• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||

মুজিবনগর সরকারকে ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়ার অনন্য স্মৃতি

প্রকাশ:  ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০২:৪৮ | আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৯, ০৩:২৮
মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সকালবেলা খবর এল এখনই বৈদ্যনাথতলায় যেতে হবে। কারণ সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নেবে। ছুটে গেলাম বৈদ্যনাথতলায়। পথে পাড়ি দিতে হলো নানা চড়াই-উতরাই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম। দেখতে পেলাম ছোট্ট একটি মঞ্চ। ওপরে কয়েকটি ভাঙ্গা চেয়ার ও একটা ছোট টেবিল। মঞ্চের এক কোনায় একটা বাঁশের দণ্ড। মঞ্চের আশেপাশে অনেক মানুষ। প্রহরায় ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর কজন সদস্য। একটু দূরে একটা ভাঙ্গা হারমোনিয়ামে চলছিল জাতীয় সংগীতের রিহার্সেল, হারমোনিয়ামটা পাশের একটি চার্চ থেকে সংগৃহিত।

এ অবস্থায় বেলা ১১টার দিকে জাতীয় নেতৃবৃন্দ গাড়িবহর নিয়ে কলকাতা থেকে বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত হলেন। তাঁদের সঙ্গে বহু দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। কিছুক্ষণ পর তাঁরা ধীরপায়ে মঞ্চে উঠলেন। মঞ্চে থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী প্রধান সেনাপতি। মঞ্চ পরিচালনায় দাঁড়াবেন টাংগাইলের জননেতা আব্দুল মান্নান, এমএনএ। পরিচয় পর্বের পর শপথ বাক্য পাঠ করালেন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এমএনএ।

এরপর আমার জীবনে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে ক্ষণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে আমার নেতৃত্বে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। গার্ড অব অনার দেওয়ার কথা ছিল ইপিআরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর। অজ্ঞাত কারনে তিনি সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি। এরই মাঝে এক ফাঁকে বন্ধু তৌফিক এসে বলল, ‘ওসমান ভাই আসার কথা ছিল উনি তো এলেন না, এখন গার্ড অব অনার কী করে দেওয়া যায় চিন্তা করো।’ আমি তাকে বললাম, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি একজন পুলিশ অফিসার, জীবনে বহুবার গার্ড অব অনার নিয়েছি, গার্ড অব অনার দিয়েছি। আমি এখনই ব্যবস্থা করছি।’

আমার গাড়িতে যে তিন-চার পুলিশ কনস্টবল ছিল তাদের এবং আশেপাশের কয়েক জন আনসারকে ডেকে একত্র করে পাঁচ-সাত মিনিট প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের প্রস্তুত করলাম। কিছুক্ষণ পরেই উপরাষ্ট্রপতি তথা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। পেছনে সরকারের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। মঞ্চের বাঁ দিকে মাটিতে দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন। অন্য সবাই আশপাশে প্রতীক্ষায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। এ অবস্থায় আমার নেতৃত্বে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার প্রদান করলাম। একসময় প্রেজেন্ট আর্মস করে সৈনিকেরা যখন তাদের রাইফেল উর্ধ্বমুখী করে দাঁড়াল তখন আমি হাত তুলে তাঁকে স্যালুট দিলাম। তিনি স্যালুট গ্রহণ করলেন।সাথে সাথে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বেজে উঠল। এরপরই মঞ্চের পাশে যে বাঁশ লাগানো হয়েছিল, সেই বাঁশে পতাকা উত্তোলন করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি।

পতাকাটা যখন বাতাসে পতপত করে উড়ছিল তখন আমাদের মন ছিল আনন্দে উদ্ভাসিত। পতাকা উত্তোলন শেষে তিনি আবার ঋজু হয়ে মঞ্চে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে জাতীয় সংগীত গাওয়া শেষ। কমান্ড দিয়ে সালাম শেষ হলো। রাইফেলধারীদের অন্ত্র নেমে এল ঘাড়ে। আমিও হাত নামালাম। কুইক মার্চ করে সামনে গেলাম দু’কদম তাঁকে আবার সালাম জানিয়ে বললাম-‘স্যার, আমাদের দল আপনার পরিদর্শনের অপেক্ষায়।’ উনি ধীর পদক্ষেপে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। এরপর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গার্ড অব অনার পরিদর্শন করলাম। অবশেষে তিনি আবার মঞ্চে ফিরে গেলেন। আমি সৈনিকদের সামনে দাঁড়িয়ে আবার তাঁকে সালাম জানিয়ে বললাম, ‘আমি এখন সৈনিকদের নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাই।’ তিনি তা অনুমোদন করলেন। এরপর আমি মার্চপাস্ট করে মঞ্চের সামনে থেকে সরে গেলাম। মিশে গেলাম জনারণ্যে। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে তখন বৈদ্যনাথতলার আকাশ বাতাস টালমাটাল।

এর পর মঞ্চে এলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। তিনি কয়েকজনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর তিনি ঘোষণা দিলেন- আজ থেকে এই বৈদ্যনাথতলার নাম হবে ‘মুজিবনগর’। আর এ মুজিবনগরই হবে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী। এখান থেকেই এ সরকারের সব কাযক্রম পরিচালিত হবে। এ কথা থেকেই আমরা মুজিবনগর পেলাম। এই মুজিবনগর থেকেই পুরো বিশ্বকে সেদিন জানিয়ে দেওয়া হলো স্বাধীন বাংলার অস্তিত্বের কথা।

লেখক: ১৯৭১ সালে যশোর জেলার তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমায় পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

মুজিবনগর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close