অগ্নিকাণ্ডের হতাহতের ঘটনায় দায়ীদের বিচার হয় না
দেশে বিভিন্ন সময় সংঘঠিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখো গেছে, এসব জান-মাল হারালেও চিহ্নিত দায়ীরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এবং এসব ঘটনায় হতাহতদের সুনির্দিষ্ট রেকর্ড পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন গত দুই দশকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও খুব সহজেই তারা জামিনে মুক্তি পান। এরপর ঘটনার স্বাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে ওই মামলা বছরের পর বছর সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়ে যায়।
স্মরণকালে দেশের সবচেয়ে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ৩ জুন ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলীতে। ভয়াবহ ওেই অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ১২৪ জন। দগ্ধ হয় দুই শতাধিক লোক। ওই ঘটনায় দায়িদের সনাক্ত করতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তারা কাউকে দোষী করতে পারেনি। শনাক্তই করা যায়নি ওই অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির জন্য দায়ী কারা। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটিকে নেহাত দূর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে দায় এড়ানো হয়েছে। দূর্ঘটনা কাদের অবহেলায় ঘটেছে তাও উল্লেখ করা হয়। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ৯ বছরে কোনো নিয়মিত মামলা রুজু হয়নি।
সম্পর্কিত খবর
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে ১১৯ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যায়। ওই ঘটনার পর আশুলিয়া থানা পুলিশ শ্রমিক নিহত হওয়ার জন্য দায়িত্বে অবহেলাকে দায়ী করে থানায় তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। এরপর ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারের জন্য স্থানান্তর হয়। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। গত প্রায় তিন বছরে ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এই মামলা কবে শেষ হবে তা অনিশ্চিত। কেবল তাজরীন ফ্যাশনস নয়, মর্মান্তিক এমন ঘটনার নজির দেশে অনেক।
অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার প্রথম কারণ হলো, অসতর্কতা। আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো অগ্নি নিরাপত্তাজনিত সামগ্রীর অপ্রতুলতা।। ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা যায় ২৭ জন। ১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে নিহত হয় ১০ গার্মেন্টকর্মী। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যায়। ১৯৯৭ সালে ঢাকার মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টে ২৭ জন ও মিরপুর মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলস কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয় ২২ জন সেলাই শ্রমিক। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ৫৩ শ্রমিক। একই বছর রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ীতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে আগুন লেগে মারা যায় ১২ জন শ্রমিক। ২০০১ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবে ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হয় ২৪ গার্মেন্ট শ্রমিক। তারও এক সপ্তাহ আগে মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে আরো ২৬ শ্রমিক প্রাণ হারায়। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ শ্রমিক নিহত হয়। ওই বছরের ৩ মে মিসকো সুপারমার্কেট কমপ্লেক্সের একগার্মেন্টে আগুন লাগলে মারা যায় ৯ শ্রমিক। ২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল সান নিটিং নামে একটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুনে ২০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস অ্যাপারেলস মিলে আগুন লেগে ৬৫ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যায়।
গার্মেন্টে দুটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে২০১০ সালে । ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সদরের গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ২১ জন শ্রমিক। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে ৩০ শ্রমিক মারা যায়। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঘটে আরো একটি বড় শিল্প দুর্ঘটনা। এটিও ঘটে টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামে একটি প্যাকেজিং কারখানায়। বয়লার বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট আগুনে ৪০ বছরের পুরনো ভবনটি ধসে পড়ে। এতে নিহত হয় ৩৫ জন।
উল্লেখিত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনাগুলোর কোনাটারই বিচার হয়নি। যার কারণে কারখানা, বহুতল ভবন ও বিপনী বিতানের মতো পাবলিক প্লেসগুলোতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি রাখ বাধ্যতামূলক হলেও তা কমই পালন করা হচ্ছে। আর এ কারণে কোথাও লাগলে অল্পসময়েই তা চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে জান ও মাল।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে, গত দুই দশকে বাংলাদেশে শিল্প-কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ২৬টি। এতে প্রাণ হারিয়েছে দুই হাজারের মতো শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিক। শিল্প-কারখানা নির্মাণে উদ্যোক্তারা যতটা মনোযোগী, ততটাই উদাসীন এর নিরাপত্তা নিশ্চিতে। স্বল্প পুঁজিতে বেশি মুনাফা অর্জন করার প্রবণতা, আইনের তোয়াক্কা না করা, আবার সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকির অভাব এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ।
এনই