছে ইন্নালিল্লাহি ওয়া লিল্লাহি রাজিউন নুসরাতের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি আল্লাহ যেন নুসরাত কে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন আমিন। পাশাপাশি নুসরাত হত্যার জড়িত খুনিদের দ্রæত বিচারের আওতায় এনে ফাঁসিতে ঝুলানোর জোর দাবী জানাই ।

কামাল উদ্দিন লিখেছেন, আল্লাহ এই বোনকে শহীদের মর্যাদা দিও। এই হত্যার সাথে জড়িত কুলাংগার সোনার ছেলেদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি চাই।

বরেণ্য লেখক স্বকৃত নোমান লিখেছেন, মধ্যযুগীয় বর্বরতা। কথাটি প্রায়ই শোনা যায়। মধ্যযুগ কাহাকে বলে? কত সাল থেকে কত সাল? মধ্যযুগের বর্বরতার ধরণ কেমন ছিল? আমার মতো মনে হয় বর্তমানের চেয়ে মধ্যযুগ অনেক ভালো ছিল। আমরা বর্তমানকে অস্বীকার করি। বর্তমানের বর্বরতাকে ঢাকতে মধ্যযুগের তুলনা দেই। একটা মেয়েকে শিক্ষক নামধারী বদমাশ আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলল। এরপর আর মধ্যযুগীয় বর্বরতা কথাটা চলতে পারে না। বিদায় নুসরাত জাহান রাফি। এই সমাজ তোমাকে বাঁচতে দিল না। মাননীয় সরকার, ওই মাদ্রাসা বন্ধ করে দিন। এমপিওভুক্তি বাতিল করুন। মাদ্রাসা নামক এই জল্লাদ খানায় আর বিদ্যাশিক্ষা চলতে পারে না। গড়ে তুলুন নষ্ট সমাজ, নষ্ট মানুষের হাতে বলি হওয়া নুসরাত জাহান রাফির নামে অন্য কোনো বিদ্যাপীঠ, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান। দানব সিরাজ উদদৌলার শাস্তি চাই। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। হত্যার বদলে হত্যা। হত্যাকারীর ক্ষমা নাই।

নুসরাতের মামলার আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু লিখেছেন, ফেনীর কৃতি সন্তান নুসরাত জাহান রাফি আর নেই। ইন্নালিল্লাহ। তার আত্বার মাগফেরাত কামনা করছি ও পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আইনজীবী হিসেবে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাব এই প্রতিজ্ঞা করছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

প্রসঙ্গত, গত ২৭ মার্চ মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে রাফিকে যৌন হয়রানি করেন। এ অভিযোগে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করতে রাজি না হওয়ায় তার এ করুণ পরিণতি বলে জানা যায়। এদিকে রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সোমবার রাতে এজাহারে অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা সহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। অন্য আসামীরা হলেন পৌর কাউন্সিলর মাকসুল আলম, প্রভাষক আবছার উদ্দিন, মাদরাসা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম, সাবেক ছাত্র নূর উদ্দিন, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহম্মদ ও হাফেজ আবদুল কাদের। ইতিমধ্যে ওই মামলার তিন আসামী সহ অন্তত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা সহ ৭ জনকে রিমান্ড দিয়েছে আদালত। এছাড়া তাকে ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ থেকেও সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। কর্তব্য অবহেলার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো. মোয়াজ্জেম হোসেনকেও প্রত্যাহার করা হয়। মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

রাফির উপর বর্বরোচিত এ হামলার প্রতিবাদে গত ক’দিন ধরে ফেনী ও সোনাগাজীতে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে রাফি তার দুই বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে সে ওই ঘটনার জন্য অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাকে দায়ি করেছে। গ্রেফতার সিরাজ উদদৌলার মুক্তি দাবী করায় তার সহপাঠিদের উপরও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। রাফি উত্তর চর ছান্দিয়া গ্রামের মাওলানা একে এম মুসার একমাত্র মেয়ে । তিনিও পেশায় একজন শিক্ষক ।

পিবিডি/জিএম

নুসরাত জাহান রাফি,ঢাকা মেডিকেল কলেজ,বার্ন ইউনিট
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close