• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ডা. মেহদীকে একুশে পদক দিন

প্রকাশ:  ০৬ জানুয়ারি ২০১৮, ১৩:১৪
ডা. মানিক চন্দ্র দাস

হালকা পাতলা ধরনের একটা ছেলে। চোখে চারকোনা ফ্রেমের চশমা। মাথা ভর্তি চুল, যাতে আদপেই চিরুনি ঢোকে কিনা সন্দেহ আছে। কোন একটা যায়গায় চুপ করে দাঁড়াচ্ছেনা, হেঁটে যাচ্ছে, হেঁটেই যাচ্ছে, কথা বললে হাত পেছনে নিয়ে শুনছে, তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। এই তাকানোটাতে আবার কোন লুকোছাপা নেই। পূর্ণ দৃষ্টি। ক্যাম্পাসে ভয়ডরহীন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসি।

সহজ ভাষায় এই হচ্ছে মেহদী। মেহদী হাসান খান।

সম্পর্কিত খবর

    যখন ছেলেটার সাথে পরিচয় তখন ওর বয়স কত? ১৭ বা ১৮। ক্লাবে আসতো, মেডিসিন ক্লাব।

    ক্লাবের প্রত্যেকটা কাজে সরব, উপস্থিতিও সেরকম প্রানোচ্ছল। হঠাৎ করে ছেলেটা হয়ে গেলো চুপচাপ। মাথা নিচু করে হাঁটছে, জিজ্ঞাসা করলে কথা বলছে। মেহদীর চরিত্রের সাথে যায়না, অন্তত যারা ওর সাথে আড্ডা দিতো তাদের জন্য অবশ্যই।

    এর মাঝে জানা গেলো বাংলা লেখার জন্য ওর নিজের বানানো একটা সফটওয়্যার আছে। বিজয় থাকতে কেনো আরেকটা সফটওয়্যার লাগবে তা আমার অজানা। খুব করে চেপে ধরতেই জানা গেলো ঘটনা। ইংরেজি অক্ষর চেপে কীবোর্ড এ বাংলা লেখা যায়। এই হচ্ছে মেহদীর বানানো সফটওয়্যার এর বৈশিষ্ট্য। (সফটওয়্যার বিষয়ে আমি ক অক্ষর গোমাংস, তাই এরচে বেশি কিছু বলতে পারছিনা)

    কত করে নিবি?

    কিসের কত করে নিবো?

    এরপরে মেহদী যা বললো তাতে আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেলো। ১৮ বছরের একটা ছেলে বলছে, ফ্রি। ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?

    হ্যাঁ, এ ধরনের বৈপ্লবিক কথাবার্তা এই বয়সেই মানায়। আমিও বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছি, কারন তখনও মেহদীকে মিথ্যা বলতে দেখিনি।

    এরপরের সময়টাতে দেখলাম মেহদীর আত্মনিবেদন। প্রতিজ্ঞা।

    দুর্ধর্ষ ১৮ বছর বয়েসটাকে দরজার ওপাশে আটকে, হোস্টেলের একটা রুমে নিজের পৃথিবী বেঁধে ফেলে মেহদী তখন গোটা পৃথিবীর জন্য বাংলা ভাষাকে উন্মুক্ত করে দেয়ার যুদ্ধে নেমে গেছে।

    রুমে না গেলে ছেলেটার সাথে দেখা হয়না। কলেজ ক্যান্টিনে নেই। মাথার চুল ছেড়ে দেয়া বাড়তে দিয়ে, থুতনির নীচে ফিনফিনে দাঁড়ি গজাচ্ছে। চোখের নীচে কালিটুকু হয়ে যাচ্ছে স্থায়ী।

    এর মাঝে আছে মেডিকেল নামের রোড রোলার। তাবৎ বিজ্ঞ শিক্ষকেরা ঘোষনা দিয়ে জানিয়ে দিলেন, এ ছেলে মেডিকেলের অনুপযোগী। বিজ্ঞ শিক্ষকেরা বলে দিলেন, সময় থাকতে মেডিকেল ছেড়ে দিতে।

    মেডিকেলের অসহ্য, দমবন্ধকরা পৃথিবী মেহদীকে চেপে ধরছিলো আষ্টেপৃষ্ঠে, মরে যাওয়ার কথা ছেলেটার। একদিকে নতুন আইডিয়া, তার স্বপ্ন, আরেকদিকে মেডিকেল। অসম্ভব অস্থিরতা, খুব কাছে ঘেঁষে খালি হোস্টেলের কুকুরেরা। রাত বিরেতে পথ আগলে, পথের সঙ্গী হয়ে চলে সারমেয়বাহিনী।

    মেহদী আটকায়নি। সৃষ্টি সুখের উল্লাস আর দুই মমতাময়ী ওর পাশে ছিলেন। ঈশ্বর ওর সাথে ছিলেন। মেডিকেলটাও শেষ করেছে সন্মানের সাথেই। আটকায়নি। আমাদের মেডিকেল কলেজ অনেক রথীমহারথী চিকিৎসক তৈরী করেছে, মেহদীকে না। বরং মেহদী আমাদের কলেজটাকে সমৃদ্ধ করেছে।

    মেহদী লেগে থেকে এই পৃথিবীকে যেটা দিয়েছে, তা হচ্ছে মুক্তি, স্বাধীনতা। বাংলা লেখার স্বাধীনতা। তাই মেহদীর স্লোগান, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’।

    উন্মুক্ত এই সফটওয়্যার বাঁচিয়েছে সরকারের কোটি কোটি টাকা। সরকারী দপ্তরগুলোতে অভ্র ব্যবহার হয়। নির্বাচন কমিশন ব্যবহার করে আমার আপনার পরিচয়পত্র বানাচ্ছে,পাসপোর্ট বানাচ্ছে,সরকারী ফাইলে হচ্ছে লেখা। সবকিছুর মূলে ছিলো মেহদীর সেই এক রুমের পৃথিবী, একটা ছোট্ট কম্পিউটার আর পর্বতসম স্বপ্ন। স্বপ্নের নাম ‘অভ্র’। অভ্র, মেহদীর ব্রেইনচাইল্ড। সন্তান অর্কের মতোন।

    অভ্র আমাকে বাংলায় লেখার স্বাধীনতা দিয়েছে। সম্ভবত আপনাকেও। এই স্বাধীনতা দেয়ার জন্য মেহদীর কিছু প্রাপ্য। প্রাপ্য সরকারের কাছেও। তীব্র প্রচারবিমুখ আর বিনয়ী ছেলেটার স্বপ্নটাকে একটা রাষ্ট্রীয় পুরস্কার কি দেয়া যায়না?

    একুশে পুরস্কার অভ্র এর পাওনা।

    লেখক: চিকিৎসক, প্রাক্তন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ।

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close