পুঁজিবাজারের চ্যালেঞ্জ ও সংস্কার প্রসঙ্গ
পুরো বছরজুড়ে বিনিয়োগকারী ও স্টকহোল্ডাররা যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন, ২০১৮ সালে মূলধন বাজারের পারফরম্যান্স তা পূরণ করতে পারেনি। বছরের শুরু কিছুটা আশার সঙ্গে হলেও দ্বিতীয় অর্ধ ছিল নিরাশার। যদিও সরকার একটি প্রস্তুতিমূলক তালিকা তৈরির চেষ্টা করেছে এবং ইতিবাচক হস্তক্ষেপ ও করপোরেট সুশাসন নির্দেশিকা পালনের মাধ্যমে আগের বছরগুলোয় মূলধন বাজারে নজরদারি প্রতিষ্ঠায় উন্নতি করেছে, তবুও মূলধন বাজার উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্স দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।
বরাবরের মতোই ২০১৮ সালের মূলধন বাজারে যেসব আইপিও এসেছে, তা কোনো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি বা ‘ব্লু-চিপ’ কোম্পানির কাছ থেকে আসেনি; বরং বেশির ভাগ আইপিও প্রতিফলিত করেছে যে বাজারে ছোট আকারের অর্থায়ন হয়েছে। এজন্য মানুষ এসব শেয়ারের ব্যাপারে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। তদুপরি বাংলাদেশী মুদ্রা টাকার মান, সুদহার ও বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছিল। এর ফল হিসেবে দেশ থেকে অর্থ বেরিয়ে যাচ্ছে, যা ব্যাংকের আমানত ভাণ্ডারের ওপর আরো চাপ ফেলছে।
সম্পর্কিত খবর
অন্যদিকে আমানত হার বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে, যেন ব্যাংকগুলোর তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে। কিন্তু ফলাফলে পরিস্থিতি বিপরীত দিকে মোড় নেয়। বছরের দ্বিতীয় অর্ধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধি ছিল খুব নগণ্য। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ফলাফল প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয় এবং চাপে পড়ে মূলধন বাজারে। বিনিয়োগকারীরা বেশি আগ্রহী ছিলেন নিজেদের কম আয় প্রদান করা শেয়ারগুলোকে নগদে রূপান্তর করায় এবং সে অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার প্রতি, এ আশায় যে, উচ্চতর আমানত হারের কারণে মুনাফা বেশি পাওয়া যাবে। তদুপরি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও বিনিময় হারের অস্থিরতা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করেছিল নিজেদের মুনাফা নিজেদের কাছে ফেলে রাখার দিকে। সার্বিকভাবে, তাদের কার্যক্রমের কারণে বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন এবং বাজারের তারল্য সংকট আরো বেশি বিনিয়োগ করা থেকে ক্রেতাদের বিরত রেখেছিল।
২০১৮ সালে যখন সূচক ৬ হাজার ৫০০ পয়েন্ট থেকে কমে ৫ হাজার ৫০০ পয়েন্ট হয়েছিল, তখন বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে খুব বেশি তহবিল আসেনি। আগে ইসলামী ব্যাংক, গ্রামীণফোন, সাউথইস্ট ব্যাংক, সামিট, বেক্সিমকো ও রেনাটার মতো কোম্পানিগুলো বিদেশী বড় আকারের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ দেশে আনতে পেরেছে। তদুপরি, ব্যাংকিং খাতের সাম্প্রতিক সময়ের বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অবস্থা ঝুঁকিগ্রস্ত করেছে। নজরদারির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং করপোরেট সুশাসন নির্দেশিকা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করলেও মূলধন বাজারে কূটকৌশল প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তার ঠেকানোর ব্যাপারে তেমন উন্নতি হয়নি।
মূলধন বাজারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, এটি চলছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দ্বারা। বাংলাদেশ এখনো এমন একটি মূলধন বাজার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, যা বড় আকারের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বা বড় মূলধনি স্টক কর্তৃক পরিচালিত হবে। ক্যাপিটাল মার্কেট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসি বিনিয়োগকারীদের সঠিক জ্ঞান দেয়ার জন্য বারবার উদ্যোগ নিয়েছে বটে, কিন্তু আমরা দেখেছি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোনো কিছু না বুঝে-ভেবে বাজারে নামছেন। এদের বিনিয়োগসংক্রান্ত কোনো ধরনের প্রাথমিক জ্ঞান নেই অথবা বিনিয়োগের আগে কোনো ধরনের পর্যালোচনাও করছে না তারা।
আগের বছর সম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতে যতটুকু বিকাশ হয়েছিল, তা ছিল প্রশংসনীয়। ২০১৮ সালে যেন পুরো সম্পদ ব্যবস্থাপনা খাতকে আবার পিছিয়ে নিয়েছে। এ কারণে ২০১৮ সালে শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির অংশগ্রহণ ছিল বেশ কম। এর ফল হিসেবে বাজার এখনো ব্রোকার ও গুজবচালিত এবং এ বাজারে এমন বিনিয়োগকারী বেশি, যাদের শেয়ারবাজার নিয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। এছাড়া কায়েমি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠী রয়েছে, যারা বাজারে বিভিন্ন কূটকৌশল চালাচ্ছে এবং এদের কারণে বিনিয়োগকারী নিজেদের বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তিত থাকছেন।
বেশ কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি ডিমিউচুয়ালাইজেশন, করপোরেট শাসন নির্দেশিকা ইস্যুকরণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির সক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে তত্পরতা। কিন্তু এর কোনো কিছুই বাংলাদেশকে বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শীর্ষ ১০ পছন্দের জায়গায় ঠাঁই দেয়নি। যখন মূলধন বাজারের প্রসঙ্গ আসে, বাংলাদেশ এখনো ভিয়েতনাম বা শ্রীলংকা, এমনকি পাকিস্তানও হতে পারেনি। যদিও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির যাত্রায় অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী কিন্তু নীতি সীমাবদ্ধতা, বৈদেশিক বিনিময় হার, বিনিয়োগ মূলধন, উইথ হোল্ডিং ট্যাক্স, ডিভিডেন্ডের ওপর কর ও আরো বেশকিছু ইস্যু তাদের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। বাংলাদেশের মূলধন বাজারে ‘ব্লু-চিপ’ কোম্পানির সংখ্যা খুব কম হওয়া পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে।
ছোট বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে বিএসইসি বেশ সক্রিয় এবং সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে। যদিও বড় কোম্পানিকে মূলধন বাজারে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। মূলধন বাজারে বড় মূলধনি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তুলতে কর্তৃপক্ষ বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কোনো গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেনি। এছাড়া পরিস্থিতি থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে বড় টেলিকম, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বা অন্য স্থানীয় করপোরেট মূলধন বাজারে আসতে অনিচ্ছুক।
স্থানীয় বড় করপোরেট ও কমোডিটি ট্রেডিং কোম্পানিগুলো সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী, যেখানে তারা মূলধন বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতস্তত করে। এর পেছনে কারণ হয়তো তারা নিজেদের মুনাফার ভাগ পাবলিককে দিতে চায় না কিংবা তারা বিকল্প উেসর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ সহজতর মনে করে।
এখনো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রধান চালক ঋণ এবং বাংলাদেশের ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতি হওয়ার পথে এটি বেশ শঙ্কা তৈরি করছে। বিশ্বে এমন কোনো অর্থনীতি নেই, যারা ১০০ বা ২০০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে উন্নতী করতে পেরেছে বড় কোম্পানির উপস্থিতিসহ একটি সমৃদ্ধ পুঁজিবাজার ছাড়াই।
২০০ বা ২৫০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি থেকে একটি ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হতে সক্রিয় মূলধন বাজার এবং সেখানে বড় কোম্পানির সক্রিয় অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সময় মূলধন বাজার নজরদারি সংস্থাকে পুরো ইনসেনটিভ বা প্রণোদনা কাঠামো পর্যালোচনা করার এবং শেয়ারবাজারে যাতে বড় কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হয়, সে ধরনের পথ উন্মুক্ত করার জন্য কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত। দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বড় কোম্পানিগুলোর সফলতা বা মুনাফা বণ্টন করার জন্য তাদের মূলধন বাজারে তালিকাভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। এভাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণের বদলে ইকুইটির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি অর্থায়ন ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি এখনই বন্ড বাজার গড়ে তোলায় মনোযোগী হওয়া দরকার। শক্তিশালী বন্ড বাজার মূলধন বাজারকে মজবুত করার পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং খাতকে রক্ষায়ও সহায়তা করতে পারে।
নতুন নির্বাচিত সরকার শাসন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছে এবং জানিয়েছে যে তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা দেখাবে। আশা করা যায়, আগামী পাঁচ বছর সরকার আর্থিক খাতের, যার মধ্যে মূলধন বাজার অন্তর্ভুক্ত, শৃঙ্খলার দিকে নজর দেবে। কিছু লোক মূলধন বাজারে কূটকৌশল চালাচ্ছে। এর বদলে স্থানীয় বৃহৎ কোম্পানি, জয়েন্ট ভেঞ্চার, এমনকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ২০১৯ সালে মূলধন বাজারে তালিকাভুক্ত হবে, এটা দেখতে চাই। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে স্থানীয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করা যাবে না, কেননা এটি সবাইকে ভুল বার্তা দেবে।
যেসব কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তাদের ভ্যালুয়েশন প্রক্রিয়ার দিকেও নজর দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি লাফার্জ সুরমা সিমেন্টের ভ্যালুয়েশন রিপোর্ট আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ গোষ্ঠীর কাছে সম্পূর্ণ ভুল বার্তা দিয়েছিল। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বিএসইসি ও এনবিআরের ভূমিকা নির্ধারণ এবং কার্যক্রম পুনঃপর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে, নতুবা এ নেতিবাচক ধারণা ভবিষ্যতে একটি বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে এবং মূলধন বাজারে বিনিয়োগ আকর্ষণ আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
যদিও বর্তমান সরকার বিপুল পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। তবে যেভাবে নির্বাচন হয়েছে, তা নিয়ে এখনো দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছু ‘কিন্তু’ রয়েছে। যদি আমরা সত্যিকারভাবে মনে করি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূলধন বাজারের ওপর রাজনীতির সরাসরি প্রভাব রয়েছে, তাহলে কীভাবে আমরা শাসননীতি সংস্কার করব এবং বিশেষ করে মূলধন বাজারসংক্রান্ত, অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী রেমিট্যান্স ও মূলধন ইস্যুসংক্রান্ত দেশের প্রাচীন আইন ও প্রবিধানগুলো কীভাবে আধুনিকীকরণ করতে পারি, তা নিয়ে আমাদের তত্পর হতে হবে। পাশাপাশি কথা চলছে স্বল্প পুঁজির প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারের আওতায় আনতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে একটি নতুন বোর্ড অন্তর্ভুক্ত করার। এখনই সময় সব কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারির, নয়তো ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন। অন্যদিকে আবার সাফল্য উন্মোচন করতে পারে পুঁজিবাজারে এক নতুন দিগন্ত। সূত্র: বণিক বার্তা
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
পিবিডি/এসএম