লালমনিরহাট-২(কালীগঞ্জ-আদিতমারী)
আ. লীগ, বিএনপি, ও জাতীয় পার্টির ভিন্ন কৌশল
লালমনিরহাট-২ সংসদীয় আসন কালীগঞ্জ ও আদিতমারী উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনটি দীর্ঘ সময় ধরে জাপা’র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত এম,পি মজিবুর রহমানের দখলে ছিলো। তবে এই আসনটি দখলে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আ’লীগ। এদিকে জাপা চাইছে তাদের হারানো আসনটি নতুন করে ফিরে পেতে। ভোটে জিততে চায় অভ্যান্তরিন দ্বন্দে ডুবে থাকা প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
জাপা’র কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সমাজ কল্যান বিষয়ক সম্পাদক রোকন উদ্দিন বাবুল এ আসনে জাপা’র একক প্রার্থী। বর্তমান সাংসদ ও সমাজকল্যান প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও আদিতমারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজুল হক এই দুজন ক্ষমতাসীন দল আ‘লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশায় রয়েছেন। তবে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই বলছেন বা মনে করেন এই দু‘জনের মধ্যে সব দিক থেকে এগিয়ে আছেন প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ।
সম্পর্কিত খবর
এদিকে সাবেক সাংসদ সালেহ উদ্দিন আহম্মেদ হেলাল বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে সাবেক উপমন্ত্রী, কেন্দ্রিয় নেতা ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুকে এ আসনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন দলের একটি অংশ। তারা মনে করেন এ আসনে দুলু নির্বাচন করলে নির্বাচনে জয় লাভ করতে পারবে।
জানা যায়, দুই উপজেলার ৮টি করে মোট ১৬টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত লালমনিরহাট-২ আসন(কালীগঞ্জ-আদিতমারী)। দীর্ঘ সময় ধরে জাপা’র প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত মজিবুর রহমানের দখলে থাকা এ আসনে তিনি সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও মনোনয়ন কিনলেও শেষ পর্যন্ত জমা দেননি তিনি। ফলে আ’লীগের একমাত্র মনোনীত প্রার্থী নুরুজ্জামান আহমেদ বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় নির্বাচিত হন। তবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ ভালো ভাবেই নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন তিনি। এছাড়া বর্তমান সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সুবাধে উন্নয়ন মুলক বিভিন্ন কর্মকান্ডের জন্য জণগনের কাছে বেশ আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন।
নুরুজ্জামান আহমেদের বাড়ি জেলার কালীঞ্জ উপজেলায়। তাঁর বাবা প্রয়াত করিম উদ্দিন আহমেদ ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে আসা নুরুজ্জামান আহমেদ লেখাপড়া শেষ করে বেশ কয়েকবার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিবার্চিত হন। এরপর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন দুই বার। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আ.লীগের দলীয় টিকেট পেয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাপার তৎকালীন প্রার্থী ও আদিতমারীর বাসিন্দা প্রায়ত মজিবুর রহমানের কাছে হেরে যান তিনি। ২০০১ সালেও আ‘লীগের দলীয় টিকেট পান নুরুজ্জামান আহমেদ। কিন্তু ঋণ খেলাপীর অভিযোগে প্রথমে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়। ফলে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়া হয় ওই সময়ের জোটের গণফোরামের প্রার্থীর কাছে। পরে ভোট গ্রহনের কয়েকদিন আগে উচ্চ আদালত নুরুজ্জামানকে বৈধপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয়। তাই এলাকার জনগণের চাপে তাঁকে ওই সময় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই নির্বাচনের মাঠে নামতে হয়। মাত্র এক সপ্তাহের জন্য ভোট যুদ্ধে নেমে সামান্য ব্যবধানে হেরে যান নুরুজ্জামান আহমেদ। এতে তাঁর ৫৭ হাজার ২৫৩ ভোটের বিপরীতে ৬০ হাজারের কিছু বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন মজিবুর রহমান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মহাজোটের শরীক হিসেবে জাপার মজিবুর রহমানকে আসনটি ছেড়ে দেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে নুরুজ্জামান আহমেদ দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় নির্বাচিত হন। এরপর প্রথমে খাদ্য প্রতিমন্ত্রী ও পরে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান নুরুজ্জামান আহমেদ। মন্ত্রী হওয়ার সুবাধে উন্নয়ন বঞ্চিত কালীগঞ্জে তিনি বিভিন্ন ধরণের প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাটসহ দরিদ্রদের জন্য নানা ধরণের কাজ করে যাচ্ছেন। একই ভাবে অপর উপজেলা আদিতমারীতেও দল গোছানোর পাশাপাশি নানা উন্নয়ন মূলক কাজ চালিয়ে চালাচ্ছেন তিনি। ফলে এ আসনে নুরুজ্জামান আহমেদেই সব দিক থেকে এগিয়ে আছেন বলে মনে করেন অনেকেই।
