• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

ক্রিকেটারদের ভাষ্য

সৌভাগ্য সংবাদ সম্মেলনে দেরি , প্রাণ বাঁচালো রক্তভেজা নারী

প্রকাশ:  ১৬ মার্চ ২০১৯, ২০:১৪ | আপডেট : ১৬ মার্চ ২০১৯, ২০:৫১
নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্রাইস্টচার্চের দু’টি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার হোতা ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নামে ২৮ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকের লক্ষ্য ছিল নিউজিল্যান্ডে সিরিজ খেলতে যাওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। মসজিদে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা নামাজ পড়তে যেতে পারেন, আন্তর্জাতিকভাবে নজরে পড়তে ওই হামলাকারী বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ওপরই হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে বলে দেশটির গোয়েন্দা দপ্তরের ধারণা আরও দৃঢ হয়েছে।

মাত্র পাঁচ-দশ মিনিটের জন্য হতাহতের তালিকায় নাম ওঠেনি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। সৌভাগ্যক্রমে মসজিদের পৌছাতে পৌছাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটার দেরি হয়ে যায়। বাংলাদেশ দলের মসজিদে ঢোকার কথা ছিল দুপুর দেড়টায়। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে যেতে যেতে ১টা ৪০ বেজে যায়। তাদের পৌছার আগেই হামলার ঘটনাটি ঘটে।বাংলাদেশ দলের বাস যখন মসজিদের সামনে পৌছায়, এমন সময় রক্তাক্ত শরীরের একজন মহিলা ভেতর থেকে টলোমলো পায়ে বেরিয়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান। ক্রিকেটাররা তখনো বুঝতে পারেননি ঘটনা কী। তাঁরা হয়তো মসজিদে ঢুকেই যেতেন, যদি না বাসের পাশের একটা গাড়ি থেকে এক ভদ্রমহিলা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বলতেন, ‘ভেতরে গোলাগুলি হয়েছে। আমার গাড়িতেও গুলি লেগেছে। তোমরা ভেতরে ঢোকো না।’

সম্পর্কিত খবর

    ক্রিকেটাররা তখন বাসেই অবরুদ্ধ হয়ে আটকা পড়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। কারণ পুলিশ ততক্ষণে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। বাসে বসেই তাঁরা দেখতে পান, মসজিদের সামনে অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। অনেকে রক্তাক্ত শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসছেন মসজিদ থেকে। যা দেখে আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়েন ক্রিকেটাররা। কারণ বাসে কোনো নিরাপত্তাকর্মী দূরে থাক, স্থানীয় লিয়াজোঁ অফিসারও ছিলেন না। তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা নিরাপদেই ওই এলাকা থেকে সরে আসতে সমর্থ্য হয়।

    বাংলাদেশ দল নিরাপদে ফিরতে পারলেও হামলায় নিহত মানুষের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এর মধ্যে তিনজন বাংলাদেশিও রয়েছেন। বাংলাদেশ দলের বাস আর পাঁচ মিনিট আগে মসজিদে পৌঁছালেই সর্বনাশ হতো। কারণ, ক্রিকেটাররা তখন সন্ত্রাসী হামলার সময় মসজিদের ভেতরেই থাকতেন। তাহলে কী হতে পারত, আর যা দেখেছেন—দুটি মিলিয়ে বাসের মধ্যে দলের অনেকেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন। বাসে থাকা মুমিনুল হক তখনকার ভয়ানক পরিস্থিতি খুলে বলেছেন সংবাদমাধ্যমকে। তাঁর মুখেই শুনুন—

    ‘আমরা মধ্যাহ্নভোজ সেরে বের হয়েছিলাম। অনুশীলন ছিল ২টায়। দেড়টায় যাওয়ার কথা ছিল। (মাহমুদউল্লাহ) রিয়াদ ভাইয়ের সংবাদ সম্মেলনের জন্য একটু দেরি হয়েছে। মিনিট দশেক পর বের হয়েছি। মুশফিক ভাই, তাইজুল ও আমি মাঝে-মাঝে ড্রেসিং রুমে ফুটবল খেলি নিজেদের মধ্যে। এতে আরও দুই-এক মিনিট দেরি হয়েছে। মসজিদে পৌঁছানোর পর দেখি সবাই পরে আছে। ফোনে ব্যস্ত এক নারী বের হয়ে এসে ভেতরে যেতে নিষেধ করলেন। গাড়ি থেকে আরেক নারী চিৎকার করে একই কথা বললেন, ভেতরে যেও না, কে যেন গুলি করছে। আমরা তখনই বুঝে ফেলি কেমন পরিস্থিতি।’

    ‘আমরা বাসের মধ্যে পাঁচ-দশ মিনিট বসে ছিলাম। তখন পাইলট ভাই (ম্যানেজার) ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। পেছন থেকে তামিম ভাই এলেন, আমরা বাসের ড্রাইভারকে জানালা খুলতে বলি। দেখলাম বেশ কিছু লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা বাসের পেছনের দরজা খুলে পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে চলে আসি। আমরা পাঁচ মিনিট আগে মসজিদে পৌঁছালে ভেতরে থাকতাম এবং সবাই শেষ হয়ে যেতাম। পরম করুণাময়ের অশেষ রহমত যে পাঁচ মিনিট দেরিতে পৌঁছেছি।’

    ‘মসজিদে গেলে আমরা পেছনের দিকেই বসতাম এবং সে আমাদের কাউকে জীবিত রাখত না। কোনো বাছবিচার ছাড়াই টানা গুলি করেছে। আমরা এত ভয় পেয়েছি যে বাসের মধ্যেই কেঁদেছি। এই ঘটনার মধ্যে আমরা বাস পেছাতে বলেছি ড্রাইভারকে। কিন্তু ড্রাইভার বলেছে তা সম্ভব না, এ ধরনের কোনো নির্দেশ নেই। আমি মুশফিক ভাইয়ের সঙ্গে সম্ভবত দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারিতে ছিলাম। বাস থেকে দেখেছি, মসজিদ থেকে সবাই বের হয়ে আসছেন এবং মেঝেতে পড়ে যাচ্ছেন। তাঁদের শরীর ছিল রক্তমাখা। এর আগে ক্রাইস্টচার্চে থাকতে আমরা এই মসজিদেই নামাজ পড়েছি।’

    ‘কাল রিয়াদ ভাই জানতে চেয়েছিলেন, নামাজ পড়ে খাব, নাকি খেয়ে নামাজ পড়তে যাব? আমরা সিদ্ধান্ত নিই অনুশীলন যেহেতু জুমার পর, তাই নামাজ পড়ে এসেই খাব। কিন্তু কোনোভাবে সিদ্ধান্তটা পাল্টে যায়, আমরা খেয়ে মসজিদে গিয়েছি এবং এ কারণেই হয়তো বেঁচে যাই। আমরা কী পরিমাণ ভীত ছিলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। নিজের চোখে এসব দেখতে কেমন লাগে, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।’

    ‘শুধু ভীত হয়ে পড়ার জন্যই আমরা কেঁদেছি। আসলে আমরা বেঁচে গেছি গাড়ির ভেতরে থাকা সেই নারীর জন্য, যিনি আমাদের মসজিদের ভেতরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। প্রথম নারী বলার পর আমরা ভেবেছি তিনি অসুস্থ। কারণ নিউজিল্যান্ডে এমন কিছু ঘটতে পারে, আমাদের বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু গাড়ির নারী জানালা দিয়ে সাবধান করে দেওয়ার সঙ্গে জানান, তাঁর গাড়িতেও বুলেট লেগেছে—ঠিক তখনই আমরা পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছি।’

    এমন একটি হামলা যে হতে পারে, সেটা এখনো অবিশ্বাস্য ঠেকছে মুশফিকের। এই হামলার ঘটনা দেখে আসার পর তাঁদের পেশাদারি কোনো সাহায্য দেওয়া হয়েছে কি না, সে প্রসঙ্গে সরাসরি কোনো জবাব অবশ্য দেননি মুশফিক। শুধু বলেছেন, ‘আমরা সবাই খুশি যে বেঁচে আছি।’ তবে দলের অনেককেই ভীত দেখা গেছে, বলে দাবি করেছে সিনহুয়া। যাত্রা শুরুর আগে মুশফিক অবশ্য টুইটারে নিজেই ফেরার কথা জানিয়েছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে ঘরে ফিরছি।’ সিঙ্গাপুর হয়ে ক্রিকেট দল আজ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে বাংলাদেশে এসে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

    আগের রাতে ক্রাইস্টচার্চ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে উড়াল দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারী অস্ত্রধারী পুলিশ বেষ্টিত হয়ে বিমানবন্দরে এলেও খেলোয়াড়দের চোখে মুখে নাকি ভয় দেখা যাচ্ছিল। চীনের বার্তা সংস্থা সিনহুয়া এ সময় মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে। তখনই নিউজিল্যান্ড প্রসঙ্গটা উঠে আসে। হতাহতের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে নিজেদের ভাগ্যবান দাবি করেছেন মুশফিক। তাঁর চোখে, ‘নিউজিল্যান্ড এখনো বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি। আমরা এখনো নিউজিল্যান্ডকে ভালোবাসি।’

    এনই/

    রক্তভেজা নারী,সৌভাগ্য সংবাদ সম্মেলনে দেরি,প্রাণ বাঁচালো রক্তভেজা নারী,ক্রাইস্টচার্চে
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close