• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

লোকসংস্কৃতি মানেই কি গ্রাম্য সংস্কৃতি?

প্রকাশ:  ২৪ মার্চ ২০১৯, ১৫:০৭ | আপডেট : ২৪ মার্চ ২০১৯, ১৫:১১
মৌ কর্মকার

ফোকলোরের শিক্ষার্থী হিসেবে অনেক বার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে এখনো হয়, আচ্ছা বলেন তো সংস্কৃতি কী? উত্তরে বহুবার বলেছি ম্যাকাইভারের মতানুসারে, 'আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা।' আচ্ছা সংস্কৃতিতো চলমান তাই না? তাহলে লোকসংস্কৃতি কী? লোকসংস্কৃতি লোকসম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক বিশ্বাস ও আচার-আচরণ, জীবন-যাপন প্রণালী, চিত্তবিনোদনের উপায় ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি।

বাংলাদেশ একটি গ্রাম-প্রধান দেশ। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠী নিজস্ব জীবন-প্রণালীর মাধ্যমে শতকের পর শতক ধরে যে বহুমুখী ও বিচিত্র ধর্মী সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে, তা-ই বাংলার লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লোকসম্প্রদায় মানেই কি গ্রামের মানুষ? শহরের মানুষ কি লোকসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত নয়! যদি তা না হয় তাহলে গ্রামের মানুষই কিভাবে লোকসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। তারা গ্রামে বাস করে এটাই কি তার কারণ?

সম্পর্কিত খবর

    তাহলে তারা কারা যারা শহরে বসেও লোকসংস্কৃতির চর্চা করে চলেছে? আবার যদি তা হয় তাহলে আমরা লোকসংস্কৃতিকে কেন গ্রামের সংস্কৃতি বলছি। যেহেতু আমাদের জানা আছে যে, ‘লোক’ মানে হচ্ছে মানুষ, সেই মানুষ যে বা যারা জেনেই হোক বা না জেনেই হোক লোকসংস্কৃতির চর্চা করে চলেছে। তাঁরা শহরে বসবাস করছে না গ্রামে তাতে কি আসে যায়!

    অপরদিকে সংস্কৃতি যদি চলমান হয় লোকসংস্কৃতি কি চলমান নয়! যদি লোকসংস্কৃতি চলমান বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে লোকসংস্কৃতির পরিবর্তন কেন আমাদের মাঝে হারানোর সুর বাজিয়ে তুলে। ‘আমরা যা তাই আমাদের সংস্কৃতি।‘ এই মত অনুসারে বর্তমানে লোক মানুষের যে জীবন তা ঘিরেই বর্তমান মানুষের লোকসংস্কৃতি। তাই নয় কি? বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, উন্নয়ন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের জীবন বর্তমানে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে।

    ফলে পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের লোকসংস্কৃতিও। তাই যেগুলোকে আমরা লোকসংস্কৃতি বলে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই তার অনেক অংশই আজ দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে বা গেছে। জীবনযাত্রা পরিবর্তন হবার সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে সে গুলোও। যা আমরা দেখছি তবে মানতে পারছি না! আন্যদিকে আধুনিক জিনিসের মধ্যে লোকসংস্কৃতির কোন ছাপ দেখলেই লাফিয়ে উঠে বলছি, আরে এই তো আমাদের লোকসংস্কৃতি।

    আমরা পরিবর্তনের মধ্যেও লোকসংস্কৃতি খুঁজবো আবার পরিবর্তনকেও কটাক্ষ করবো একসাথে দুটো! তা আবার হয় কি? কখনো আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যা হারিয়ে যাচ্ছে তা আমাদের লোকসংস্কৃতি। আমরাও ছুটছি তার পিছনেই । কেন এখন মাটির ঘর নেই, কেন রমণীরা ঢেঁকির ব্যবহার করে না, চাষির হাতের লাঙল কোথায়, গ্রাম বাংলার লোকগান কোথায় যাচ্ছে?

    আরো কত প্রশ্ন আমাদের! কেননা আমাদের মনে গেঁথে গেছে লোকসংস্কৃতি মানেই গ্রামের সংস্কৃতি। আর আমরা সে পথেই চলছি। আমরা যদি এসব বিষয় নিয়েই পড়ে থাকি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎকে আমরা কি উপহার দিবো। তাদের ভাবনার জগতের জন্য আমরা কি রেখে যাবো, ভেবেছি কি?

    লোকসংস্কৃতির একজন গবেষক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম ফোকলোর এর লিভিং মিউজিয়াম।‘ মেনে নিলাম বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম লিভিং মিউজিয়াম কিন্তু এতে কি আমাদের সংস্কৃতি থেমে যাচ্ছে না? সংস্কৃতি তো চলমান আমরা কেন তাকে এক স্থানে বন্ধী করে দিচ্ছি। লোকসংস্কৃতির আরেকজন গবেষক নর্দান ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল করিম বলেছেন, ‘লোকসংস্কৃতির নানা বিকৃত রূপ আমরা আজকাল দেখতে পাই।

    বাউল গানের সুরকে বিকৃত করা হয়৷ লোকগানের সুর বিকৃত করা হয়৷ এটা আমাদের জন্য বড় ক্ষতিকর।‘ (dailyhunt news, 25 December 2018) অবশ্যই তা আমাদের জন্য ক্ষতিকর। তবে এখানে যদি লোকগানের আধুনিকায়ন এর কথা বলা হয় তাহলে একমত প্রকাশ করা যাচ্ছে না কেননা গানের আধুনিকায়ন মানেই গানের মূল সুরের বিকৃত অবস্থা নয়। অপরদিকে জারি, সারি, ভাটিয়ালি ইত্যাদি গানের মতোই বর্তমান সমাজেও আমাদের অনেক লৌকিক গান গজিয়ে উঠছে। যে কারণে আমাদের সব জায়গায় নজর রাখা প্রয়োজন। হারানোর পিছনে ছুটতে ছুটতে আমাদের বর্তমানই যেন হারিয়ে না যায়।

    এ কথা স্বীকার্য যে গ্রামীণ জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্যে, তাদের জীবনবোধে- পোশাক, খাবার, প্রার্থনা, পূজা-পার্বণ, ফসল, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বাসস্থান, বাহন, জীবন সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, বিরহ এ সবই লোকসংস্কৃতিকে প্রথম রূপ দিয়েছে৷ লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে তাঁর সামগ্রিক প্রকাশ ঘটেছে৷ লোকগানে, কবিতায়, সাহিত্যে, উৎসবে, খেলাধুলাতেও প্রকাশ পেয়েছে লোকসংস্কৃতি। আছে প্রবাদ-প্রবচন, খনার বচন, লোককথাও যার মধ্যে আছে প্রকৃতির কথা, ঋতুর কথা, ভালো-মন্দের কথা, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় দিকের কথা।

    তবে সব কিছুর সঙ্গেই আছে বিজ্ঞানের সম্পর্ক, আছে যুক্তির সম্পর্কও। সবমিলিয়ে লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডার অফুরন্ত। তাই হারানো বা বেদনার সুরে নয় চোখ কান খোলা রাখলেই আমরা সংস্কৃতির সাথে চলমান হতে পারবো।

    ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ঔষধ দিব কোথা।' বিষয়টা অনেকটা এরকমই। তবে ঔষধ দেবার আগে ব্যথাটা কোথায় জানা দরকার। এখন আমাদের মাঝে আছে শুধু হারানোর সুর, 'কিছুই আর নেই, প্রযুক্তির যুগে সব শেষ, কোথায় আমাদের লোকসংস্কৃতির?’ আরো কত কি। ব্যথাটা এখানেই।

    যে কারণে জীবনের সাথে সাথে লোকসংস্কৃতি যে পরিবর্তন হতে পারে তা আমরা ভুলেই গেছি। হারিকেন যে ল্যাম্প-শেড, মাটির ঘর যে রেস্তোরাঁর মূল থিম, আলপনা যে পোশাকের মোটিফ, লোকগান যে বিভিন্ন রূপে আমাদের মধ্যে নতুনভাবে ফিরে এসেছে তা আমরা খেয়ালই করিনি। চোখ কান খুলতে হবে। আমাদের জাগ্রত হতে হবে আমাদের জন্য, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য। হুজুগের বাঙালি নয় আসুন কর্মের মাধ্যমে বাঙালি হয়ে উঠি।

    পিবিডি/আর-এইচ

    গ্রাম্য সংস্কৃতি,লোকসংস্কৃতি
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close