লালমনিরহাট-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও সমাজকল্যান প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ বলেন, নির্বাচন নিয়ে নতুন করে তার আর কিছু বলার নাই। দলীয় মনোনয়নই নয় জোটগতভাবেও নিবার্চন হলে তিনি মনোয়ন পাবেন বলে বিশ্বাস করেন।
তবে তাঁর পাশাপাশি আদিতমারী উপজেলা পরিষদের দুই বারের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আ.লীগের সিনিয়র সহ সভাপতি সিরাজুল হকও গত কয়েক বারের মত আগামি সংসদ নিবার্চনেও মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েও বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে গিয়ে তৃতীয় অবস্থানে যান তিনি।
সিরাজুল হক বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের জন্য আবেদন করবেন। তবে দল যে সিদ্ধান্ত দিবেন, তাই মেনে নিবেন তিনি বলে জানান’। এদিকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জাতীয়পার্টির দখলে থাকা লালমনিরহাট-২ আসনটি পূরুরুদ্ধারের চেষ্ঠা করছে দলটি। কয়েক বছর আগে কালীগঞ্জের চাপারহাটে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় জাতীয়পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ লালমনিরহাট-২ আসনে দলের প্রার্থী হিসেবে রোকন উদ্দিন বাবুলকে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে একাদশ সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে তখন থেকেই দল গোছানোর কাজে নেমেছেন বাবুল। নেতাকর্মীদের সাথে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন তিনি। কালীগঞ্জের পাশাপশি আদিতমারীতেও সমান তালে দলীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করছেন। ইতোমধ্যেই দুই উপজেলার ওয়ার্ড-ইউনিয়ন কমিটিগুলো নতুন করে গঠন হওয়ায় চাঙ্গা হয়ে উঠছে এখানকার জাতীয়পার্টি। ফলে আগামি নিবার্চনে এই আসনটি পূনরুদ্ধারে জাতীয়পার্টি ‘সক্ষম’ হবে বলেও মনে করেন বাবুল অনূসারীরা। বর্তমানে লালমনিরহাট-২ আসনে জাতীয়পার্টির একক প্রার্থী হিসেবে তিনি যেভাবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, তাতে করে বাবুলকে দিয়েই হারানো আসন পুনরুদ্ধার ‘সম্ভব’ বলে মনে করেন এখানকার জাতীয়পার্টির নেতাকর্মীরা।
জানতে চাইলে রোকন উদ্দিন বাবুল বলেন, ‘এই আসনটি দির্ঘদিন ধরেই জাতীয়পার্টির ছিল। এখনো এখানকার মানুষজন জাতীয়পার্টির সাথে আছে। তাই আগামি নিবার্চনে জয়ের লক্ষেই জাতীয়পার্টি কাজ করে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।”
এদিকে লালমনিরহাট- ২ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক সা. সম্পাদক সালেহ উদ্দিন আহমেদ হেলাল অন্যান্য বারের মতো এবারও এই আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পেতে কাজ করে যাচ্ছেন । ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে তিনি এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আগামি নিবার্চনে তিনি আবারও বিএনপির মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে মনে করেন অনেকেই। কিন্তু সম্প্রতি কালীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এখানকার নেতাকর্মীরা। আর তাদেরই একটি অংশ সাবেক উপমন্ত্রী ও লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলুকে এখানে দলীয় প্রার্থী হিসেবে পেতে চাইছেন। দুলু লালমনিরহাটের রাজনীতিতে ব্যাপক জনপ্রিয় নেতা। এর পাশাপাশি তিনি কেন্দ্রিয় কমিটির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা সালেহ উদ্দিন আহমেদ হেলাল বলেন ‘আমি যুগ যুগ ধরে এ আসনের মানুষের সাথে আছি, তাদের জন্য কাজ করছি। আগামি নিবার্চনেও আমি আবারও দলীয় মনোনয়ন পাবো বলে বিশ্বাস করি। আর নিবার্চনী মাঠে নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবেই তার পক্ষে কাজ করবেন বলে মনে করেন তিনি।’
তবে কালীঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও চন্দ্রপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমও বিএনপির মনোনয়ন চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। জাহাঙ্গীর জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলুর অনূসারী হিসেবে পরিচিত। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে হেরে যান তিনি।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নেতাকর্মীরা জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু ভাইকে এ আসনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইছেন। তবে তিনি যদি না চান তাহলে আমি মনোনয়ন চাইবো বলে উল্লেখ করেন উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর আলম।
/সাজ্জাদ