• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

‘ভাতা নয়, চাই ভাষা সৈনিক হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা’

প্রকাশ:  ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:১০ | আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০১:১৪
সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর

মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে মর্যাদা দেওযা হয ,সেভাবে ভাষা সৈনিকদের মর্যাদা দেওয়া না। ২১শে ফেব্রুয়ারীর ছাড়া রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও কেউ আর খবর নেয় না। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করলাম, বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাও করলাম। জীবিত থাকতেই আর কেউ খবর নেয় না।

সম্পর্কিত খবর

    ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ২০-২১ বছরের টগবগে যুবক এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়া ৮৭ বছর বয়সী এ্যাডভোকেট মোতালেব হোসেন দুঃখ করে এসব কথা বলছিলেন।

    আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী, ভাষা আন্দোলনে জীবনদানকারী শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে পুষ্প অর্পন হচ্ছে। অথচ জীবিত ভাষা সৈনিকের কেউ খবর নেয় না। নতুন প্রজন্মের জন্য ভাষা সৈনিকদের তালিকা তৈরি করা অবশ্যই উচিত বলে মনে করে ভাষা সৈনিক মোতালেব হোসেন। তিনি বলেন, যারা মারা গেছেন এবং যারা জীবিত আছেন তাদের তালিকাভুক্ত করে শহীদ মিনারের পাশে ম্যুরাল তৈরী করে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা।

    বিভিন্ন রোগে জর্জরিত দিনাজপুরের জীবিত একমাত্র ভাষা সৈনিক মোতালেব হোসেনের অভিযোগ, কেউ তার খবর নেয় না। কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আর কেউ আর ডাকার প্রয়োজনও মনে করে না।

    তিনি বলেন, আমি চাই ভাষা সৈনিকদের পুরস্কৃত করা হোক। জেলার বা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যে সমস্ত ভাষা সৈনিক রয়েছেন তাদের খুঁজে বের করে মূল্যায়ন করা উচিত। যে সব জেলায় ভাষা সৈনিক আছেন তাদেরকে একুশে ফেব্রুযারি উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে আমন্ত্রণ করা। ভাষা সৈনিক মারা গেলে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে দাফনের ব্যবস্থা করা হোক।

    ভাষা সৈনিক এ্যাড. আব্দুল মোতালেব হোসেন বলেন, ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা এসে উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একত্রিত হয়ে তার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে গুলি বর্ষণে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ,সফিউল মারা যাওয়ার সংবাদ বিবিসির মাধ্যমে সারা দেশে জড়িয়ে পড়ে। তখন আমি দিনাজপুর এস এন কলেজের (বর্তমান দিনাজপুর সরকারী কলেজ) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। খবর শোনার সাথে সাথে আমার নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসান উদ্দীন, হাফিজ উদ্দীন, দলিল উদ্দীন, রফিক চৌধুরীসহ ৩০ জনের মিছিল বের করি।

    তিনি বলেন, আমাদের আন্দোলনের উত্তাপ দিনাজপুরে জেলার বিভিন্ন শহর গ্রামে জড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করার অভিযোগে আমিসহ আমার ৬ বন্ধুকে পুলিশ আটক করে। আমাদের ৬ মাস জেলাখানায় রাখা হয়। আমরা জেলখানা থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন করি কিন্তু আমাদেরকে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। ৬ মাস পর জেল থেকে ছাড়া পাই। জেল থেকে বের হয়েই সর্ব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সেই কমিটির আমাকে আহবায়ক করা হয়।

    মোতালেব হোসেন বলেন, কমিটি গঠনের পর ভাষা আন্দোলন আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। এর উত্তাপ বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রামগঞ্জে কৃষক মজুর, শ্রমিকেরা আমাদের সাথে একাত্ততা ঘোষণা করে এবং আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলন কমিটি গঠিত হয়। দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলন দিন দিন শক্তিশালী হতে থাকে। দিনাজপুর শহর থেকে গ্রামগঞ্জে একই তালে ভাষা আন্দোলন চলতে থাকে। বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের খবরাখবর আমার নিকট আসতে থাকে।

    তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনের নতুন কমিটি গঠনের জন্য বাড়ি থেকে বের হলে পুলিশ আমাকে ১৯৫৩ এইচএসসি পরীক্ষার আগে আবারও গ্রেফতার করে। জেলখানা থেকে আবারও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য আবেদন করি। কিন্তু সেবারও অনুমতি দেয়নি। আমার জীবন থেকে আবারও একটি বছর হারিয়ে যায়। সেবারও ৬ মাস পর জেলখানা থেকে ছাড়া পাই। জেল থেকে বের হওয়ার পরও আমি দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় ভাষা আন্দোলনকারী কমিটির সাথে যোগাযোগ করি এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করি।

