• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

বাংলা ভাষার গল্প

প্রকাশ:  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:১৬
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

১. মমতাময়ী মা তার শিশু সন্তানটিকে পরম আদরে লালন পালন করছিলো| মা তার কাঁন্না জড়ানো আবেগ নিয়ে গাইতো “ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এস খাট নাই পালঙ্ক নাই চৌকি পেতে বসো”। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বুকের ভিতর জমে থাকা বেদনার টুকরো যেন শিশুটির চোখে মুখে ঘুমের আবেশ নিয়ে আসতো| তারপর মায়ের আদর মাখা দরদী কণ্ঠের গান শুনতে শুনতে স্বপ্নের অলোকিক আনন্দে শিশুটি একসময় ঘুমিয়ে পড়তো| মা শিশুটিকে কবিতা শুনাতেন, গল্প বলতেন আর নিজের জীবনের অনেক সুখ দুঃখের কথা বলতেন| শিশুটি তার অবুঝ মনে যেন পেতো এক নিরাপদ আশ্রয় ও আশা| মায়ের কোল জুড়ে ছিল তার নিজেস্ব ভূখণ্ড আর মায়ের কথাগুলো তার কাছে ছিল অমৃত সমান| মায়ের সেই ছেঁড়া শাড়ির কোলে সে পেতো তার অস্তিত্বকে আর মায়ের কথাগুলো ছিল যেন তার শব্দহীন বোবা কণ্ঠের বর্ণমালা| কিন্তু একদিন রাক্ষসেরা তাদের গান শোনাতে বললো মাকে, তাদের মতো করে বলতে বললো অচেনা কবিতা আর গল্প| মা তাদের বললেন আমি আমার গান গাইতে চাই, আমি আমার কবিতা বলতে চাই, আমি আমার গল্প বলতে চাই| একথা শুনে রাক্ষসেরা রেগে উঠলো| শিশুটির মায়ের নরম জিহবাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো| মা বোবা হয়ে গেলো| তার কণ্ঠ রুদ্ধ করা হলো| ঐ মায়ের তরুণ ছেলেরা এর প্রতিবাদ করলো| তারা রুখে দিতে চাইলো রাক্ষসদের তাদের মায়ের প্রতি এই নির্মম অপমান। তারা রুখে দাঁড়ালো| রাক্ষসদের ভয়াল থাবায় রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ| রাক্ষসেরা ভয় পেলো| বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ত দিয়ে রক্ষা করলো তার সন্তানেরা| রাক্ষসেরা ভয় পেলেও তাদের দমন পীড়ন অব্যাহত রইলো। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা| আজ শিশুটি বড়ো হয়েছে, রাক্ষসেরা পালিয়ে গেছে আর মা ফিরে পেয়েছে তার স্বাধীনতা|

২. ক্রিস্টোফার কলাম্বাস জন্মে ছিলেন ১৪৫১ সালের ৩০ অক্টোবর| নুতন পৃথিবী আর বসতি খোঁজার অভিযানে তিনি জয়ী হয়েছিলেন| নুতুন কিছু সৃষ্টির আকাঙ্খা তার মনকে আবেগ তাড়িত করেছিল| তিনি বলেছিলেন নুতন সূর্যের খোঁজে আমরা পুরোনো পৃথিবীকে ছেড়ে যেতে চাই| জন এডামস ৩০ অক্টবর ১৭৩৫ সালে| তিনি ছিলেন আমেরিকার প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট| স্বাধীনতার স্বপ্ন তিনি সত্যে রূপান্তরে কাজ করেছিলেন আর তিনি ছিলেন আমেরিকা গড়ে তোলার একজন নেতা| তিনি স্বাধীনতা কে ভালোবেসেছেন আর দেশ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করেছেন| আরেকজন মানুষ ছিলেন যিনি অন্য দুজনের থেকে অন্য এক অনন্য ইতিহাস তৈরী করেছেন| তিনিও জন্মে ছিলেন ৩০ অক্টোবর| ১৯২৬ সালে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার পারিল বলধারা গ্রামে জন্ম তাঁর। বাবা আব্দুল লতিফ আর মা রাফিজা খাতুনের অতি আদরের সন্তান ছিল সে| লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবার জন্য মাইলের পর মাইল হেঁটে তিনি স্কুলে গিয়েছেন| অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর| সাহিত্যে ছড়া রচনা, সেলাই সুঁচি শিল্পে ও সংগঠন তৈরীতে তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে নেবার ষড়যন্ত্র হলো| কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেনা তিনি| যে মায়ের ভাষায় তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন, যে ভাষায় তিনি মানুষকে আলোকিত করার জন্য কথা বলেছেন, যে সংস্কৃতিকে তিনি বুকে লালন করে চলেছিলেন-তার উপর হায়েনাদের আঘাত তাকে আহত করলো| জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময়ে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জাড়িয়ে পড়েন। তারপর আসে ৫২’র ভাষা আন্দোলন। ২১ ফেব্রুয়ারি পাক সরকার কর্তৃক ভাষা জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিল করার সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে প্রথম গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তাই বলা যায় তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অমর ব্যক্তিত্ব শহীদ রফিক| তার সাথে প্রথম দুজনের পার্থক্য হলো তিনি জীবন ও রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে এনেছিলেন কিন্তু বাকি দুজনকে প্রাণ দিতে হয়নি| যদি তিনজনের মধ্যে কালজয়ী মহাপুরুষ কাউকে বলা হয় তবে তিনি হবেন শহীদ রফিক| আজও তিনি বেঁচে আছেন বাংলা ভাষায়, বেঁচে থাকবেন চিরকাল| মনের আবেগ তাই বলে উঠে বারবার :

সম্পর্কিত খবর

    'তুমি মরার জন্য আসনি

    তুমি গড়ার জন্য এসেছো

    তুমি নিজেকে ভালোবাসোনি

    তুমি দেশকে ভালোবেসেছো

    তুমি মায়ের ভাষায় হেসেছো

    তুমি মরণকে বরণ করেছো'

    ৩. দুজন লোক ছিল| একজন নিজেকে খুব বড় বলে জাহির করে বেড়াতো| সে অন্যদের উপর তার অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইতো| তার ক্ষমতাও ছিল অনেক বেশি| তার সাথে চলতো একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী| সে সাধারণ মানুষের সম্পদ যেমন গ্রাস করতে চাইতো, তেমনি মানুষের টুটি চেপে ধরে তার কণ্ঠকে রুদ্ধ করতে চাইতো| সে বড় একটা পাখির খাঁচা বানিয়েছিলো| সেখানে সে বন্দি করে রাখতো মানুষদের আর তার নিজের ভাষাকে তাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাইতো| খাঁচায় বন্দি ময়না আর টিয়া পাখিকে যেমন মানুষ অন্যায়ভাবে তাদের ভাষা শেখানোর অপচেষ্টা চালায়, তেমনি সে মানুষদের খাঁচায় বন্দি করে তার ভাষায় কথা বলতে বলতো| আরেকজন মানুষ ছিল যেন সেই গানটির মতো “মাগো ভাবনা কেন আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে; তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি তোমার ভয় নেই মা-আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।” তার কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী ছিলোনা, তার কোনো অস্ত্রও ছিলোনা| শুধু ছিল প্রতিবাদের ভাষা| একদিন সে ঐ পরাধীনতার খাঁচাটা ভাঙতে আরো কিছু প্রতিবাদী মানুষ নিয়ে প্রতিবাদ জানালো| সন্ত্রাসীরা বুলেট ছুঁড়লো| একটা বুলেট এসে বিঁধলো শান্তি প্রিয় মানুষটির বুকে| সে তার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তার মতো প্রতিবাদী মানুদের নিয়ে খাঁচার বন্ধন খুলে দিলো| পাখির মতো বেরিয়ে এলো খাঁচায় বন্দি মানুষেরা| ভালো মানুষটার রক্তে রঞ্জিত মৃত দেহটা মাটিতে পড়ে রইলো| এরপর অনেক বছর চলে গেছে| যে মানুষটা আর মানুষেরা খাঁচায় বন্দি মানুষদের মুক্ত করছিলো সবাই তাদের ভুলে গেলো| আজ ঐ সন্ত্রাসীরা বুক ফুলিয়ে চলে| তারা মিথ্যে রঙের ফানুস উড়িয়ে বলে সেদিন খাঁচাটা আমরা মুক্ত করেছিলাম| প্রজন্ম কি সেই ছদ্মবেশী শয়তানদের মুখোশ উন্মোচিত করতে পারবে| নাকি শয়তানরাই জনমানুষের ভিতরে ঢুকে আরো ক্ষমতাবান হবে| একটি কালজয়ী সময়ের প্রতীক্ষা কি কখনো শেষ হবে| উত্তরটা জানা নেই তবে জানা দরকার |

    এখানে শিক্ষণীয় বিষয় গুলো হলো

    ১| মাতৃভূমিকে কেউও অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা চালালে তা দেশপ্রেম দিয়ে রুখে দিতে হবে | কেননা মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি এই তিনটি জিনিস প্রত্যেক মানুষের কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয় |

    ২| এনেছিলে সঙ্গে করে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান |

    ৩| যারা ও যাদের দোসররা আমাদের খাঁচায় বন্দি করার অপচেষ্টা করেছিল তাদের অনুপ্রবেশ আর ক্ষমতা রুদ্ধ করা দরকার | তারা সাধুবেশী শয়তান | তাদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে |

    লেখক- শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

    পিবিডি/এআইএস

    অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close