• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

শিক্ষক দিবস জাতীয়করণের দাবি ওঠে শুধু জোহা দিবসেই

প্রকাশ:  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:২৮
রাবি প্রতিনিধি

‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড ডোন্ট ফায়ার! এরপর যদি গুলি করা হয়, কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার সেই গুলি আমার বুকে লাগবে।’ ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এভাবে চিৎকার করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তৎকালীন প্রক্টর ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। সত্যিই সেদিন ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে ড. জোহার বুকে গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা।

ড. জোহার রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। পতন ঘটেছিল সামারিক জান্তা আইয়ুব খানের। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিতও রচিত হয়েছিল ড. জোহার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে। গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিল বাঙালির। ফলে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ড. জোহা।

সেই আজন্ম দ্রোহী শহীদ ড. শামসুজ্জোহার শাহাদতের দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তবে এ দাবি শুধু শহীদ দিবসের কর্মসূচিতে সীমাবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের উচ্চ পার্যায়ে কখনও যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ দাবির কথা জানিয়েছে কিনা, তা জানেন না খোদ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাই।

ফলে ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি ‘শিক্ষক দিবস’ জাতীয়করণের দাবি। এদিন শুধুমাত্র রাবিতে ‘শিক্ষক দিবস’ উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

রাবি শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. শাহ্ আজম বলেন, ‘৫০ বছরেও দিবসটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস করা সম্ভব হয়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা এখন সময়ের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দাবিয়ে জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও ঘোষণা আসেনি।’ তবে শুধু দিনটি আসলেই শোকর‌্যালি ও মানববন্ধনে এই দাবি জানানো হলেও আদৌ সরকারি কোনো পক্ষের কাছে সরাসরি দাবি জানানো হয়েছে কিনা-সেই বিষয়ে সন্দিহান এই শিক্ষক নেতা।

জানতে চাইলে রাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় যেজন্য গর্ববোধ করে থাকে তা হচ্ছে, স্বাধীনতার প্রাথমিক সোপান রচনায় প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার অবদান। আমি বিশ্বাস করি- দেশের নেতৃত্বে এখন যারা আছেন, তারা প্রত্যেকেই বিষয়টি একমত হবেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য এবং দালিলিকভাবে প্রমাণিত। আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ দিবসটিকে জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছি। তবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ে দাবির বিষয়টি কখনও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে কিনা, সে ব্যাপারে জানাতে পারেন নি উপাচার্য। এ প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, ‘প্রথম মেয়াদে আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসগুলো এনে, তাদেরকে এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবির যথার্থতা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। তখন এ বিষয়ে সরকারের কিছুটা ইতিবাচক মনোভাব দেখেছিলাম। পরবর্তীতে সেভাবে আর কেউ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।’

অধ্যাপক আব্দুস সোবহান বলেন, ‘আমরা এবার প্রক্রিয়াগতভাবে এগোতে চায়। এ ব্যাপারে প্রশাসনের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

সেদিন যা ঘটেছিল:

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলে গুলি করতে উদ্যত হয়। খবর পেয়ে তৎকালীন রাবি প্রক্টর শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ান।

এসময় তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলি করতে নিষেধ করে বলেন, ‘কোন ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে।’ এক পর্যায়ে তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার দিকে ক্যাপ্টন হাদী পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে রাজশাহী মিউনিসিপল অফিসে নিয়ে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

ড. জোহার সংক্ষিপ্ত জীবনী:

১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৪৮ সালে বাকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১ম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে ক্রিশ্চান কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে স্নাতক ও ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।

পরে অর্ডিন্যান্স কারখানায় শিক্ষানবিশ সহকারী কারখানা পরিচালক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন। পরে লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষ ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগ দেন। শহীদ হওয়ার সময় তিনি স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কণ্যা সন্তান রেখে যান। দীর্ঘদিন ধরে তার আমেরিকা বসবাস করছেন। এখন সেখানকার নাগরিক হয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে।

জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন স্থাপনা:

ড. জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার টাকা মূল্যের ডাকটিকেট চালু করা হয়। তাঁর শাহাদাতের ঘটনার পরপরই ক্যাম্পাসে ‘শহীদ ড. শামসুজ্জোহা হল’ নামে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়।

২০১২ সালে হলটির মূল ফটকের পাশে ড. শামসুজ্জোহার স্মৃতিস্মারক ভাস্কর্য স্ফুলিঙ্গ নির্মাণ করা হয়। এটির উচ্চতা ১৫ ফুট, দৈর্ঘ্য ৩৮ ফুট এবং ২৪ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট্য। এছাড়া ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রশাসনিক ভবনে ড. জোহার সমাধিস্থল ঘিরে ‘জোহা চত্ত্বর’ নির্মাণ করা হয়। সদর আসনের সংসদ সদস্য এ চত্ত্বর নির্মাণে ১ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসানিক ভবনের সামনে চোখে পড়বে জোহার সমাধি। সেখানে এরই মধ্যে শেষ হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ। সেখানে একটি ফলকে জোহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও কার্যক্রম খোদাই করা রয়েছে। যে কেউ একনজরে ড. জোহাকে জানতে পারবে। এছাড়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জোহা স্মৃতিফলক নির্মাণ কাজও।

৫০তম শাহাদাত বার্ষিকীর কর্মসূচি:

এদিকে, শহীদ ড. শামসুজ্জোহার ৫০তম শাহাদাত বার্ষিকীতে সোমবার ক্যাম্পাসে নানা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সকালে থেকে তাঁর সমাধিস্থলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

দিবসটি উপলক্ষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় ড. জোহার মাজার ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এরপর সকাল সোয়া ৭টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, আবাসিক হল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সমিতি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।

সকাল সাড়ে ৮টায় রাবি অফিসার সমিতি কার্যালয়ে আলোচনা সভা আয়োজন শুরু হয়। এছাড়াও মৃত্যুবাষির্কীতে দোয়া মাহফিল, তাঁর ভাস্কর্য বেদীতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও আলোকচিত্র প্রদশর্নীর আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল।

সকাল ১০টায় শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনে জোহা স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হবে। এতে বক্তব্য রাখবেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী।

এরপর বাদ জোহর রাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ মোনাজাত এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে দোয়া মাহফিল ও প্রদীপ প্রজ্জ্বালন করা হবে। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য খোলা থাকবে।

/পিবিডি/পি.এস

রাবি,শিক্ষক দিবস,ড. শামসুজ্জোহা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close