    ১৯৫৪ সালে এইচএসসি অংশগ্রহন করি এবং পাশ করি। পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে দিনাজপুরের এস,এন কলেজে বিএ পরীক্ষায় অংশগ্রহন করি এবং পাশ করি । ১৯৫৭ সালে পাকিস্থান সরকার অলিখিত ভাবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরবর্তীতে আমি রাজশাহীর আইন কলেজে আইনে উপর ভর্তি হই । ১৯৫৯ সালে ল’ পাশ করি- যোগ করেন তিনি।

    এ্যাড. আব্দুল মোতালেব হোসেন বলেন, সেই বছরই পাকিস্থানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয্যুব খান সরকার মার্শাল ল জারি করেন এবং পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করার জন্য বিভিন্ন স্থানে খুঁজতে থাকে। আমি গ্রেফতার এড়াতে বাড়ি থেকে পালিয়ে পঞ্চগড়ে গিয়ে এক বাড়িতে গিয়ে লজিং মাস্টার হিসাবে থাকি। ৬ মাস পর মার্শাল অর্ডিন্যান্স শিথিল হলে আবারও দিনাজপুরে ফিরে আসি। তখন থেকেই দিনাজপুর জজ কোর্টে আইন প্র্যাকটিস করি। ১৯৬৬ সালের আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালে পকিস্থান বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় আন্দোলনে যোগদান করি।

    দিনাজপুর শহরের পাহাড়পুর ইকবাল স্কুল মোড় রয়েল স্কুলের দ্বিতীয় তলায় ভাষা সৈনিক এ্যাড. মোতালেব হোসেনের বাসা। বয়সের ভারে বাসা থেকে বের হতে পারেন না। তবে নিজে নিজেই চলাফেরা করতে পারেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারী ভাষা সৈনিকের বাসায় গিয়ে দেখা যায় নামাজ আর বিভিন্ন বই পড়ে সময় কাটাচ্ছেন। স্ত্রী দিনাজপুর জিলা স্কুলে (অবসর প্রাপ্ত) শামসু নাহার বেগমকে নিয়েই রয়েছেন। তবে স্ত্রী শামসুন নাহার বেগম অসুস্থ বিছানায় শুয়ে আছেন। বাসায় কাজের লোক ছাড়া তেমন কেউ নেই। একমাত্র ছেলে ১৯৯৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে জীবিত থাকলেও তার স্বামীকে নিয়ে অমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন। ২০১৬ সালে ৬ মার্চ সৈয়দপুর থেকে বাড়িতে আসার পথে ছেলের স্ত্রী অর্থাৎ বৌমাও সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। একমাত্র ছেলের ঘরের নাতনিকে নিয়ে বেঁচে আছেন ভাষা সৈনিক এ্যাড. মোতালেব হোসেন। তবে নাতনি এখন একটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকতা হওয়া দাদা দাদিকে ছেড়ে চাকরির জন্য বাইরে থাকেন।

    ১৯৩২ সালের পহেলা ফেব্রয়ারী দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলাধীন মোত্তারপুর মৌজার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে ভাষা সৈনিক আব্দুল মোতালেব হোসেনের জম্ম। বাবা নাছির উদ্দীন ও মাতা সালেহা খাতুনের ৬ সন্তানের মধ্যে জেষ্ঠ সন্তান আব্দুল মোতালেব হোসেন। বাল্যকাল গ্রামের বাড়ী ফুলবাড়ীর ডাঙ্গাপাড়া গ্রামেই বেড়ে উঠেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহন করে গ্রামের খয়েরবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (পরবর্তীতে জাতীয়করন করা হয় )। মাধ্যমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন ফুলবাড়ীর সুজাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। ম্যালেরিয়া জ্বরের কারণে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করতে পারেননি। ১৯৫০ সালে অবিভক্ত ভারতের কালিয়াগঞ্জ হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুশেন পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। সেই সালেও তিনি ৫টি বিষয়ে পরীক্ষায় দিতে না পারায় রেজাল্ট স্থগিত হয় । ১৯৫১ সালে পরবতীতে রাজশাহীর একটি বিদ্যালয় থেকে সেই ৫টি বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাশ করেন।

    ভাষা সৈনিক এ্যাড. মোতালেব হোসেন জানালেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। তিনি কোন সম্মানি বা ভাতা চান না। তবে তিনি চান ভাষা সৈনিক হিসাবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। তিনি চান, যারা ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের একটা তালিকা তৈরি করুক সরকার। মৃত্যুর পর যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমায়িত করা হয়। কারণ আর ১ দশক পর হয়তো দেশের মানুষের কাছে ভাষা সৈনিকেরা গত হবে যাবেন।

    তার অভিযোগ, সরকারী কিংবা বেসরকারী কোন অনুষ্ঠানেই তাদেরকে ডাকা হয় না। সরকারীভাবে গঠিত ২১শে ফেব্রুয়ারী উদযাপন কমিটিতেও তাদের নাম রাখা হয় না। তারা চান সর্ব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন ও ব্যবহার। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার না হওয়ার কোন কারণ তাদের জানা নেই। তারা উচ্চ আদালতে বাংলার ব্যবহার দাবি করেন।

    /পিবিডি/একে

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close