টঙ্গীতে আসন্ন বিশ্ব ইজতেমায় ভারতের মাওলানা মুহাম্মদ সাদ কান্ধলভির আগমন ঠেকাতে মাঠে নেমেছেন হেফাজতপন্থী কওমি আলেমরা। শনিবার (৬ জানুয়ারি) সকালে রাজধানীর উত্তরায় অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় এই ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে শিগগিরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তাবলিগ নেতা ও কওমিপন্থী আলেমরা।প্রসঙ্গত, এর আগে গত বছরের শেষের দিকেও তাবলিগের দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের (মূল কেন্দ্র) মাওলানা সা’দ কান্ধলভির বাংলাদেশে আসা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বের জেরে গত ১৪ নভেম্বর রাজধানীর কাকরাইল মসজিদে হাতাহাতিসহ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
সম্পর্কিত খবর
সংগঠনটির একজন মুরব্বির বলেন, বিশ্বজুড়ে তাবলিগ জামাতের মারকাজ দিল্লির নিজামুদ্দিনে অবস্থিত। যা ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ নামে পরিচিত। ওই মারকাজের শীর্ষ মুরব্বি মাওলানা সা’দ কান্ধলভির বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বক্তব্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ওই সময় মাওলানা সা’দ আলেমদের অর্থের বিনিময়ে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার বিরোধিতা করে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এছাড়া ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল পকেটে রেখে নামাজ হয় না বলেও মন্তব্য করেছিলেন। তখন তার ওই বক্তব্য সমালোচনার মুখে পড়ে। এ ঘটনায় ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ও মাওলানা সা’দ কান্ধলভির বক্তব্যের প্রতিবাদ করে। এমনকি দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানিসহ শীর্ষ আলেমরা বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানান। তখন ‘চাপে পড়ে’ মাওলানা সা’দ তার বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন।এই প্রসঙ্গে তাবলিগের একজন মুরব্বি বলেন, গত বছরের ২৯ অক্টোবর তাবলিগের চলমান সংকট ইস্যুতে আলেম প্রতিনিধি দলের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, দিল্লির নিজামুদ্দিনে বিভক্ত গ্রুপের মধ্যে ঐক্য ছাড়া কোনও একপক্ষ বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে আসতে পারবে না। ১৬ নভেম্বর তাবলিগ জামাতের অস্থিরতা নিরসনে কাকরাইল মারকাজের শুরার ১০ সদস্য ও কওমি আলেমদের ৫ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংকট নিরসনে ৫টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ৫ জন কওমি আলেমকে তাবলিগ জামাতের পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবেও মনোনীত করা হয়।স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশ থেকে আলেমদের একটি প্রতিনিধি দল গত বছর ২৪ ডিসেম্বর দারুল উলুম দেওবন্দ ও নিজামুদ্দিন সফর করে। প্রতিনিধি দলটি ফিরে আসার পর স্বারাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পুনরায় বৈঠকের আগে পরামর্শের জন্য উত্তরায় শনিবার (৬ জানুয়ারি) এ সভার আয়োজন করা হয়। এদিন উত্তরায় দেশের বিভিন্ন স্থানের কওমি আলেম ও তাবলিগের সহস্রাধিক সাথী উপস্থিত ছিলেন। মুফতি মাসউদুল কারীমের সভাপতিত্বে পরামর্শ সভায় বক্তব্য রাখেন, কওমিপন্থী আলেম ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী, বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক, মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ, হেফাজত নেতা মাওলানা জুনায়েদ আল-হাবীব, মুফতি কিফায়াতুল্লাহ, মিজানুর রহমান, মাওলানা বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, মাওলানা আব্দুল কদ্দুস, মাওলানা শিব্বির আহমদ, হেফাজত আমিরের ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী, মাওলানা হাফেজ নাজমুল হাসান, মুফতি কিফায়াতুল্লাহ আযহারী, তাবলিগের সাথী ড. আজগর, মাওলানা রাইয়ান, মাওলানা শামীম ওসমান, মুফতি আব্দুল মুকিত, মাওলান আনিসুর রহমান প্রমুখ।সভায় হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফী’র লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তার ছেলে মাওলানা আনাস মাদানী। লিখিত বক্তব্যে আহমদ শফী বলেন, ‘মাওলানা সা’দের মতো বিতর্কিত ব্যক্তিকে কোনোভাবেই ইজতেমায় আসতে দেওয়া উচিত হবে না। কোনও শর্তে যদি বিশ্ব ইজতেমায় তাকে আসার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের দ্বিনি কাজের যেমন বিশাল ক্ষতি হবে, তেমনি দেশের পরিবেশও বিনষ্ট হবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। তাই জাতির কর্ণধার উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের প্রতি আহ্বান, আপনারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী এই মেহনতের সুরক্ষায় শান্তিপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।’সভায় দু’টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত দু’টির প্রথমটি হলো: ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের অনাস্থা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ মাওলানা সা’দের প্রতি অনাস্থা জানানো; দ্বিতীয়ত, বিশ্ব ইজতেমায় মাওলানা সা’দ ও মাওলানা ইব্রাহীম দেওলার দু’টি গ্রুপ একসঙ্গে আসতে হবে। কোনও একটি গ্রুপ এককভাবে বাংলাদেশে আসতে পারবে না। এই দু’টি বিষয়ের সুরাহা হওয়ার আগে মাওলানা সা’দকে বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না বলেও সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।কওমিপন্থী আলেম ও ঢাকা মহানগর হেফাজতের সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, আল্লামা আহমদ শফীর নির্দেশনার সঙ্গে আমরা সবাই সম্পূর্ণ একমত। তাবলিগ জামাতে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন না হয়, সে জন্য তাবলিগকর্মী ও আলেমদের সতর্ক থাকতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মাওলানা সা’দকে কেন্দ্র করে দেশে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন সৃষ্টি না হয়, সে লক্ষ্যে সরকারকেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।জানতে চাইলে তালিগের সাথী শাহরিয়ার মাহমুদ বলেন, শুধু মাওলানা সা’দের জন্য তাবলিগের মতো বিশাল এক ধর্মীয় খিদমতকে কোনোভাবেই কলুষিত করতে দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের সঙ্গে বাংলাদেশের আলেমরা দৃঢ়ভাবে একমত পোষণ করে সজাগ ও সতর্ক আছেন। যেকোনও ধরনের উসকানিমূলক অপতৎপরতা প্রতিহত করে দিতেও তৌহিদি জনতা পিছপা হবে না।উল্লেখ্য, এই বছর ১২ জানুয়ারি ও ১৯ জানুয়ারি দুই দফায় তিন দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দফায় ১৪ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় দফায় ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন