• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সাগর-রুনি হত্যার ৭ বছর

অক্ষমতা ঢাকি স্মৃতিচারণে

প্রকাশ:  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:২৭ | আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২০:১৭
বিপুল হাসান

মেহেরুন রুনীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। এই বন্ধুত্ব ছিল শতভাগ পেশাকেন্দ্রিক, তবে স্মৃতিগুলো ব্যক্তিগত। সাগর সরওয়ার ভাইয়ের সঙ্গেও পরিচয় ছিল। দাম্পত্যজীবন শুরুর আগেই দুজনকে চিনি। সাত বছর আগে খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যার কোনো সুরাহা হয়নি। আর বিচার...? আদালতে মামলার চার্জশিট জমা পড়েনি। শনাক্তই করা যায়নি খুনি কে বা কারা! রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার চেয়েও বেশি দায় আমাদের সাংবাদিকদেরই। সাগর-রুনি খুন হওয়ার দিন এলে প্রতিবারই কিছু স্মৃতি মনে পড়ে। নিজের একান্ত অপরাধবোধ থেকে... আমাদের অক্ষমতার বেদনা থেকে এসব স্মৃতি মুছতে পারি না।

মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনী দুজনই যে আমার দীর্ঘপরিচিত সেটা আগেই বলেছি। সাগর ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা অবশ্য তেমন ঘণিষ্ঠ ছিল না। তিনি কয়েক বছরের সিনিয়র ছিলেন। দেখাসাক্ষাৎ হলে 'হাই-হ্যালো' হতো। তবে মেহেরুন রুনীর সাথে সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের।

ছবিতে হলুদ পোশাকের মেয়েটি মেহেরুন রুনী। আমরা তখন সবে ক্যারিয়ার শুরু করি। কালচারাল জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (সিজেএফবি) প্রতিষ্ঠা করেছিলাম আমরা। সেই ২০০০ সালের ছবি। ১৯ বছর আগে হোটেল পূর্বানীতে সিজেএফবির প্রথম কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানের ছবি এটি। দুই পত্রিকাতে চাকরি করলেও একই বিটে কাজ করায় একসময় রুনীর সঙ্গে সপ্তাহে দু-চারবার দেখা-সাক্ষাৎ হত। রুনী কাজ করতেন যুগান্তরে, আমি মানবজমিনে।

কোনো প্রেস কনফারেন্স বা প্রোগ্রাম কাভার করে একসঙ্গে কথা বলতে বলতে কিছু পথ হেটে যার যার অফিসের দিকে চলে গেছি কতো দিন কতোবার। কথায় ব্যবহারে প্রাণবন্ত রুনীকে আচরণে স্বভাবে সবসময় দেখেছি বেশ রক্ষণশীল। পরে সে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে চলে যাওয়ায় দূরত্ব তৈরি হয়। পেশাগত বন্ধুত্বের বেলায় এমনটাই হয়ে থাকে। তবুও মাসে-ছয় মাসে রুনীর সঙ্গে কথা হত, যোগাযোগ ছিল।

২০১২ সালে ঈদের আগে, অর্থাৎ মেহেরুন রুনী খুন হওয়ার মাস তিনেক আগের ঘটনা। তারকাদের ঈদ ফ্যাশন কাভার করার কাজে রুনী যোগাযোগ করেছিল আমার সঙ্গে। সহযোগিতা চেয়েছিল। আমি কয়েকটা ফোন নম্বর কেবল দিয়েছিলাম তাকে। রুনী বলেছিল, সেলিব্রিটিদের সঙ্গে তো তোমার অনেক ভালো সম্পর্ক। একটু যদি যোগাযোগ করিয়ে দিতে। তাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম, দেবো। পরে তিন-চারদিন বেশ কবার রুনী ফোন দিয়েছিল, আমি রিসিভ করি নি। ঈদের আগে আমিও ছিলাম ব্যাপক ফাপড়ে। নিজের কাজ নিয়েই এতো ব্যস্ত, পরের ঝামেলা এড়াতে চেয়েছিলাম ওইসময়। একজনকে কতবার ফোন দেয়া যায়, রুনীও ধৈর্য্য হারায়! এরপর কোনেদিন সে আমাকে আর কল দেয়নি।

সাগর-রুনী খুন হওয়ার পর নিজেকে দুনিয়ার শীর্ষ স্বার্থপরদের তালিকায় আবিষ্কার করি। নিজের কাছেই নিজেকে আমার বড় অপরাধী মনে হয়। সেই অনুতাপ নিভেনি, এখনও জ্বলছে ধিকি ধিকি।

অবশ্যই অপরাধী আমি। প্রথমত, রুনীকে সামান্য একটা কাজে সহযোগিতা করিনি। তাকে এড়িয়ে নিজের কাজেই ডুবে থেকেছি। দ্বিতীয়ত, রুনী খুন হওয়ার পর যে জারজের বাচ্চারা যখন আমার বন্ধুর গায়ে কালি ছুয়ে দিতে চেয়েছিল তাদের মুখগহ্বরে আমি বালি ছুড়ে দিতে পারিনি, সাহস হয়নি এবং সর্বতো, কথিত 'জাতির বিবেক' নামধারি এমনই অথর্ব নপুংশক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত আমরা যে আপন ভাই, আপন বোন হত্যার বিচারের নিশ্চয়তা রাষ্ট্রের কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি, খুনি শনাক্তে প্রশাসনকে চাপে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি। গত সাত বছরে তিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিকলাঙ্গ আশ্বাসে গদ গদ হয়ে বগলবাজানোতেই খুজে পেয়েছি স্বার্থকতা।

এইসব গ্লানি হৃদপিণ্ডকে বড় বেশি খামচায় রুনী-সাগরের প্রাণ কেড়ে নেয়ার দিন এলে ওদের উদ্দেশে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সব সাংবাদিককে তবে কী বলে যেতে হবে ক্ষম... ক্ষম অপরাধ...!

লেখক: পূর্বপশ্চিমবিডি নিউজের বার্তা প্রধান

সাগর-রুনি,সাগরু-রুনি হত্যা,বিপুল হাসান
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close