দলভিত্তিক গবেষণা ফলাফল ফলপ্রসূ হয়
আজকের দিনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন সম্মিলিত পদক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়। অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিষয়টি একইভাবে প্রযোজ্য। আর গবেষণার মাধ্যমেই এই উন্নয়ন সম্ভব। উন্নয়নের জন্য গবেষণার ধারণাটি নিজের রাষ্ট্রের জন্য যেমন হতে পারে, তেমনি বিশ্বজনীনও হতে পারে। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, গবেষণার কাজটি এককভাবে হলে ফলপ্রসূ হবে, নাকি গ্রুপ বা দলভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত ফলাফল আরো ব্যাপকভাবে ফলপ্রসূ হবে।
সময় বদলেছে আর সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন ধারার ও ক্ষেত্রের মানুষের গ্রুপভিত্তিক গবেষণার প্রয়াস চলছে। কারণ একজন মানুষের সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞের জ্ঞান থাকা সম্ভব নয়। বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা যখন একত্র হয়ে গবেষণার কাজ করেন, তখন ভিন্ন ভিন্ন ধারণার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক শনাক্ত করে বড় আবিষ্কার বা উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়। এটি মৌলিক বা ফলিত যেকোনো ধরনের উদ্ভাবন হতে পারে। এই গ্রুপভিত্তিক গবেষণার কাজটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে যেমন হতে পারে, তেমনি আমাদের দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রুপভিত্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে হতে পারে। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠানও যুক্ত হতে পারে। অন্যভাবেও এই গ্রুপভিত্তিক গবেষণার কাজটি হতে পারে, তা হলো বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাস্তবসম্মত যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। একটি কথা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে, তা হলো ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। আর বিশ্বজনীন গ্রুপ রিসার্চের ক্ষেত্রে এই কথাটি খুব বেশি যথার্থ ও সঠিক বলে ধরে নেওয়া যায়। যাঁরা গ্রুপ রিসার্চে আগ্রহী বা বিশ্বজনীন গ্রুপ রিসার্চের ধারণাকে বাস্তবে প্রয়োগ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তাঁদের স্বল্প মেয়াদে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসেবে সরকার বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তবে এটি যেন ফলপ্রসূ হয়, আর এর ফলাফল যাতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। আবার এ ধরনের স্বল্পকালীন গবেষণাসম্পৃক্ত ভ্রমণের সময় উন্নত দেশগুলোর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব সুবিধা ও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা পরিদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে করে সেই দেশগুলোর প্রযুক্তির উন্নত ধারণা বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও গবেষণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সম্পর্কিত খবর
গ্রুপ রিসার্চের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়া, শ্রদ্ধাবোধ ও অন্যের মতামতকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা থাকতে হবে। আবার আত্মসমালোচনার জায়গায়টি যাতে তৈরি করা যায় সে বিষয়টিও লক্ষ রাখতে হবে। একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো গ্রুপের বিভিন্ন গবেষকের মধ্যে কোনো একটি গবেষণার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকতে পারে। এটাকে নেতিবাচক দ্বন্দ্বে পরিণত না করে ইতিবাচক দ্বন্দ্বে রূপান্তর করার মনোভাব থাকা খুব বেশি দরকার। সমাজের গতিধারার পরিবর্তনের কারণে মানুষের একত্র হয়ে কাজ করার সক্ষমতা দিন দিন কমে আসছে। এর প্রতিফলন আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দেখা যাচ্ছে। সবার মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেকে এককভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকলেও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফলাফল অর্জনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে যেমন কাজ করার ক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক কাজ করার ক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রয়াস ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু গ্রুপভিত্তিক গবেষণার সংস্কৃতি ও ধারণা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তৈরি করা যায়, তবে শিক্ষকদের মধ্যে পদ-পদবির জন্য দলাদলি থাকবে না। বরং বুদ্ধিভিত্তিক সমন্বিত গবেষণা প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষকরা নিজেদের মধ্যে যেমন সম্প্রীতি তৈরি করতে পারবেন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণার মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।
আর শিক্ষার্থীরাও গবেষণার প্রতি আকৃষ্ট হবে। এ জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ সোসাইটি গড়ে তোলা দরকার। আর এ বিষয়ে সরকার ও ইউজিসি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এ ধরনের রিসার্চ সোসাইটি আইনের মাধ্যমে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলতে পারলে বহুমাত্রিক গবেষণার ধারণা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এই সোসাইটির মাধ্যমে গবেষণার ক্ষেত্রে প্রতিবছরের অর্জনগুলো যাচাই করে দেখতে হবে ও একটি দায়বদ্ধতার জায়গা তৈরি করতে হবে। আবার রিসার্চ সোসাইটির মাধ্যমে যে গবেষণাগুলো পরিচালিত হবে তার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের রিসার্চ সোসাইটির মাধ্যমে ফলিত গবেষণার চেয়ে মৌলিক গবেষণাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ ফলিত গবেষণা বাংলাদেশে যে পরিমাণ হচ্ছে মৌলিক গবেষণা সে ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। কিন্তু মৌলিক গবেষণা ছাড়া একটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাতে পারে না। গ্রুপভিত্তিক কয়েকটি গবেষণার দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। যেমন—রোবটিকস নিয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যখন মৌলিক ও ফলিত গবেষণা করবে, তখন বহুমাত্রিক গবেষণার ধারণা একক গবেষণার ধারণা থেকে বেশি ফলপ্রসূ হবে। এর কারণ হলো রোবটের ব্যবহার অনুসারে এর মূল স্ট্রাকচার বা বডি ডিজাইন করবেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রিধারী গবেষকরা। এ ক্ষেত্রে রোবট তৈরির ম্যাটেরিয়াল যাচাই ও বাছাই, রোবটের যে বিভিন্ন মোশন আছে সেগুলোর ফলে ম্যাটেরিয়ালের কী পরিমাণ ক্ষয় হচ্ছে, এ বিষয়গুলো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গবেষকরা তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করবেন। রোবটের বিভিন্ন জটিল মোশন চালু রাখার জন্য যে জটিল ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটের প্রয়োজন হবে, এর ডিজাইনও তৈরি করবেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রিধারী গবেষকরা। আর এটিকে বিভিন্ন প্রগ্রামের মাধ্যমে ও সেন্সর ব্যবহার করে ইন্টারফেসিংয়ের কাজ করবেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। আবার এখানে কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংশ্লিষ্ট গবেষকদেরও যুক্ত করার প্রয়োজন হতে পারে। যদি এই রোবটটি বাণিজ্যিকীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, তবে সে ক্ষেত্রে অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ ও মনস্তত্ত্ববিদদের গবেষণালব্ধ দৃষ্টিভঙ্গিকেও বিবেচনায় আনতে হবে। আর এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন ও আধুনিক চিন্তাধারা যুক্ত হতে পারে। চিকিত্সাবিজ্ঞানে ক্যান্সার গবেষণা শুধু চিকিত্সাবিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী গবেষকের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে প্রকৌশলী, বিজ্ঞান, কলা ও অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত গবেষকদের সমন্বয়ের মাধ্যমে ক্যান্সার গবেষণার কাজকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান হলো গৌণ, নতুন শিক্ষা উদ্ভাবন হলো মুখ্য।’ আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার নতুন উদ্ভাবনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করে গ্রুপভিত্তিক গবেষণাকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মাধ্যমে গবেষণাভিত্তিক যে প্রকল্পগুলো পরিচালিত হচ্ছে, তার মাধ্যমে নতুন ধারণা ও সৃষ্টি গ্রুপভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব হচ্ছে। আমাদের দেশেও নাসার মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে গবেষণাকে বাস্তব অর্থে শিল্পমুখী করে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে। বিল গেটস, স্টিভ জবসের যে আধুনিক সফটওয়্যার কম্পানিগুলো রয়েছে, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় ও তাঁদের ইন্ডাস্ট্রির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের গবেষণার সুবিধা হলো, এতে পিএইচডি, পোস্ট-ডক্টরাল ও মাস্টার্স লেভেলের পূর্ণকালীন শিক্ষার্থী রিসার্চ ফেলো হিসেবে পাওয়া যায়। এতে করে এই রিসার্চে সার্বক্ষণিকভাবে সম্পৃক্ত থেকে একজন শিক্ষার্থী আর্থিক স্বাধীনতা লাভ করে। ফলে আর্থিক স্বাধীনতার কারণে সেই শিক্ষার্থী নিবিড়ভাবে গবেষণাকার্য চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণার সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায়নি। ফলে একজন শিক্ষার্থী সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাজে যুক্ত থাকায় তার পক্ষে গবেষণায় গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকা সম্ভব হয় না। এ কারণে মৌলিক গবেষণার যে উত্কর্ষ সাধন হওয়ার কথা ছিল, তা সেভাবে হতে পারেনি। গবেষণা শুধু ফলিত গবেষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। কাজেই গবেষণা ও উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তিকে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে প্রাধান্য দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর