• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মোস্তফা মননের ‘অক্ষর’ ভাষা আন্দোলনের জ্বলজ্বলে স্বাক্ষর: মোহাম্মাদ জাকারিয়া

প্রকাশ:  ০৫ এপ্রিল ২০১৯, ২১:৪১
মোহাম্মাদ জাকারিয়া
মোস্তফা মননের উপন্যাস 'অক্ষর'।

পৃথিবীতে অনেক দেশ, অনেক মানচিত্র, অনেক শব্দ, ভাষা।আলাদা, আলাদা। কোনটার সাথে কোনটার পুরোপুরিভাবে মিল নেই। তবে একটা শব্দ আছে যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে গিয়ে উচ্চারণ করলে শব্দটার মানে যেকেউ বুঝতে পারে। শব্দটা হলো, মা। বাংলা—মায়ের ভাষা।

ভাষার সাথে শব্দ, শব্দের সাথে অক্ষর জড়িত।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে মোস্তফা মননের উপন্যাসের নাম হিসেবে অক্ষর যথার্থ। স্বার্থক। উপন্যাসটি অত্যন্ত সহজ, সরলভাবে লেখা। যা এই উপন্যাসের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক বলে মনে করি। সব বয়সী পাঠকের জন্য পাঠ উপযোগী করে লেখা। একেবারে প্রাথমিকে পড়া শিক্ষার্থীও বইটি গল্পের ছলে, পড়ার ছলে ভাষা আন্দোলনের নতুন কিছু না কিছু তথ্য পাবেন-ই। উপন্যাসের নায়ক অবধারিতভাবেই মতিন, ভাষা মতিন, আব্দুল মতিন। ক্যাম্পাসে কারো কারো কাছে লম্বা মতিন, ঘাড়তেড়া মতিন নামেও যিনি পরিচিত ছিলেন। হ্যাঁ, সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার ধুবালীয়া গ্রামের সে-ই আব্দুল মতিন। ২৪ মার্চ, ১৯৪৮ সালে কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সামনে যে-যুবক ডান হাতের আঙুল তুলে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, 'নো নো নো। নো মিস্টার জিন্নাহ, আমি মানি না। উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা হতে পারে না। 'কেননা, তৎকালীন সময়ে শতকরা ৫৪ ভাগ মানুষ বাংলায়, ২৮ ভাগ পাঞ্জাবিতে আর ৭ ভাগ মানুষ উর্দুতে কথা বলত। কোনো যুক্তিতেই উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। তাছাড়া উর্দুর চেয়ে বাংলা প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এবং প্রাচীন ভাষা। আব্দুল মতিন কেন মেনে নেবেন জিন্নাহ'র এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত?

ভাষা আন্দোলনের বীজ আদতে সেদিন-ই বোনা হয়ে গিয়েছিল। ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি প্রসঙ্গ আসলে যে-চিত্রটা ভাসে তা হলো: 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'- শ্লোগান মুখরিত মিছিলে পাকিস্তানি পুলিশ বাহিনীর গুলিতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত সহ নাম না জানা অনেকেই শহীদ হন। ইতিহাস তো শুধু এটুকু নয়। ১৯৫২ সালের ২১ফেব্রুয়ারির আগে প্রায় চার বছর ধরে চলে ভাষা আন্দোলনের কার্যক্রম। যার পুরোটা জুড়ে মতিন। আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে নিতে কিছু খরচ-পাতির দরকার হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মেয়েরা গেল আজিমপুর কলোনিতে চাঁদা তুলতে। কলোনিবাসী ছাত্রীদের কথা শুনে যার যা সামর্থ্য ছিল তাৎক্ষনিকভাবে তাই দিল। যার নগদ পয়সা ছিল না সে ভাতের চাল পর্যন্ত দিতে চেয়েছিল। এই কলোনির এক নববধু যার ঘরে কিছু ছিল না বলে সেদিন নিজের স্বর্নের চেইন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীরা চেইন দেখে মুহূর্তে চমকে গিয়ে বলেছিলেন, দু' এক টাকা নিতে পারি। চেইন নিতে পারব না। অনেক দাম এই চেইনের। জবাবে নববধু বলেছিলেন, এই চেইন আমি পরেও বানাতে পারব, ভাষার জন্য যে-আন্দোলন সেই আন্দোলন তো এখন থামানো যাবে না।

এটুকু পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাই, হতেই হয়। চোখের মধ্যে কেমন যেন ঝিলিক ছড়ায়। ভাষা আন্দোলন কোন সুসংগঠিত আন্দোলন ছিল না। আকাশের তারাগুলো যেমন বিক্ষিপ্ত; তবুও তারাদের মধ্যে একটা ঐক্যতান আছে। ঠিক তেমনি ভাষা আন্দোলনের মধ্যে একটা ঐক্যতান শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল।

যেহেতু লেখক একজন কাহিনীচিত্র নির্মাতা, সুতরাং উপন্যাসের ঘটনার ক্রমবিন্যাস, শৈলীতে সে-ছাপ পড়েছে। প্রকাশকের তরফ থেকে কি লেখককে আগে থেকেই পৃষ্ঠা সংখ্যা বেধে দেওয়া হয়েছিল?

কোথায় যেন একটা তাড়া ছিল, যেন এত পৃষ্ঠার বেশি যাওয়া যাবে না (উপন্যাসটি একশো পৃষ্ঠার)। আরো কিছুটা বিশদভাবে লেখা উচিৎ ছিল বলে মনে করি। যদিও একথাও ঠিক যে, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তো দু'শো তিনশো পৃষ্ঠায় কেন, হাজার পৃষ্ঠাতেও আঁটানো সম্ভব না। ক্যাম্পাসের চা-দোকানি যার দেওয়া বিশ টাকার জন্যেই ভাষা মতিন সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শেষ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। আর সেই ঐতিহাসিক উচ্চারণ 'নো নো' করতে পেরেছিলেন। চা-দোকানদারের নাম অনুল্লিখিত। তাঁর নাম কি কোথাও নেই? উপন্যাসে কেবল 'চাওয়ালা', 'দোকানি'বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর নাম জানা প্রয়োজন। কেননা সেদিন এই বিশ টাকা ভাষা মতিনকে না দিলে সেদিন ‘নো নো’ উচ্চারিত হতো না, আর এই ‘নো নো’ উচ্চারণ না হলে হয়ত ২১ ফেব্রুয়ারি হতো না। আর ২১ ফেব্রুয়ারি না হলে হয়ত ১৬ ডিসেম্বর হতো না।

বাংলা ভাষাভাষী সকলের উপন্যাসটি পড়া প্রয়োজন বলে মনে করি। ‘অক্ষর’ উপন্যাসটি ভাষা আন্দোলের এক জ্বলজ্বলে সাক্ষর হয়েই থাকবে।


উপন্যাস: ‘অক্ষর’।

লেখক: মোস্তফা মনন, নাট্যনির্মাতা, লেখক, সমালোচক ও টিভি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

প্রকাশক: শোভা প্রকাশ, বইমেলা ২০১৯

প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল

পৃষ্ঠা: ১০২

মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা।

ঘরে বসে বইটি ক্রয়ের লিংক: https://www.rokomari.com/book/178433/okkhor

সমালোচনা লিখেছেন-

মোহাম্মাদ জাকারিয়া: চিত্রনির্মাতা ও সাহিত্যিক।

পিবিডি/ এইচকে

মোহাম্মাদ জাকারিয়া,ভাষা আন্দোলন,অক্ষর,মোস্তফা মনন,উপন্যাস
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close