Most important heading here
Less important heading here
Some additional information here
Emphasized textSome additional information here
Emphasized textআমাকে যদি কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি কী তাহলে আমি একেবারে চোখ বুজেঁ উত্তর দেব যে সেটি হচ্ছে এই দেশের সব কিছুতে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও এগিয়ে আসছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি পাঁচ কোটির মতো এবং এর অর্ধেক হচ্ছে মেয়ে! শুধু যে সংখ্যায় অর্ধেক মেয়ে তা নয় আজকাল লেখাপড়াতেও মেয়েরা ছেলেদের থেকে ভালো করতে শুরু করেছে। যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হয়, তাহলে কিন্তু দেখা যাবে সুযোগ সুবিধা হয়তো ছেলেরাই বেশি পাচ্ছে।
এক সময় আমরা পাকিস্তান নামক একটি দেশের অংশ ছিলাম, ভাগ্যিস সেই দেশটি থেকে সময়মতো আলাদা হয়েছি। সেই দেশে একটি মেয়ে লেখাপড়া করতে চেয়েছিল বলে তার মাথায় গুলি করে দেয়া হয়েছিল। নোবেল পুরস্কার দিয়ে কোনোমতে সম্মানটি রক্ষা করতে হয়েছে। প্রায় নিয়মিতভাবে সেই দেশে এখনো মেয়েদের স্কুল পুড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টো। ছেলে হোক, মেয়ে হোক সবাই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে, সময়মতো ঝকঝকে নূতন বই পাচ্ছে, শুধু তাই না মেয়ে হলে লেখাপড়া করার জন্যে মাসে মাসে টাকা পাচ্ছে।
পারিবারিক বা সামাজিক ভাবে অনেকে মনে করতো মেয়েদের শিক্ষক বা ডাক্তার হওয়াটাই বুঝি সহজ তাই এই দেশে শিক্ষক এবং ডাক্তারের মাঝে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। কিন্তু যখন এই গতানুগতিক চিন্তা থেকে বের হতে শুরু করেছে, তখন অন্য সব জায়গাতেও আমরা মেয়েদের দেখতে শুরু করেছি। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে দেখেছি মহিলা পাইল,ট কো পাইলট আর ক্রুরা মিলে বিশাল বিমান ঢাকা থেকে উড়িয়ে লন্ডন নিয়ে গেছে। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক প্রথম পুরস্কারটি এনেছে মহিলা ক্রিকেট দল। পথে ঘাটে মহিলা পুলিশ দেখে আমরা এতো অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে আজকাল সেটি আলাদা করে চোখেও পড়ে না। সেনাবাহিনীতে মহিলারা আছেন। রাজনীতিতে আছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে সাহসী কাজ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশটিকে গ্লানি মুক্ত করা। সেই কাজটির জন্যে একক ভাবে কৃতিত্বটি দিতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যিনি একজন মহিলা।
মজার ব্যাপার হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মহিলাদের কাজ করতে দেখে আমরা কিন্তু পুরুষ মহিলার বিভাজনটি ভুলে যেতে শুরু করেছি। সবাইকেই মানুষ হিসেবে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি। কিন্তু পশ্চিমা জগতের মিডিয়া বিবিসি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী দি ইকোনোমিস্ট এর মত সাপ্তাহিকী কিন্তু এখনো যথেষ্ট শিক্ষিত বা উদার হতে পারেনি। তারা আমাদের বর্তমান কিংবা আগের প্রধানমন্ত্রীদের এখনো অবমাননাকর ‘বেগম’ শব্দটি দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়। শুধু তাই না যারা বেগম শব্দটির সাথে পরিচিত নয় তাদেরকে এই শব্দটি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়।
আন্তর্জাতিক নানা ধরনের জরিপেও দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে মহিলারা যথেষ্ট এগিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো দেখে কেউ যেন মনে না করে আমাদের দেশে মহিলাদের জন্যে যা কিছু করা সম্ভব তার সবকিছু করা হয়ে গেছে। এটি মোটেও সত্যি নয়, খবরের কাগজে মাঝে মাঝেই আমরা মেয়েদের ওপর ভয়ংকর নির্যাতনের খবর দেখি। যখনই এরকম একটি খবর দেখব তখনই মনে মনে হিসাব করে নিজেকে বলতে হবে, এই খবরটি খবরের কাগজ পর্যন্ত এসেছে। এরকম আরো অনেক খবর আছে যেগুলো খবরের কাগজ পর্যন্ত আসেনি। আমরা শুধু ধর্ষণ গণধর্ষণ জাতীয় ভয়ংকর খবরগুলোকে নির্যাতন হিসেবে দেখি। কিন্তু একজন মহিলা যখন একজন পুরুষ মানুষের সমান সমান কাজ করে কম বেতন পান সেটিও যে এক ধরনের নির্যাতন, সেটি আমাদের মাথায় আসে না। যে সমস্ত মেয়েরা পথে ঘাটে চলাচল করে, বাসে ওঠার চেষ্টা করে তাদের সবারই প্রায় নিয়মিতভাবে পুরুষের অশালীন হাতের স্পর্শ সহ্য করতে হয়।
একজন পুরুষ মানুষ যখন তার নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলে ঠিক সেই সময় একজন মহিলাকে সন্তান জন্ম দিতে হয়, তাকে বুকে আগলে বড় করতে হয়। কাজেই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে মহিলাদের সংখ্যা কম। মহিলারা যেন পুরুষের পাশাপাশি সব জায়গায় আসতে পারে তার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। কিন্তু মহিলাদের সব জায়গায় সমান সমান পাওয়ার জন্য আরো অনেকদূর এগিয়ে যেতে হবে।
আমাদের দেশের মেয়েরা কিংবা মহিলারা কেন অধ্যদেশের মেয়ে কিংবা মহিলা থেকে অনেক বেশী তেজস্বী সে ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা থিওরি আছে। ১৯৭১ সালে এই দেশের প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, তুলনামূলকভাবে সেখানে পুরুষ মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল। একটা সংসারে যখন পুরুষ মানুষটি মারা যায় তখন পুরো পরিবারটি পথে বসে যায়। কাজেই ১৯৭১ সালে এই দেশের অসংখ্য মহিলা আবিষ্কার করেছে তাদের সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। একজন মা তার সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য শরীরের শেষ বিন্দু রক্ত পর্যন্ত দিতে রাজি থাকে, তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘরের ভেতর আটকে থাকা অসংখ্যা স্বামী-হারা মায়েরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন। সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য তারা পুরুষের পাশাপাশি নানা কাজে যুক্ত হয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন এবং সন্তানদের রক্ষা করেছেন। আমি এটা জানি কারণ আমার মা ঠিক এরকম একজন মহিলা ছিলেন, আমি আরো মহিলাদের কথা জানি যারা এভাবে তাদের সন্তানদের রক্ষা করেছেন। আমার ধারণা এই কারণে আমাদের দেশের মহিলারা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি তেজস্বী।
আমার এই থিওরিটি কতোখানি সত্য আমি কখনো পরীক্ষা করে দেখিনি কিন্তু আমার ধারণা এর মাঝে সত্যতা আছে।
আমাদের দেশের জিডিপি ১৭০০ ডলার থেকেও বেশি এবং সেটি আরো বাড়ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শত্রু ও এখন এই দেশের অর্থনীতিকে সমীহ করে। পাকিস্তান পর্যন্ত বাংলাদেশের মডেলের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে! এই শক্ত অর্থনীতির একটা বড় অংশ এসেছে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি থেকে এবং এই গার্মেন্টসের শ্রমিক বেশিরভাগই নারী। কাজেই এই দেশে আমরা যদি নারীদের অবদানটুকু যথেষ্ট কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ না করি কেমন করে হবে?
তাই এই দেশে যখন কেউ মেয়েদের নিয়ে কোনো এক ধরনের অসম্মানসূচক বা বৈষম্যমূলক কথা বলে দেশের মানুষ যথেষ্ট বিচলিত হয়। সর্বশেষ বক্তব্যটি ছিল মেয়েদের উচ্চশিক্ষা নিয়ে। হেফাজতে ইসলামের আমীর বলেছেন মেয়েদের প্রাইমারী স্কুলের বেশি লেখাপড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তাহলে মেয়েদের নিয়ে পুরুষেরা টানাটানি করবে।
বক্তব্যটি অবিশ্বাস্য, এর আগের বক্তব্যটির মতোই- যখন দাবি করা হয়েছিল মেয়েরা তেঁতুলের মতো এবং তাদের দেখলেই পুরুষ মানুষের জিভে লোল চলে আসে। বক্তব্যগুলো মেয়েদের জন্যে যেটুকু অবমাননাকর, পুরুষদের জন্যে তার থেকে অনেক বেশি অবমাননাকর। কেউ যদি এই কথাগুলো বিশ্বাস করে তাহলে ধরে নিতেই হবে পুরুষমাত্রই বিকারগ্রস্ত এবং এক ধরনের অশালীন লোভাতুর দৃষ্টি ছাড়া অন্য কোনো দৃষ্টিতে তারা নারীদের দিকে তাকাতে পারে না।
মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে বক্তব্যটি অবশ্যি যথেষ্ট আপত্তিজনক। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি সেটি নিয়ে বিশেষ দুর্ভাবনা করছি না। যে দেশে প্রায় আড়াই কোটি মেয়ে আগ্রহ নিয়ে পড়াশোনা করছে, তাদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিলে কোনো উন্মাদও সেটি গুরুত্ব দিয়ে নেবে না।
প্রমত্ত পদ্মা নদীর সামনে কেউ একটা গামছা হাতে দাঁড়িয়ে যদি বলে সে এই গামছা দিয়েই পদ্মা নদীর পানিকে আটকে ফেলবে তখন কথাটা যেরকম হাস্যকর শোনাবে, এই কথাটাও সেরকম।
এই দেশের মেয়েদের উপর আমার অনেক বিশ্বাস!
লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট